|
আসলে থিয়েনচিন একটি সমতল এলাকা যা হাইহাকে ঘীরে গড়ে উঠেছে। এ এলাকাটি সাগর পৃষ্ঠ থেকে মাত্র আড়াই মিটার উঁচুতে। এর আবহাওয়া সাধারণত শীত প্রধান। তাপমাত্রা গড়পরতা ১২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং জানুয়ারি মাসে নেমে এসে তা দাঁড়ায় হয়তো সর্বনিম্ন -২ ডিগ্রিতে। কম বেশিও কিছুটা হতে পারে। বন্দর এলাকায় এ সময় সাগরের পানি পাথরের মত শক্ত বরফে পরিণত হয়ে যায়। যা প্রায় ৮০ থেকে ৯০ দিন পর্যন্ত স্হায়ী হয়ে থাকে। প্রতি বছর গড়ে এখানে ৫৫৯.১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। গ্রীষ্মকালেই এখানে বৃষ্টিপাত হয়।
স্বতন্ত্র পৌর নগরী থিয়েনচিনের লোকসংখ্যা ২০০৬ সালের আদম শুমারী অনুযায়ী ১ কোটি ১০ লাখেরও বেশি। দ্বাদশ শতকের দিকে যাযাবর বা জাতিগত ডাইনাস্টির সময়কালেই প্রথম থিয়েনচিন দক্ষিণাঞ্চলের কৃষিজাত পণ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের সংগ্রহ, সরবরাহ ও বিক্রির সারাদেশের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল। ১৮৫৬ সালের দিকে ব্রিটিশ ও ফরাসী নৌ সেনারা প্রথম এ অঞ্চলে ব্যবসার জন্য হানা দেয়। এসময় চীনারা জলদস্যুদের মোকাবিলার জন্য তত্পর থাকার সময় ব্রিটিশ ও ফরাসী সেনারা সহায়তার কথা বলে ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং এসব সেনারা সুচতুরতার সংগে চীনাদের সংগে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। পরবর্তি সময় ১৮৫৮ সালে তারা চীনাদের পরাজিত করে তাদের সংগে থিয়েনচিয়েন শাসন চুক্তি করতে বাধ্য করেছিল। তত্কালিন সময় এসব বিদেশিরা তাংগুওতে (Tanggu) নতুনভাবে বন্দর নির্মাণ করে বাণিজ্যের ছদ্মবেশে এ অঞ্চল দিয়ে আফিম সারা চীনে বিক্রির মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়, যাতে মেধাবী, পরিশ্রমি ও শক্তিশালী চীনাদের নেশায় আচ্ছন্ন করে নিজেদের বসে রাখতে পারে। যদিও চেয়ারম্যান মাও সে তুং-এর উত্থান তাদের সে স্বপ্নকে ধুলিস্মাত করে দিয়েছিল।
বন্ধুরা, বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই থিয়েনচিন একটি পরিপূর্ণ ও আন্তর্জাতিক নগরী হিসেবে গড়ে উঠতে শুরু করে । এখনো তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত গতিতে চলছে। বিংশ শতাব্দির শুরুর দিকেই হারবার্ট হ্যানোভার ও সান ইয়াত সেন থিয়েনচিনে এসেছিলেন। ১৯৭৬ সালের থাংশান ভূমিকম্পের ফলে থিয়েনচিন নগরীর ব্যাপক ক্ষতি হয়। এর ধকল কাটিয়ে উঠে একে পুননির্মাণ করতে অনেক সময় লেগে যায়। থিয়েনচিনকে নতুনভাবে গড়ে তোলার সময় চীনের স্ববৈশিস্টকে রক্ষার জন্য সকল বিদেশিদের থিয়েনচিন ভ্রমণ বন্ধ রাখা হয়েছিল। নির্মাণের পর অবশ্য বিদেশিদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।
কেন্দ্রশাসিত থিয়েনচিনের ১৫টি জেলা রয়েছে। এর মধ্যে ৬টি জেলাকে নিয়ে মূল শহর অর্থাত্ সিটি এলাকা গড়ে উঠেছে। এছাড়া বাকী ৯টি জেলা শহরকে উপকন্ঠের শহর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইদানিং এসব জেলাও ধীরে ধীরে আধুনিক শহরে রূপান্তরিত হতে শুরু করেছে। আমাদের দেশের সংগে তুলনা করলে এ ৯টি শহরও আমাদের ঢাকা ও চট্টগ্রামকে বাদ দিলে অন্যান্য শহরের চেয়ে উন্নত। থিয়েনচিনের ১৫টি জেলাতেই রয়েছে অসংখ্য হোটেল, পার্ক, দর্শনীয় প্রাচীন নিদর্শন। তবে শহরের কেন্দ্রস্হলের হোটেলগুলো আধুনিক মানের। এতে রয়েছে আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ সুবিধা। থিয়েনচিনের কেন্দ্রস্হলের ৬টি জেলা হলো: হাতুং জেলা (Hedong District), হ্যাপেই জেলা (Hdbei District), হাফিং জেলা (Hepeng District), নানখাই জেলা (Nankai District), হাশি জেলা (Hexi District) এবং হুংছিয়াও জেলা (Hongqiao District)।
আমরা যেসব জায়গায় যাবো প্রাচীন সংস্কৃতি সড়ক হলো একটি। এ সড়কটি হ্যাপেই জেলার কেন্দ্রে অবস্হিত। সংস্কৃতি যাবার আগেই একটু দূর থেকে দেখতে পেলাম চৌরাস্তার পাশেই হরেক রংয়ের দোকানের সমাহার। মনে হলো বেশ ভীড়। লোকে লোকারণ্য। আমাদের তিন চাক্কার চালকটি বেশ কোঅপারেটিভ। আমাদেরকে পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি আমাদের নিয়ে দেখিয়ে দিল এখান থেকে কীভাবে অর্থাত্ কোন জায়গা থেকে বেরিয়ে কোন গাড়িতে পরবর্তি দর্শনীয় স্হান মন্দিরে যাবো। সত্যিই সাধুবাদ জানাই সেই নাম না জানা চালকটিকে। আসলে সংস্কৃতি সড়কটি হচ্ছে কয়েকটি সড়কের সংযোগের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা প্রাচীনকালের ঐতিহ্যকে ধারণ করা একটি চোখ ধাধানো বিপণী কেন্দ্র। এখানকার স্হাপত্যকলা ছিং ডাইন্যাস্টির আমলের নকশায় তৈরি এবং তা থিয়েনচিনের নিজস্ব স্টাইলে সাজানো। প্রায় সবক'টি সড়ক ও বিপণী কেন্দ্র প্রাচীনকালের বাঁকা ইট দিয়ে তৈরি এবং জল রংয়ের চিত্রের সমাহারে আবৃত। ঐতিহাসিক থেকে শুরু করে একালের সব হস্ত শিল্প, এ্যান্টিক্স পণ্য, ক্যালিগ্রাফি ও ক্যালিগ্রাফির হাজারো রকম তুলি, ঘূড়ি, শিআনের সেই অবিকল নকল টেরাকোটা সৈন্য, ছোট ও বড় কাঠের ভাষ্কর্য, এমন কি প্রাচীনকালের বর্ণিল কাপড় চোপড়, পুতুল ও খেলনাসহ মন ভোলানো সব পণ্য। সপ্তাহের প্রতিটি দিনই এখানে শিশু, কিশোর, বুড়ো বুড়িদের সবার জমজমাট ঘুরে বেড়ানো আর কেনাকাটা। প্রতিটি সড়কের দু'পাশের দোকান পাট রঙিন ফিতেয় সংযোগ করে তাতে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে আমাদের ছোট বেলায় বিয়ে বা যে কোন উত্সবে নিজের হাতে লম্বা দড়িতে লাগিয়ে তৈরি করে লাগানো ত্রিকোণাকৃতির রং বেরং-এর পতাকার মাঝে লাল রংয়ের বড় বড় ঐতিহ্যবাহি লন্ঠন। এখানে প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত কত প্রকারের যে ঘূড়ি রয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না। এক একটা এক এক রকমের ডিজাইনে তৈরি। প্রাচীনকালের ঘূড়িগুলো বেশ অদ্ভুত। এসব ঘূড়ির কোনটা সারস, বক, চীল, পেঁচা বা পুচ্ছযুক্ত ময়ুর। আবার কোনটা বিশালাকারের ড্রাগন, মনে হয় যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে খপ করে ধরার অপেক্ষায়। কোনটা আবার সাপ, ব্যাং, বাদর এমনকি হরিণ ও বাঘের ঘূড়ি। এছাড়াও রয়েছে অসংখ্য আকৃতির নানান ফুলের ঘূড়ি। এসব ঘূড়িগুলো কারিগরি প্রযুক্তিতে তৈরি। এদের কোনটাই আমাদের দেশের সাবেকি আমলের ঘূড়ির মত হালকা পাতলা সাধারণ ঘূড়ি নয়। দেখলাম প্রাচীন এসব ঘূড়ি ওড়ানোর আধুনিক সরন্জাম। না দেখলে বিশ্বাসই হবে না যে এসব ঘূড়ির কোন কোনটা ওড়াতে মোটা মোটা দড়ির প্রয়োজন হয়। এসব ঘূড়ি যখন আকাশে ওড়ে তখন পুরো আকাশটাই রংয়ে রংয়ে রঙিন হয়ে যায়। দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, হাজার হাজার বছর আগের রাজ রাজারা কতটা আমুদে আর আনন্দ প্রিয় ছিল। সংস্কৃতি সড়কের এসব ঘূড়ি দেখে মনে পড়ে গেল ইতিহাসের কথা। খ্রিস্ট পূর্ব ২৩৮ সালে প্রথম ঘূড়ি আবিস্কৃত হয়েছিল। এ আবিস্কারের পেছনে কাজ করেছিল নৌকার পাল, যা বাতাসে ভর করে একটি নৌকাকে টেনে নিয়ে যায় তার গন্তব্য স্হানে। প্রথম যিনি ঘূড়ি আবিস্কার করেছিলেন তিনি হলেন চীনের মো চি। তার আবিস্কারের পথ ধরেই আজকের এই সংস্কৃতি সড়কের বর্ণিল ঘূড়ি।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা দেখছি আর নিজেকে সমৃদ্ধ করছি অভিজ্ঞতার আলোকে। একটা জিনিস দেখে অবাক হইনি তবে মনে হয়েছিল যে চীনা জাতি একটি পাঠকের জাতি। আগে থেকেই জানি ইউরোপিয়রা বই পড়ার পোকা। যেখানেই যাক না কেন হাতে একটা ছাতা আর একটা বই থাকবেই। চীনের সব অঞ্চলের কথা বলতে পারবো না; তবে যে সব অঞ্চল ঘুড়েছি সব খানেই দেখেছি বাসে, ট্রেনে, দোকানে এমনকি শহরের উপকন্ঠের ফুটপাতের সাইকেল মেকানিক, ফল বিক্রেতা, ফেরিওয়ালা আর কাঁচা বাজারের দোকানদারকে একটু অবসর পেলেই বই বা পত্রিকা পড়তে। অনেক ছবিও তুলেছি এর ওপর। এখানে এ সংস্কৃতি সড়কেও রয়েছে ছোট ছোট দোকান ও ফুটপাতে পলিথিনের ওপর ছড়িয়ে রেখে বই বিক্রির আয়োজন। পেইচিংয়ের মত এখানেও দেখলাম বই কেনার জন্য শিশু, বুড়োসহ অনেক মানুষের ভীড়। ভালোই লাগলো। কিছু কিছু খাবারের দোকানও আছে। খিদে পেলে বা ইচ্ছে হলে সংগে সংগে কিছু খেয়ে নেয়া যায়। সব সময়ই যেন উত্সব উত্সব ভাব লেগে আছে। সে এক দারুণ আনন্দ। সংস্কৃতি সড়কের আশে পাশেই রয়েছে বিভিন্ন ডাইন্যাস্টির সময় নির্মিত প্রাচীন নিদর্শনসমূহ। এর মধ্যে রয়েছে, থিয়ানহউকুং মন্দির, রাণীর স্বর্গীয় মন্দির যা ইউয়ান ডাইনাস্টির (১২৭৯ থেকে ১২৬৮) সময়কালে এবং মিং ডাইন্যাস্টির সময় ১২৭৯ থেকে ১৩৬৮ সালের মধ্যে নির্মিত কনফুসিয়াস মন্দির। এসব দর্শনীয় স্হানগুলো আমরা খুব দ্রুত দেখতে পারবো বলে আমরা দু'জন আশাবাদী হয়ে উঠলাম।
এখন অসংখ্য বিদেশি নাগরিক থিয়েনচিনের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও তার সৌন্দর্যকে উপভোগের জন্য যাতায়াত করছে। এখন আমিও এই থিয়েনচিনের সড়কে বুক ভরা তৃপ্তির নি:শ্বাস নিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছি আগ্রহের আতিসয্যে তার বুক জুড়ে থাকা কীর্তিসমূহ দর্শনের আশায়। (চলবে) --আ. বা. ম. ছালাউদ্দিন
![]() |
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved. 16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040 |