Web bengali.cri.cn   
ফাংশানের 'ইউন জু' মন্দিরে একদিন – শেষ
  2010-03-25 20:36:47  cri

মন্দির দেখার ভেতর দিয়ে চীনের ইতিহাসকে দেখা আর জানার একটা সুযোগকে আমি সব সময়ই অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি । কারণ, এর মাধ্যমেই আমি আমার চিন্তা চেতনার অনুভূতিকে শানিত করতে পারি । অর্থাত্ কি না নিজের ভূবনে নিজেকে বিশ্লেষণের চর্চা করতে পারি । পাহাড়ের ঢালে আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজেকে অনেকটা হাল্কা করে নিই । এখনো চতুর্থ আর পঞ্চম ধাপ ঘোরার বাকী । উঠে পড়লাম আড়মোড়া ভেঙ্গে ।

চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপে দ্রুত ঘুরে ঘুরে দেখলাম। তার কারণ হাতে সময় খুব কম । ইতোমধ্যেই আমি তিনটি ধাপ ঘুরে বেড়াতে গিয়ে অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছি । আমাকে এখান থেকে চারটার আগেই বেরিয়ে পড়তে হবে । তা না হলে এখান থেকে বাস ধরে যেতে হবে ইউনচু স্টেশনে, তারপর সেখান থেকে বাস ধরে যেতে হব পেইচিং । আনকোরা নতুন মানুষ আমি। তারপর কখন বাস ছাড়বে এখান থেকে তাও জানি না । আসার পথে দু'একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাতে তাদের কথাবার্তায় মনে হলো এখান থেকে সর্বশেষ বাস হয়তো পাঁচটার দিকে ছেড়ে যাবে। একটা টেনসন তাই সবসময় ভেতরে কাজ করছে। পরবর্তি দু'টো ধাপই একই ধাচের। অর্থাত্ একই স্টাইলে তৈরি হয়েছে। এ ধাপে দেখলাম দক্ষিণ পশ্চিম দিকে ঐতিহ্যবাহী চায়ের ঘর। মন্দির নির্মাণের পর থেকেই এখানে সেই আমলে বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং মন্দিরের ছাত্রছাত্রীরা অবসরে বিশ্রাম নেয়ার সময় সবুজ চা খেতেন। এ ঘরটি বেশ লম্বা এবং এর উপরে ছাউনি দেয়া। আসলে একে ঘর বলা যায় না । এটি দেখতে ঠিক করিডোরের মত । পাশেই রয়েছে মূলি বাঁশের বাগান। পাহাড়ের ঢালের এ বাগানটি দেখে মায়া হলো। তার কারণ, এতে এখন কোন পাতা নেই। নেই গায়ের নুন্যতম সবুজ ভাবটিও। কিছুটা হরিদ্রাভ দেখাচ্ছে। আর মনে হচ্ছে সব গাছ মরে যেন উদোম শরীরে দাঁড়িয়ে আছে একটার গায়ে একটা ঠেস দিয়ে । বাঁশ বাগানের ভেতরের দিকে ছাতার মত ছাউনির নিচে কাঠের টেবিল চেয়ার সাজানো। এখানে বৌদ্ধ ভিক্ষু আর শিক্ষকরা বসতেন। করিডোরে বসতো শিক্ষার্থীরা। এখানে তারা চা পান করতেন কর্মক্লান্তি দূর করার জন্য। মন্দিরে থাকা খাওয়া, চিকিত্সা ও শরীর চর্চাসহ সব ব্যবস্হাই ছিল।

মন্দিরের দক্ষিণ দিকে রয়েছে একটি এবং উত্তর দিকে রয়েছে চারটি টাওয়ার যাকে বলা হয় স্তুপ বা প্যাগোডা। এর মধ্যে অস্টভূজাকৃতির দু'টি টাওয়ার লিয়াও ডাইনাস্টির সময় ৯১৬ থেকে ১১২৫ সালে তৈরি করা হয়। জাপান বিরোধী যুদ্ধের সময় পুরো মন্দিরটি ধ্বংস হলেও উত্তর দিকের সুউচ্চ স্তুপটিসহ থাং ডাইন্যাস্টির সময় ৬১৮ থেকে ৯০৭ সালে নির্মিত বাকী চারটি স্তুপই অক্ষত অবস্হায় ছিল। উত্তর দিকের টাওয়ার বা স্তুপটির উচ্চতা ৯৮.৪২ ফুট। একে বলা হয় আরহাত প্যাগোডামূলত এর নির্মাণ কাজ লিয়াও ডাইন্যাস্টির থিয়ানছিং শাসনামলে ১১১১ সালে শুরু হয়ে ১১২০ সালে শেষ হয়। এ স্তুপটির তিনটি ভিন্ন ভিন্ন স্হাপত্য শৈলী রয়েছে। যা দেখতে খুবই সুন্দর। স্তুপটির সবচেয়ে নিচের অংশের দিকটি দোতলা পর্যন্ত ইটের তৈরি এবং অস্টভূজাকৃতির ও বুদ্ধের নানা ভঙ্গীর শিল্পকর্মে সজ্জিত। চারটি স্তুপই সাত স্তরে বর্গাকৃতি আকারে নির্মিত। এ প্যাগোডাগুলোর মধ্যে থাং ডাইনাষ্টির সময় ৭২৭ সালে খাইইউয়ান সাম্রাজ্যের ১৫তম বছরে নির্মিত পাথরের প্যাগোডাটিতে তখন একজন বিদেশির দেয়া দৃষ্টি নন্দন টানা গভীর চোখ আর সুউচ্চ নাক সম্বলিত গৌতম বুদ্ধের প্রতিকৃতি খোদাই করা রয়েছে। এ প্রতিকৃতির সুক্ষ্ম কাজ দেখে মনে হয় জমজমাট থাং ডাইনাস্টির সময় বিদেশের সংগে যোগাযোগ ও বিনিময়ের ক্ষেত্রে সুসম্পর্ক ছিল। এ স্তুপগুলো ঘীরে রয়েছে চলাচলের জন্য পাথরের তৈরি রাস্তা। স্তুপের ডান দিকে রয়েছে বেশ কয়েকটি সমাধিস্হল। প্রত্যেকটিতেই রয়েছে পাথরে খোদাই করা কারুকার্যময় বুদ্ধের বিভিন্ন প্রতিকৃতি আর ত্রিপিটকের বাণী। চীনা ভাষা জানা পূণ্যার্থীদের হৃদয়কে তা যেন আন্দোলিত করে। দেখলাম অনেকেই তা গভীর মনোযোগ সহকারে নিবিস্ট মনে পড়ছেন। আবার কেউ কেউ পড়ার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ তা পরম মমতায় আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছেন শান্তির অন্বেষায়।

এছাড়াও পাশের শিচিং পাহাড়ে রয়েছে ত্রিপিটক খোদাই করা ৯টি সমৃদ্ধ গুহা। যেখানে রয়েছে ৫১১ থেকে ৯০৭ সালে সুই ও থাং ডাইনাস্টি এবং ১৩৬৮ থেকে ১৬৪৪ সালে মিং ডাইনাস্টির সময় এসব গুহার ভেতরে পৃথক পৃথকভাবে পাথরে খোদাই করা ৪,১৯৫টি ত্রিপিটকের বাণী। এসব গুহার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো লেইইন গুহা । এ গুহাটি মূল চারটি পাথরের স্তম্ভের ওপর হলেও এতে রয়েছে এক হাজার পাথরের কলাম। একে বলা হয় হাজার স্তম্ভের বুদ্ধ। এসব স্তম্ভের মধ্যে রয়েছ সুই ডাইনাস্টির সময় ইউনচু মন্দির নির্মাণ যিনি শুরু করেছিলেন সেই বিখ্যাত ধর্মগুরু চিইংওয়ান-এর রয়েছে তাঁর নিজের হাতে খোদাই করা ১৪৬টি স্ক্রিপচার বা ত্রিপিটকের বাণী। যা খুব সুন্দর করে গুহার গায়ে লাগানো রয়েছে। এ নয়টি গুহা ছাড়াও ১৯৫৬ সালে দক্ষিণ দিকের প্যাগোডাটির ভেতর আবিষ্কার করা হয় আরেকটি গুহা। এ গুহাটির ভেতর খনন করে পাওয়া যায় ৩,৪০০ ভলিউমে পাথরে খোদাই করা ১০,০৮২টি স্ক্রিপচার বা পান্ডুলিপি। এটি আবিস্কারের পর এটিই হলো চীনে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত পাথরে খোদাইকৃত সংরক্ষিত স্ক্রিপচার বা সুত্রা'র সবচেয়ে বৃহত্তম গুহা। আসলে ইউনচু মন্দিরের আশেপাশে ঘিরে রয়েছে লিয়াও ডাইনাস্টির সময়কালীন অসংখ্য সাংস্কৃতিক পুরাকীর্তি। ফেংশান শহরটিই পুরাকীর্তি আর ঐতিহাসিক স্হাপনা সমৃদ্ধ শহর। এখনে এসে আমার নিজেকে মনে হলো এমন একটি জায়গায় না আসলে হয়তো আমার অনেক কিছুই দেখা হতো না।

দেখতে দেখতে সূর্যি মামা পাহাড়ের আড়ালে মুখ লুকাতে শুরু করেছে। আমি খুব দ্রুত পায়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে মন্দির থেকে নেমে এলাম। একদিকে ঠান্ডা। আরেক দিকে পিপাসা। নিচে নেমে এসে একবোতল ঠান্ডা জেসমিন চা কিনে পাহাড়ের গা ঘেষে বাস স্ট্যান্ডের দিকে হেঁটে চলে এলাম। বাস স্ট্যান্ডের চারপাশের বিস্তির্ণ এলাকায় বরফ হয়ে যাওয়া জলাধারের পাশে ঘুরে বেড়ালাম। হঠাত্ দেখলাম ৩১ নম্বর বাস আসছে। জানি এ বাসটিও ইউনচু ছি স্টেশন পর্যন্ত যাবে। দেরি না করে উঠে পড়লাম। বাসের ড্রাইভার ও দু'জন যাত্রী আমাকে যথেস্ট সাহায্য করলো। তারা আমাকে ইউনচু ছি'র অনেক আগেই একটা স্টেশনে নামিয়ে দিল। এ জায়গাটির নাম উয়োতাশিচানচাংফু। সেখানে নেমেই দেখি দারুণ মজার জায়গাতো ! সামনেই একটা বহুতল ডিপার্টমেন্ট স্টোর, রাস্তার ওপারে পুলিশ অফিস। আর পুরো এলাকা জুড়ে রয়েছে নানা রকম ভাষ্কর্যের ছড়া ছড়ি।

একটু ভেবে চিন্তে দেখলাম এখান থেকে সর্বশেষ বাস যেতে আরো ঘন্টা দু'য়েক বাকী আছে। আমি হাঁটতে শুরু করলাম রাস্তার পাশে থাকা ভাষ্কর্য তৈরির দোকানগুলোর সামনে দিয়ে। মহাসড়কের দু'পাশ জুড়ে ছোট ছোট টিলার মত অসংখ্য পাথর খন্ড রয়েছে। সেগুলো কেটে কেটে এসব ভাষ্কর্য শিল্পীরা নির্মাণ করছে মনের মত করে বিভিন্ন পশু, পাখি, ফুল ও মানুষসহ অনেক কিছু। কোনটা ছোট আবার কোনটা বিশাল আকারের। এতটাই নিখুঁত যে মনে হয় মেশিন দিয়ে তৈরি করা। এ ভাষ্কর্য বাগানে ঘুরে ঘুরে মন ভরে গেল। ভাবলাম ১২ নম্বর বাসে আসলেতো এর কিছুই দেখা হতো না। মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম সেই যাত্রীটিকে যে আমায় এ বাসে আসতে সাহায্য করেছিল। অনেক ছবি তুললাম। আমার নিজেরও কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম।

ইতোমধ্যেই পশ্চিমের আকাশে মুখ লুকিয়েছে দিনমনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যার আবছায়া অন্ধকার ঘিরে ফেলবে সবকিছু। আমি বাস স্ট্যান্ডে ফিরে আসার একটু পরেই পেইচিং-র বাস পেলাম। অনেক কষ্টে ঠেলে ঠুলে উঠে পড়লাম বাসে। এত ভীড় যে কোনমতে দাঁড়িয়ে থাকলাম। সন্ধ্যার জোনাক জ্বলা আঁধারের হাতছানি নিয়ে এ পথের এ শেষ বাসটি ছুটে চললো রুদ্ধশ্বাসে। ফেংশান তোমায় সালাম। কথা দিলাম সময় পেলে আবার আসবো তোমার অপরূপ নিবিড় মায়াবী প্রকৃতির ছায়ায়।

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্যের পাতা
ভিডিও চিত্র
সাক্ষাত্কার
চিঠিপত্র
Play Stop
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040