Web bengali.cri.cn   
স্মৃতিসৌধে চির অম্লান চেয়ারম্যান মাও
  2010-08-10 20:45:53  cri
চির সভ্যতার আর চির বিষ্ময়ের দেশ চীন সম্পর্কে কিছুই জানে না এমন লোকটি হয়তো সারা বিশ্বে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে। প্রতিদিন যেভাবে চীন তার অগ্রগতির ধারায় এগিয়ে চলছে তাতে এ দেশটি সম্পর্কে আগাম কিছু বলাও খুব কঠিন। আমারতো মনে হয় একশ ত্রিশ কোটিরও বেশি চীনা জনগণসহ সারা বিশ্বের নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে যিনি লড়ে গেছেন আমৃত্যু সেই চেয়ারম্যান মাও সেতুংকে নামে চেনে না এমন লোক পাওয়াও হয়তো যাবে না। চীনের রাজধানী পেইচিংয়ে এসেছেন, থিয়েন আনমেন স্কোয়ারে গেছেন অথচ চেয়ারম্যান মাও সেতুং-এর স্মৃতিসৌধ দেখেন নি এমন লোকও খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। মাও সেতুং এক অবিসংবাদিত নাম। মাও সে তুং চীনের সাফল্যের সূচকের স্বর্ণময় অমলিন শিলা খন্ড।

চীনে আসার পর আমার প্রথম কাজটিই ছিল মহান নেতাকে চাক্ষুস দেখা। সেবার এসেছিলাম ১৯৯৯ সালে। বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক দলের সংগে, দলের ম্যানেজার হিসেবে। দায়িত্ব ছিল অনেক বেশি। সময় বের করাই ছিল খুব কঠিন। থিয়েন আন মেন স্কোয়ার ও ফরবিডেন সিটি অর্থাত নিষিদ্ধ নগরী সেবারই প্রথম দেখার সুযোগ হয়েছিল। দেখে সত্যিই অবাক হয়েছিলাম। নিষিদ্ধ নগরীর কথা না হয় আরেক অনুষ্ঠানে বলবো।

(থিয়েন আন মেন স্কোয়ারে মাও সেতুং মউসোলিয়ামের সামনে লেখক আবাম ছালাউদ্দিন(বায়ে)মাসে চারু শিল্পী মনিরুজ্জামান ও ডানে শিল্পী আমিনুর রশীদ)

সেবার আমাদের সাংস্কৃতিক দলে এসেছিলেন নাট্যকার ও পরিচালক মামুনুর রশীদ, তারাণা হালিম (বর্তমানে জাতীয় সংসদ সদস্য), শিবলী, নিপা ইশিতা, মৌসহ অনেক শিল্পীই। পেইচিং ছিলাম পাঁচ দিন। থিয়েন আন মেন স্কোয়ার দেখে মনে হয়েছিল লোকালয়ের ভীড়ে এ যেন এক বিশাল প্রাংগণ। এর আগে আমার মস্কোর রেড স্কোয়ার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। এর বিশালত্বের তুলনায় অনেক ছোট। সেখানেও আমার লেনিনকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেবারে মাও সে তুং-এর মউসোলিয়াম সংস্কারের কাজে বন্ধ থাকায় তা না দেখতে পারায় মন খারাপ হয়েছিল দারুণভাবে। দ্বিতীয়বার ২০০৪ সালে এসেও দেখতে পারিনি আমাদের থাকার দিনটিতে বন্ধ থাকার কারণে।

তৃতীয়বার ২০০৬ সালে চীন আন্তর্জাতিক বেতারে কর্ম উপলক্ষে এসেই প্রথম সাপ্তাহিক ছুটির দিনেই গিয়েছিলাম মহান নেতাকে দেখতে। সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা। দারুণ রোমাঞ্চ। লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষার প্রহর গুণতে গুণতে সময় যেন শেষ হচ্ছিল না। প্রায় মিনিট বিশেকের মত আঁকা বাঁকা সারিবদ্ধ লাইন ঘুরে কম্পিত বক্ষে ঢুকেই আবেগ আপ্লুত হয়েছিলাম মহান এ নেতাকে দেখে। সেই সুন্দর, সৌমকান্তি, নির্মল, নিষ্পাপ চেহারা। একজন সংগ্রামী মানুষের মুখ। সারা বিশ্বের নির্যাতিত, নিপীড়িত, নিষ্পেশিত মুক্তিকামী মানুষের নেতা। যিনি সেই ১৯৪৩ সাল থেকে কম্যুনিস্ট পার্টির পলিট ব্যুরোর চেয়ারম্যান এবং ১৯৪৫ সাল থেকে চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন মৃত্যুর আগের দিন ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত। কী সুন্দর কাচের আবরণের ভেতর হালকা হলুদ আলোর মাঝে হীম শীতলতার ভেতর শুয়ে আছেন নিশ্চিন্তে, নির্বিঘ্নে কালের স্বাক্ষী হয়ে। মনে হয়। এইমাত্র যেন ঘুমিয়ে পড়েছেন। ইচ্ছে হচ্ছিল কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। উপায় নেই। লাখো জনতার ঢল তাঁকে এক নজর দেখার জন্য নিরবে নিশব্দে ধীর পায়ে এগিয়ে আসছেন। এই তিনিইতো একদিন মুক্তির জন্য যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। মুক্তি সেনা আর সাধারণ মানুষে খুব কাছা কাছি থেকে তাদের আপনজন হিসেবে নিজেকে লীন করে দিয়েছিলেন ত্যাগের মহিমায়। একই সাথে লিখে গেছেন মানুষের মুক্তি আর সমাজ গঠনের তত্বকথা। দিয়ে গেছেন সামাজিক উন্নয়নের দিক নির্দেশনা। দেশকে সাফল্য আর উন্নয়নের শিখরে পৌঁছে দিতে বলিষ্ঠ সামাজিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে রেখে গেছেন এক অনন্য দৃষ্টান্ত। মনে হচ্ছিল তাঁকে যদি একবার ছুঁয়ে দেখতে পারতাম, জীবনটা ধন্য হয়ে যেতো। মনে হলো এমন করে যদি সারা বিশ্বটাকে গড়ে তোলা যেতো। ধীর পায়ে হাটতে হাটতে মনে পড়লো আমার ছাত্র অবস্থায় তাঁর কাছে প্রায় শ' তিনেক চিঠিও লিখেছিলাম একটার পর একটা। সৌভাগ্যও হয়েছিল দু'লাইনের একটি শুভেচ্ছা বার্তা পাবার। সে এক ইতিহাস।

(মাও সেতুং মউসোলিয়ামের সামনে বীর যোদ্ধাদের ভাষ্কর্য)

সারিবদ্ধ হয়ে সবার সাথে পেছনের বহির্গমন পথ দিয়ে দেখতে পেলাম কড়া সূর্যালোকের মাঝে অসংখ্য জনতার ভীড়। দেখে মনে হলো প্রিয় নেতার প্রতি মানুষের কতই না ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার বহি:প্রকাশ। সারা থিয়েন আন মেন স্কোয়ার যেন লোকে লোকারণ্য। এ যাবত যতবার গিয়েছি ততবারই দেখেছি চীনাসহ এখানে আসা সারা বিশ্বের অগণিত মানুষের ঢল। বিশেষ করে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তে দাঁড়াবার জায়গাটিও পাওয়া ভার।

মাও সে তুং-এর এ মউসোলিয়াম থিয়েন আন মেন স্কোয়ারের ঠিক মাঝখানে মিং ও ছিং ডাইনাস্টির সময়কালের রাজ নগরীর তৈরি করা হয়েছে। এর সামনে খোলা চত্বরে নির্মিত শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ আর তার পরেই হাজার বছরের ইতিহাসের স্বাক্ষী রাজ রাজাদের আবাসস্থল নিষিদ্ধ নগরী। এখানে বসেই বিভিন্ন ডাইনাস্টির সময়কালের সম্রাটরা তাদের শাসন কাজ চালাতেন। মউসোলিয়ামের বা'দিকে অর্থাত দক্ষিণে রয়েছে গণচীনের মহাগণভবন, যাকে আমরা বলি জাতীয় সংসদ। ডান দিকে রয়েছে শিল্পকলা জাদুঘর ও উত্তর পশ্চিম কোণায় রয়েছে পেইচিংয়ের পুরানো রেলওয়ে স্টেশন। দেখতে ঠিক আমাদের দেশের আহসান মন্জিলের মত, বা বলা চলে প্রতাপশালী জমিদার বাড়ি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এটি এখন রেলওয়ের জাদুঘর।

এখানে এই মাওসোলিয়ামে শায়িত মহান নেতা সবাইকে কাঁদিয়ে পরপারের পথে যাত্রা করেছিলেন ১৯৭৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। তাঁর মারা যাবার পর একটানা প্রায় সাড়ে ন'মাস দিবারাত্রি কঠোর পরিশ্রমের পর তার এই স্মৃতি সৌধ নির্মাণের কাজ সম্পুর্ণ হয়। ১৯৭৭ সালের ২৪ মে অবিস্মরণীয় এক অনুষ্ঠানে থিয়েন আন মেন স্কোয়ারে আবেগাপ্লুত লাখ লাখ মানুষের চোখের পানি আর অসংখ্য ফুলেৱ আর ফূলের সৌরভ মাখা হৃদয় নিংরাণো পবিত্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় শায়িত হন এই মনান নেতা। যেখানে তিনি আজও ঘুমিয়ে আছেন চির নিদ্রায়। থাকবেন সারা পৃথিবীর অগণিত মানুষের মাঝে চিরদিন।

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্যের পাতা
ভিডিও চিত্র
সাক্ষাত্কার
চিঠিপত্র
Play Stop
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040