|
বিশ্বের সবচেয়ে পরিপক্ব অক্ষর কচ্ছপ-হাড় লিপি এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে এবং এখান থেতে খুঁড়ে তোলা হয়েছে। আন ইয়াংকে চীনের অক্ষর নগর বলে গণ্য করা হয়।
ইন রাজবংশের ধ্বংসাবশেষ আন ইয়াং শহরের হুয়ানশুই নদীর দুতীরে অবস্থিত। এটা চীনের ইতিহাসের নথিপত্রে লিপিবদ্ধ প্রথম প্রাচীন নগরের ধ্বংসাবশেষ। ১৯২৮ সালের পরে এখান থেকে পর পর ১১০টিরও বেশি শাং রাজবংশের প্রাসাদ ও ধর্মীয় মন্দিরের ভূমিখণ্ড, ১২টি সম্রাট-সমাধি, হুয়ানপেই শাংছেং ধ্বংসাবশেষ ও আড়াই হাজারটিরও বেশি শ্রদ্ধা-নিবেদন গুহা আবিষ্কার করা হয়।
এছাড়া বিপুল সংখ্যক কচ্ছপ-হাড় লিপি, ব্রঞ্জের ব্যবহার্য ও পান্নাসহ বিভিন্ন অতিসূক্ষ ও সুন্দর পুরাকীর্তি নিদর্শন এখান থেকে খুঁড়ে বের করা হয়েছে। এসব নিদর্শনে ৩ হাজার বছরেরও বেশি আগে চীনের শাং রাজবংশের নগরের অবয়ব ফুটে ওঠে এবং সে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক পর্বের দৃঢ় প্রমাণ সরবরাহ করে। ২০০১ সালের মার্চ মাসে ইন রাজবংশ সম্পর্কিত ধ্বংসাবশেষ 'চীনের বিংশ শতাব্দীর একশটি পুরাকীর্তি নিদর্শন আবিষ্কারের' তালিকায় প্রথম স্থান পায়। ২০০৬ সালের জুলাই মাসে এটাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়।
অক্ষরের আবির্ভাব হওয়ার মানে সে সময় মানবজাতি গিঁট বাঁধার মাধ্যমে হিসেব রাখার যুগ থেকে বেরিয়ে যায়। কচ্ছপ-হাড় লিপির আবিষ্কার শুধু চীনা সভ্যতার প্রতীকই নয়, বরং 'ইতিহাসের বই'সহ বেশ কিছু ঐতিহাসিক দলিলপত্রের সত্যতার প্রমাণ। এতে বইয়ে লিপিবদ্ধ চীনা সংস্কৃতির ইতিহাসকে প্রায় পাঁচ শ' বছর আগে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয়েছে।
আন ইয়াং নর্মাল কলেজের কচ্ছপ-হাড় লিপি বিশেষজ্ঞ এবং ইন ও শাং রাজবংশ সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যাপক কুও শেংছিয়াং মনে করেন, বিশ্বের ৪টি প্রাচীন অক্ষর ব্যবস্থায় কচ্ছপ-হাড় লিপি চীনের প্রতিনিধিত্ব করে। প্রাচীন চীনা অক্ষর কয়েক হাজার বছরের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজ পর্যন্ত বিরাজ করছে এবং এর শক্তিশালী জীবনীশক্তি ও অত্যন্ত উঁচু গবেষণা মূল্য রয়েছে। তিনি বলেন,
(রি-১)
"সাধারণত আমরা বলি, চারটি প্রাচীন সভ্যতার দেশ রয়েছে। কিন্তু সেখানকার প্রাচীন অক্ষর, যেমন প্রাচীন ব্যাবিলনের দুটি নদী অববাহিকার তীরের ফলা বর্ণ ও প্রাচীন মিসরের নিল নদ অববাহিকার নলখাগড়ায় লেখা প্রাচীন পাণ্ডুলিপির মৃত্যু ঘটেছে এবং সেগুলো এখন আর ব্যবহৃত হয় না। এসব অক্ষরের জট ছাড়ানো খুবই কঠিন। কিন্তু আমাদের কচ্ছপ-হাড় লিপির জীবনীশক্তি এখনও রয়েছে। আজকে আমাদের ব্যবহৃত চীনা অক্ষর কচ্ছপ-হাড় লিপি থেকেই এসেছে।"
বর্তমানে ইন রাজবংশের ধ্বংসাবশেষ থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার কচ্ছপ-হাড় অক্ষর ও ৫ হাজারেরও বেশি একক অক্ষর খুঁড়ে তোলা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৫শ' একক অক্ষরের ওপর তাত্পর্য বিশ্লেষণমূলক গবেষণা এবং সেগুলোকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যদিও কচ্ছপ-হাড় লিপি ৩ হাজার বছর ধরে পরিবর্তন প্রক্রিয়া অতিক্রম করে এসেছে, তবুও বর্ণ ও মৌলিক ব্যাকরণ এখনও পর্যন্ত বজায় রয়েছে এবং বর্তমানে বিশ্বের পাঁচ ভাগের এক ভাগ মানুষের ব্যবহৃত অক্ষরে পরিণত হয়েছে। এগুলো চীন এমনকি সারা বিশ্বের সংস্কৃতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে।
কচ্ছপ-হাড় লিপির আবিষ্কারে আন ইয়াং চীনের সত্যিকারের 'অক্ষর রাজধানী'তে পরিণত হয় এবং এসব সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার সম্পদ ও গভীর ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট চীনের অক্ষর জাদুঘরের প্রতিষ্ঠার দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করে। বেশ কয়েক বছরের প্রস্তুতি-কাজের পর ২০০৯ সালের শেষ নাগাদ চীনের প্রথম অক্ষর বিষয়ক জাদুঘর 'চীনা অক্ষর জাদুঘর' আন ইয়াংয়ে চালু হয়। অধ্যাপক কুও শেংছিয়াং মনে করেন, চীনা অক্ষর জাদুঘর প্রতিষ্ঠা চীনা বর্ণগুলোকে একটি 'বাসস্থান' দেয়ার পাশাপাশি চীনা অক্ষর নিয়ে গবেষণা করার এবং এগুলোর ব্যবহার অব্যাহত রাখার একটি কার্যকর উপায় এনে দিয়েছে। তিনি বলেন,
(রি-২)
"চীনা অক্ষর জাদুঘর গত বছর প্রতিষ্ঠিত হয়। এটা চীনা অক্ষরের সংগ্রহ ও গবেষণার একটি কেন্দ্রে পরিণত হবে। কচ্ছপ-হাড় লিপি হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এছাড়া পরবর্তী অক্ষর-পরিবর্তন এবং সংখ্যালঘু জাতির অক্ষরও এর মধ্যে রয়েছে।"
চীনা অক্ষর জাদুঘরে ৫টি প্রদর্শনী ভবন ও ১৫টি ইউনিট রয়েছে। পুরাকীর্তি নিদর্শন যেমন কচ্ছপ-হাড় লিপি, ব্রঞ্জ-খোদাই অক্ষর ও মৃত্-খোদাই অক্ষর, চীনা অক্ষর তথ্য বই ছাপার প্রযুক্তি, সংখ্যালঘু জাতির অক্ষরসহ অনেক বিষয় প্রদর্শিত হচ্ছে এ জাদুঘরে। পর্যটকরা এখানে চীনা অক্ষরের উত্স, উন্নয়ন ও পরিবর্তন সম্পর্কে ধারণা পাবেন। এছাড়া অক্ষর জাদুঘর শব্দ, আলো ও বিদ্যুতসহ বিভিন্ন আধুনিক বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তি দিয়ে পর্যটকদেরকে চীনা অক্ষরের সংস্কৃতি তুলে ধরছে।
চীনা অক্ষরের গভীর সাংস্কৃতিক পটভূমি, সমৃদ্ধ প্রদর্শন বস্তু ও বৈচিত্র্যময় রূপের কারণে এ জাদুঘরে প্রতিদিন বহু সংখ্যক পর্যটক আকৃষ্ট হন। উদ্বোধনের পর ৬ মাসের মধ্যেই বর্তমানে জাদুঘরের দৈনিক দর্শকের সংখ্যা ৪ হাজারে পৌঁছেছে। পর্যটকরা চীনা অক্ষরের ৫ হাজার বছরের উন্নয়ন ইতিহাস জেনে বিস্ময় প্রকাশ করেন। এ ব্যাপারে জাদুঘরের পথনির্দেশক চাং ইউয়ে বলেন,
(রি-৩)
"আমাদের নিজের সংস্কৃতির জন্য এখানে আসা দর্শকরা গর্ববোধ করে। শুধু চীনা নয়, বিদেশীরাও প্রদর্শন ভবন পরিদর্শন করার পর একটি শব্দ 'অত্যাশ্চর্য' ব্যবহার করেন। আমার মনে হয় এটা খুবই উঁচু একটি মূল্যায়ন।"
প্রাথমিক পর্যায়ের প্রদর্শনী ও পুরাকীর্তি সংরক্ষণ কাজ সম্পন্ন করার পর চীনা অক্ষর জাদুঘর এর গবেষণা ও যোগাযোগ কাজে হাত দেবে। জাদুঘরের প্রচার ও শিক্ষা বিভাগের পরিচালক হু ইয়ান ইয়ান বলেন,
(রি-৪)
"আমাদের জাদুঘরে বিদ্যা কমিটি ও অতিথি গবেষক রয়েছেন। তাঁরা সবাই জাতীয় পর্যায়ের। আমরা নিয়মিতভাবে সেমিনারের আয়োজন করি। এছাড়া আমরা বিশেষজ্ঞদের জাদুঘরে সমাজমুখী আলোচনা সভায় আমন্ত্রণ জানাই।"
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনা ভাষা শিক্ষা সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রায় ১০ কোটি বিদেশী বর্তমানে চীনা ভাষা শিখছেন। প্রতিদিন বহু চীনাভাষা শিক্ষার্থী অথবা চীনা সংস্কৃতিতে আগ্রহী বিদেশী বন্ধু আন ইয়াংয়ে আসেন। তারা চীনা অক্ষরের জন্মস্থানে এসে চীনা বর্ণ ও সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যময় আকর্ষণীয় শক্তি উপলব্ধি করেন।"
তাঞ্জানিয়ার পর্যটক ফাধিলি একজন চীনা সংস্কৃতি অনুরাগী। আন ইয়াং ভ্রমণের পর তিনি চীনা অক্ষর সংস্কৃতি ও এর পাণ্ডিত্য উত্স দেখে তীব্র আবিভূত হন। তিনি বলেন,
(রি-৫)
"আমি চীনা অক্ষর জাদুঘর ও ইন রাজবংশের ধ্বংসাবশেষ পরিদর্শন করেছি, চীনা অক্ষরের ইতিহাস জানার চেষ্টা করেছি। এখানে পরিদর্শন করে সত্যিই আমি আশ্চর্য হয়েছি। আপনি চীনা অক্ষরের ইতিহাস ও উন্নয়ন জানতে চাইলে আপনাকেও আন ইয়াংয়ে আসতে হবে।"
অক্ষর চীনা সংস্কৃতি ও ইতিহাসের উত্তরাধিকার হিসেবে বর্তমানের বিশ্ব সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ক্ষেত্রে আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। চীনা অক্ষর রাজধানী আন ইয়াং বিশ্বের বিভিন্ন এলাকার পর্যটকদেরকে চীনা অক্ষরের বৈশিষ্ট্যময় অন্তর্নিহিত তাত্পর্য ও আকর্ষণীয় শক্তি প্রদর্শন করবে।
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved. 16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040 |