|
এখানে এই মাওসোলিয়ামে শায়িত মহান নেতা সবাইকে কাঁদিয়ে পরপারের পথে যাত্রা করেছিলেন ১৯৭৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। তাঁর মারা যাবার পর একটানা প্রায় সাড়ে ন'মাস বিভিন্ন প্রদেশ, স্বশাসিত অঞ্চল এবং চীনের ক্ষুদ্র জাতিগুলো মিলিয়ে সাত লাখ মানুষের প্রতিকী অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে দিবারাত্রি কঠোরতার সাথে একটানা পরিশ্রমের পর তাঁর এই স্মৃতি সৌধ নির্মাণ কাজ সম্পুর্ণ হয়।
(থিয়েন আনমেন স্কোয়ারে মাও সেতুং-এর মউসোলিয়াম)
এ মউসোলিয়ামটি চীনের স্থপতিরা সারা চীনের জনগণের ধ্যান ধারণাকে সম্বল করে একান্ত নিজস্ব বৈশিষ্টের আলোকে নকশা করেন এবং চীনের প্রকৌশলী ও কারিগরদের মেধা দীপ্ত প্রয়োগের দ্বারা নির্মাণ করা হয়েছে। এ মউসোলিয়ামে যাতে সারা চীনের সব মানুষের শ্রদ্ধা মেশানো ছোঁয়া থাকে সে কথা বিবেচনা করে এর নির্মাণ উপকরণ সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে সিচুয়ান প্রদেশ থেকে গ্রানাইট পাথর, কুয়াংতুং প্রদেশ থেকে পোরসিলিনের প্লেটস, ইউননান এবং শাংশি প্রদেশ থেকে পাইন গাছ, শিনচিয়াং স্বায়ত্বশ্বাসিত অঞ্চলের থাইশান পাহাড় থেকে গ্যাজানো বীজ (saw-wort seed) ভূমিকম্প বিদ্ধস্ত থাংশান অঞ্চলের মাটি, নানচিং থেকে রঙিন নূড়ি পাথর, কুনলুন পাহাড় থেকে দুধ সাদা স্ফটিক (quartz), জিয়াংশি প্রদেশ থেকে পাইন গাছের গুড়ি বা কাঠ এবং পৃথিবীর সর্বোচ্চ পাহাড় শৃঙ্গ এভারেস্ট থেকে পাথর খন্ড। এ ছাড়াও চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ তাইওয়ানের জনগণের অংশগ্রহণের জন্য তাইওয়ান ভূখন্ড থেকে পানি ও বিশেষ ধরনের বালু উপকরণ হিসেবে কাজে লাগানো হয়েছে। চেয়ারম্যান মাও সে তুং-এর দেহ সংরক্ষণ ও জনগণ যাতে তাঁকে একনজর দেখতে পারে সে জন্য মহান নেতার দেহ সংরক্ষণের বিশেষ পদ্ধতি চীনা বিশেষজ্ঞদের জানা না থাকায় তা রাশিয়া থেকে নেয়ার কথা ভাবলেও তা সম্ভব হয় নি। কারণ, তখন রাশিয়ার সাথে চীনের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। যেহেতু ভিয়েতানামের মুক্তির একনিষ্ঠ দূত মহান নেতা হো চি মিন-এর দেহও সে দেশে মমি করে রেখে নাগরিকদের শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। ভিয়েতনাম এ প্রযুক্তি নিয়েছিল রাশিয়ার কাছ থেকে। উল্লেখ্য যে, ১৯২৫ সালে ড. সান ইয়াত সেন মারা যাওয়ার পর রাশিয়া তার দেহ সংরক্ষণের জন্য একটি ক্রিস্টাল বক্স তৈরি করে দিয়েছিল। তখন ঠিক করা হয়েছিল যে, সেই ক্রিস্টাল কফিন বক্সটিই মাও সে তুং-এর দেহ সংরক্ষণের বন্য ব্যবহার করা হবে। সব যখন ঠিক ঠাক তখন দেখা গেল সেই কফিন বক্সটি লম্বায় ১.৭৫ মিটার অর্থাত ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি। অথচ মাও সে তুং-এর উচ্চতা হলো ১.৮ মিটার অর্থাত পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি। তারপর এ কফিন বক্সটির চারদিক স্টিলের ওপর নিকেলের প্লেট দিয়ে ঘেরা ছিল। যার ফলে দর্শককে মাও সে তুং-কে দেখতে হলে কাছে এসে ঝুঁকে পড়ে দেখতে হবে। যা কি না গ্রহণযোগ্য নয়। এসময় চীন তার নিজের কারখানার মাধ্যমে এ ক্রিস্টাল বক্স তৈরির উদ্যোগ নেয়। বেশ কয়েকটি কারখানাকে দায়িত্ব দেয়া হলে শেষ পর্যন্ত ১৯৭৬ সালের ২৭ নভেম্বর ৬০৮ নম্বর কারখানাটির নির্মিত ক্রিস্টাল বক্সটি গুণগত মান পরীক্ষায় নির্বাচিত হয়। মাও সে তুং-এর প্রতি চীনের মানুষের কতটা শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা তার কথা উল্লেখ করতেই হয়। এ ক্রস্টাল কফিন তৈরি করার সময় ১৯৭৬ সালে থাংশানে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়। ভূমিকম্পের সময় যাতে কারখানা ধসে পড়ে এ ক্রিস্টাল কফিন ভেঙ্গে না যায় সে জন্য বহু শ্রমিক মানব ঢাল হিসেবে এ ক্রিস্টাল প্লেটের ওপর শুয়ে পড়ে তাকে রক্ষা করে নিজেদের আত্মত্যাগের মহিমা সারা জাতির কাছে তুলে ধরেছিল। দেহটাকে ঠিক একই অবস্থায় এবং দেহের রং একই অবস্থায় যাতে থাকে সে জন্য এর ভেতরে শেনন (xenon) আলোক ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে দর্শকরা তাঁকে দূর থেকেই স্পস্টভাবে দেখতে পায়। চীনের এসব প্রযুক্তি বিশ্বে এখন সবচেয়ে উন্নত মানের। ১৯৫৯ সালে চীনের মহাগণভবন তৈরি করতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছিল ১৯৭৭ সালে মাও'র মউসোলিয়াম তৈরি করতে তার চেয়ে প্রায় দশগুণ বেশি ব্যয় হয়েছিল।
(মাও সে তুং মউসোলিয়ামের সামনে বীর যোদ্ধাদের ভাষ্কর্য)
আমি এখানে এই থিয়েন আন মেন স্কোয়ারে যতবারই আসি ততবারই মাও সে তুং-এর মউসোলিয়ামের কাছে ছুটে যাই। কিছুটা সময় হলেও দাঁড়িয়ে থাকি মউসোলিয়াম ভবনের চার কোণায় বেদির ওপর নির্মিত সংগ্রামী বীর যোদ্ধাদের ভাষ্কর্যের সামনে। ভাবতে থাকি দেশ জাতি, আর মানুষের কথা। ভাবতে থাকি মানুষে মানুষে বৈষম্যহীনতা কবে অবসান হবে সে সব কথা। এখানে প্রতিদিন আসা হাজার হাজার দর্শক ও ভিনদেশী পর্যটকের সকাল সন্ধ্যা অবস্থানের কথা ভেবে মনে হয় মানুষে মানুষে শান্তি আর সম্প্রীতি এ বিশ্বটাকে গড়ে তুলতে পারে আরো সুন্দর করে।
এখানে এই চত্বরে ১৯৭৭ সালের ২৪ মে অবিস্মরণীয় এক অনুষ্ঠানে থিয়েন আন মেন স্কোয়ারে আবেগাপ্লুত লাখ লাখ মানুষের চোখের পানি আর অসংখ্য ফুলেৱ আর ফূলের সৌরভ মাখা হৃদয় নিংড়ানো পবিত্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় শায়িত হন মহান নেতা। যেখানে তিনি আজও ঘুমিয়ে আছেন চির নিদ্রায়। জেগে থাকবেন সারা পৃথিবীর অগণিত মানুষের চিন্তা ও চেতনার অফুরাণ দৃষ্টির অসীমে চিরদিন। - আ বা ম. ছালাউদ্দিন
![]() |
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved. 16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040 |