|
থিয়েন চিন রেল স্টশনের সামনে লেখক
পেইচিং-এ এসেছি প্রায় চার বছর হতে চললো। আসার পর থেকেই ভাবছি এত কাছের ঐতিহাসিক বন্দর নগরী এই থিয়েনচিন। চীনের অনেক জায়গায় অর্থাত্ উত্তর, দক্ষিণ আর পূর্বাঞ্চলীয় বেশ কয়েকটি প্রদেশ ও অঞ্চল ঘুরে ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু কাছের এ শহরটিতে কেন জানি যাওয়া হয় নি। অনেকবার উদ্যোগ নিয়েও বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছি। কথায় আছে না, গায়ের যোগী ভিখ পায় না। ওখানে বাংলাদেশের ছাত্র ও ভারতের একজন ব্যবসায়ী আছেন। যাওয়ার জন্য তারা আমাকে অনেক তাগাদা দিয়েছেন। বন্ধুরা, একেই বলে কপালের লিখন। যখন আমি যাচ্ছি ঠিক সেই সময়টাতেই তারা একজনও নেই থিয়েনচিনে। যে যার দেশে ছুটিতে চলে গেছে।থিয়েন চিন রেল স্টেশনের সামনে সচ্চল ঘড়ির ভাস্কর্য
আমার কর্মস্হল চীন আন্তর্জাতিক বেতারের ১২ তলার দক্ষিণ পশ্চিমে বিশাল একটি অংশে মুখোমুখি বাংলা ও হিন্দি বিভাগ। আসলে এই হিন্দি বিভাগের নতুন আগত তরুণ বিশেষজ্ঞ অনিল আযাদ পান্ডের ঐকান্তিক আগ্রহ আর তার চাপেই শেষ পর্যন্ত বসন্ত উত্সবের ছুটিতে আমাদের থিয়েনচিয়েন যাত্রা। ইচ্ছে ছিল দু'দিন ঘুরে বেড়ানোর। যদিও খুব কাছের শহর তারপরও বেশ ঘটা করেই প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল। রাতেই আমার ভ্রমণের নিত্যদিনের সংগী ক্যামেরা ও তার সাথে কয়েকটা মেমোরি কার্ড, আলাদা লেন্স, ফুল চার্জ করা ব্যটারি ও ট্রাইপডসহ প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র সি আর আই'র ব্যাগ প্যাকে ঠিকঠাক করে রেখে দিয়েছিলাম। চীনে সফরকালে একটা জিনিস না বহন করলেও চলে। আর তা হলো পানি। কারণ, যেখানেই যাই না কেন, পানিতো পাবোই তার সাথে লাল বলুন আর সবুজ বলুন হরেক রকমের ও পছন্দমত বিভিন্ন স্বাদের চাসহ ফলের রসতো রয়েছেই। তেষ্টা মেটানোর এমন সুযোগ অনেক দেশেই ভ্রমণকালিন খুব কম পাওয়া যায়। তারপরও অষুধ আর পানিও এক বোতল নিয়ে যাই সংগে করে। এটা আমার চিরায়ত অভ্যাস।
থিয়েন চিনের সংস্কৃতি সড়ক
সকাল সাতটার দিকে আমরা সাবওয়ের একনম্বর লাইনে সিদান গিয়ে লাইন পরিবর্তন করে চার নম্বর লাইনে উঠে পড়লাম। নতুন এ পেইচিং দক্ষিণ রেল স্টেশনে এর আগে আমি আর আসি নি। সাবওয়ে থেকে নেমে আমরা দ্রুত পাঁচ কি ছ' মিনিট পাতাল সুরঙ্গ আর ঝকঝকে তকতকে সিঁড়ি বেয়ে স্টেশন ভবনে ঢুকে পড়লাম। ঢুকেই আমরা বিষ্ময়ে আভিভূত হয়ে গেলাম। বিশাল বড় একটি স্টেশন। এতটাই আধুনিক ডিজাইন আর প্রযুক্তিতে তৈরি করা হয়েছে যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। আমার তরুণ সংগী অনিল বলেই ফেললো, এতো দেখতে ঠিক আধুনিক বিমান বন্দরের চেয়েও সুন্দর। সে বললো, রেল স্টেশনতো দূরের কথা, ভারতে এত সুন্দর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন একটি বিমান বন্দর আছে বলে আমার সন্দেহ রয়েছে। আর আমার অনুভূতি, আমাদের দেশে এর মত দূরে থাক এর দশ ভাগের একভাগের সমান সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন বিমান বন্দরই নেই। আমাদের বিমান বন্দরেও দেখা যায় দেয়ালে আর মেঝেতে এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট। অর্থাত্ কি না পানের পিকের সাথে সাদা চুনের কারুকার্য। এ ছাড়া ম্যাচের কাঠি, ছাই, খাবারের উচ্ছিস্টে দারুণ ইনস্টলেশন আর্ট ওয়ার্ক। অনিল হাসলো আর বললো আমাদের দেশেও কম যায় না। সত্যি কথা বলতে গেলে একটা জাতিকে এমন উন্নত পরিবেশ সৃষ্টির জন্য তার আচার, আচরণ ও স্বভাবকে সুন্দরের পরিমিতি বোধের মধ্যে রাখতে হয়। এ জন্য প্রথম দিকে কঠোর আইনী শাসন আর তার সঠিক প্রয়োগের দিকটাও কিন্তু একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়।
দ্রুতগামী বুলেট ট্রেনের পাশে হিন্দি বিভাগের অনিল আযাদ পান্ডে
একদম নতুন দু'জনেই। কোথায় টিকিট কাটবো, জানি না। বিমানের মত স্পিকার ভেসে আসছে কোন ট্রেন কত নম্বর প্লাটফর্ম থেকে ছাড়বে আর কত নম্বর গেট দিয়ে ঢুকতে হবে। বেশ কয়েকটি টিকিট কাউন্টার আর অনেকগুলো গেট। ঢুকতেও হবে মেশিনের মধ্যে টিকিট প্রবেশ করিয়ে দিয়ে। গেট পার হলেই আবার টিকিটটি আমার হাতে আসবে। সবচেয়ে ভালো লাগলো যে, স্টেশনে তথ্য কেন্দ্র রয়েছে। আমরা সেখানে জিজ্ঞেস করতেই একটি তরুণী ভাংগ ভাংগা ইংরেজীতে টিকিট কাউন্টার দেখিয়ে দিল আর বললো এখুনি একটি ট্রেন থিয়েনচিনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাচ্ছে। আমরা অতি দ্রুততার সংগে পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগামী ট্রেনের টিকিট নিয়ে নিলাম। টিকিট কাউন্টারের মেয়েটি আমাদের ইশারায় গেটটিও দেখিয়ে দিল। বলতে গেলে অনেকটা দৌঁড়ে নিচে নেমে ট্রেন ধরতে সক্ষম হলাম ঠিক শেষ মূহুর্তে। কারণ, আমরা উঠে বসার সংগে সংগেই চলতে শুরু করলো। যে ট্রেনে আমরা যাচ্ছি তার ভেতরে বসার ব্যবস্হা সত্যিই বিমানের চেয়েও সুন্দর ও আরামদায়ক। রকেট গতির এ ট্রেনে বসে আপনি যদি চোখ বন্ধ করে রাখেন তাহলে কখন যে ট্রেন ছেড়ে চলে গেছে তা টেরই পাওয়া যাবে না। এমন কি বাইরের দিকে না তাকালে মনে হবে না যে ট্রেনটি রকেট গতিতে চলছে । থিয়েনচিন যেতে আমাদের মাত্র আধা ঘন্টা লাগলো। যেখান আগে যেতে দু'ঘন্টারও বেশি সময় লাগতো। সিটে বসেই দেখলাম প্রতিটি কক্ষের সামনে টপ স্ক্রিনে ভেসে উঠছে ট্রেনের গতিবেগ, আদ্রতা, কক্ষের ও বাইরের তাপমাত্রা। যাবার সময় ট্রেনটি সর্বোচ্চ ৩৪১ কিলোমিটার এবং আসার সময় সর্বোচ্চ ৩৫৭ কিলোমিটার গতিতে চলছিল। লক্ষণীয় বিষয় হলো ট্রেনটি ছাড়ার এক বা দেড় মিনিটের মধ্যেই শতাধিক কিলোমিটার গতি উঠে যায়। বিমানের এয়ার হোস্টের মত ট্রেনের হোস্টেসরাও যাত্রীদের দেখা শুনা করতে ব্যস্ত দেখলাম। সকাল প্রায় সোয়া দশটার দিকে আমরা দু'জন থিয়েনচিন স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। (চলবে)
--আ. বা. ম. ছালাউদ্দিন
![]() |
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved. 16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040 |