|
সিনইয়াংয়ের চায়ের পাহাড়
বন্ধুরা, মধ্য চীনের হুপেই, হোনান ও আনহুই তিনটি প্রদেশ সংলগ্ন স্থানে অবস্থিত হোনান প্রদেশের সিনইয়াং শহর হচ্ছে চীনের বিখ্যাত সবুজ চা উত্পাদনের স্থান। সিনইয়াংয়ের দক্ষিণ দিকে রয়েছে পাহাড় আর উত্তর দিকে হুইহো নদী। সবুজ পাহাড় ও নদনদী ঘেরা সিনইয়াং শহরের আবহাওয়া খুবই চমত্কার।
প্রাকৃতিক বৈশিষ্টের কারণে সিনইয়াংয়ের ছবির মতো সুন্দর দৃশ্য সৃষ্টি এবং শ্রেষ্ঠ 'সিনইয়াং মাওচিয়ান চা' উত্পাদিত হয়। হাজার বছর ধরে এখানকার মানুষের মধ্যে চায়ের সঙ্গে অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। এমন কি, তাদের জীবনে একদিনও তারা চা পান থেকে বিরত থাকে নি।
প্রতি বছরের এপ্রিল মাস হচ্ছে বসন্তকালীন চা তোলার সময়। পাহাড়ে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা চা গাছের নতুন পাতার সবুজ রং খুব তাজা। সিনইয়াং শহরের শিহোকাং মহকুমার হেইলোংথান গ্রাম হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ সিনইয়াং মাওচিয়ান চায়ের গুরুত্বপূর্ণ ও নামকরা উত্পন্ন স্থান। এখানকার পাহাড়ের উচ্চতা ৮০০ মিটারের কাছাকাছি। দূরের পাহাড়ী অঞ্চল দেখলে হালকা মেঘ ও কুয়াশায় ঢাকা শুধু চায়ের গাছ ও চা পাতার সুগন্ধ অনুভব হবে। এখানে চায়ের পাহাড় যে কেবল প্রাকৃতিক দৃশ্য সমৃদ্ধ তা নয়, বরং পাহাড়ী অধিবাসীদের ভরসাও বটে। চা উত্পাদনে দক্ষ ব্যক্তি চৌ সিন সাংবাদিককে বলেছেন, 'আমাদের গ্রামের প্রতিটি পরিবার চা উত্পন্ন করে জীবন চালায়। অতীতে চা উত্পাদনের পরিমাণ কম ছিল, তখন আমরা কেবল পেট ভরে খেতে পারতাম, কিন্তু ভালো দামে চা বিক্রি হতো না। তখন আমাদের চা উত্পাদনের প্রযুক্তিও ভালো ছিল না। ফলে উত্পাদনের পরিমাণও ছিল কম। সে সময় সড়ক যোগাযোগও ভালো ছিল না। অনেক ক্রেতা চা কিনতে চাইলেও পাহাড়ের উপরে আসতে পারতেন না। আমরা পাহাড় থেকে নামতে পারতাম না। এখন সড়ক নির্মিত হয়েছে। বহু লোক গ্রামে এসে চা কিনেন। আমরা অনেক অর্ডার পাই।'
সিনইয়াং শহরের চার দিকে চায়ের সুগন্ধ ছড়িয়ে থাকার পাশাপাশি আরো অনেক সুন্দর কিংবদন্তী রয়েছে। এখানে আসা পর্যটকরা ভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে চা খেয়ে দর্শনীয় স্থান উপভোগ করার সময় প্রাচীনকালের আকর্ষণীয় গল্পগুলো শুনতে পারেন। সিনইয়াং শহর হুইহো নদীর উচ্চ অববাহিকায় অবস্থিত এবং উত্তর দিকে দাবিয়ে পাহাড় সংলগ্ন বলে এ এলাকার বৃষ্টিপাত প্রচুর, গাছগাছড়া সমৃদ্ধ। সিনইয়াং শহরের পানি সম্পদের পরিমাণ হোনান প্রদেশের মোট পানির পরিমাণের ২২ শতাংশ। বনায়নের হার প্রায় ৩০ শতাংশ। শ্রেষ্ঠ প্রাকৃতিক অবস্থা ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষার কারণে সিনইয়াং শহর অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছে। সিনইয়াং চীনের জাতীয় পর্যায়ের প্রাকৃতিক দৃষ্টান্তের শহর, চীনের শ্রেষ্ঠ পর্যটন শহর এবং ২০০৯ সালে চীনের দশটি সেরা বাসোপযোগী শহরের অন্যতম নির্বাচিত হয়েছে।
সিনইয়াং শহরে বিখ্যাত গ্রীষ্মকালীন আরামদায়ক স্থান চিকোং পাহাড় রয়েছে। এ পাহাড়ী অঞ্চলের বৈশিষ্ট হচ্ছে দুপুরের আগে বসন্তকালের মতো, দুপুরের পর শরত্কালের মতো আর রাতে শীতকালের মতো। এ পাহাড়ের শৃঙ্গে বিশাল একটি কালো পাথর রয়েছে, তার আকার মোরগের মতো, যার ফলে চিকোং পাহাড়কে মোরগ পাহাড়ের নামকরন হয়েছে। এ পাহাড়ের উপর মেঘ মেলা রয়েছে, দক্ষিণ চীন ও উত্তর চীনের গাছগাছড়া সবই এ পাহাড়ে দেখা যায়। পেইচিং থেকে আসা পর্যটক মাদাম চাং সবেমাত্র চিকোং পাহাড় ভ্রমণ করেছেন। তিনি বলেন, হীমেল বাতাসের মধ্যে মিষ্টি ঝরনার পানি পান করা সত্যি আরামদায়ক ব্যাপার। তিনি বলেন, 'অনেক আগে থেকে শুনেছি, সিনইয়াং শহরের চিকোং পাহাড় হচ্ছে চীনের এক অতি নামকরা দর্শনীয় স্থান। এবার এসে আমি দেখছি, এখানের দৃশ্য খুবই সুন্দর। বোধ হয় চিকোং পাহাড়ের তাপমাত্রা শহরাঞ্চলের চেয়ে অনেক কম। আমি মনে করি, চিকোং পাহাড়ের শৃঙ্গ সবচেয়ে সুন্দর। সেটি দেখতে মোরগের মাথার মতো। পাহাড়ে একটি জলপ্রপাত আছে। জানা গেছে, জলপ্রজাতের পানি হচ্ছে ঝরনার পানি। আমরা একটু খেয়েছি, সত্যি খুব মিষ্টি। তা খেয়ে খুব ভালো লাগছে।'
সিনইয়াং যে শুধু পাহাড় সংলগ্ন তা নয়, বরং পানির সঙ্গেও এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। চীনের বিখ্যাত জলসেচ দর্শনীয় স্থান 'মধ্য চীনের প্রথম হ্রদ' নামে সুপরিচিত নানওয়ান হ্রদ সিনইয়াং শহরে অবস্থিত। নানওয়ান হ্রদের আয়তন ৪৪৩ বর্গকিলোমিটার, এর আকার হাংচৌ'র সিহু হ্রদের চেয়ে ১২ গুণ বড়। নানওয়ান হ্রদের মধ্যে ৬১টি ক্ষুদ্র দ্বীপ আছে। এ ক্ষুদ্র দ্বীপগুলো এক একটি মুক্তার মতো হ্রদে অবস্থিত।
চাংচৌ থেকে আসা পর্যটক হাও নানওয়ান হ্রদে অনেক বার এসেছেন। তিনি বলেন, 'আমি গতকাল এসেছি। এর আগেও অনেক বার নানওয়ান হ্রদে এসেছিলাম। খুব ভাল লাগে। আমি পাহাড় ও নদনদী পছন্দ করি। প্রকৃতিতে থাকা আমার খুব ভালো লাগে।'
নানওয়ান দ্বীপে সুন্দর বন আছে। এখানকার দৃশ্য বিদেশী পর্যটকদেরও আকর্ষণ করে। চেক প্রজাতন্ত্রের পর্যটক ইরি শ্রিটিব্রান্ট বলেন, 'আমি চীনে প্রায় চার বছর আছি। এই প্রথম বারের মতো হোনান প্রদেশের সিনইয়াং শহরে এসেছি। নানওয়ান হ্রদ হচ্ছে সিনইয়াং'র নামকরা দর্শনীয় স্থান। এখানে আসলে খুব ভালো লাগে। কারণ আমার আসল বাড়িও একটি ছোট্ট নগরে। ফলে এমন প্রাকৃতিক পরিবেশে এসে নিজের বাড়িতে ফিরে আসার মতো আরাম বোধ করি। আমি মনে করি, এখানকার পরিবেশ খুব সুন্দর, বায়ুও নির্মল, আমার বাসার মতো। যদি সুযোগ পাই আমি আবার আসবো।'
এখন ভ্রমণের অর্থ দর্শনীয় স্থান উপভোগ করার পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের সুস্বাদু খাবার খাওয়ারও একটি বিশেষ অংশ। হুইহো নদীর সভ্যতার দোলনা হিসেবে সিনইয়াংয়ের ঐতিহাসিক সংস্কৃতির বিশেষ বৈশিষ্ট ও রীতিনীতি আছে। এখানকার খাবার সংস্কৃতিও অনন্য। সিনইয়াং শহরের আটটি জেলা ও দুটি অঞ্চলের প্রতিটি এলাকায়ই নিজের বৈশিষ্টপূর্ণ খাবার আছে। বহু বছর ধরে সিনইয়াং খাবার বিষয়ক গবেষক গুও ছুন শুন বলেন, 'সিনইয়াং খাবারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সয্ত্ন উপাদান বাছাই করে সুন্দর করে কেটে, সিদ্ধ করে খাবারের মূল স্বাদ বের করা।'
বন্ধুরা, চিকোং পাহাড় ও নানওয়ান হ্রদের সৌন্দর্য উপভোগ, মাওচিয়ান চা ও সিনইয়াং খাবারের সুগন্ধ পাওয়ার পর আপনাদের সিনইয়াংয়ে যাওয়ার কৌতুহল জেগে উঠেছে কি? আসলে সিনইয়াংয়ে আরো অনেক দেখার বিষয় আছে। যদি সুযোগ পান, আপনারা অবশ্যই একবার সিনইয়াংয়ে যাবেন। (ইয়ু কুয়াং ইউয়ে)
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved. 16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040 |