Web bengali.cri.cn   
ফাংশানের 'ইউন জু' মন্দিরে একদিন-৩
  2010-03-18 21:10:50  cri
পাহাড়ের গা ঘেষে দু'পাশ থেকে খাড়া হয়ে উঠে যাওয়া সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার সময় দেখলাম মা বাবার সংগে আসা কয়েকটি শিশুও উচ্ছলতা নিয়ে একটা একটা করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে আর চীনা ভাষায় মা বাবাকে কীসব প্রশ্ন করছে। মনে হলো তারা যেন জানতে চাইছে এ মন্দির সম্পর্কে । দ্বিতীয় ধাপে উঠে মনে হলো যেন প্রথম ধাপের চেয়ে একটু ব্যতিক্রম। সবই ঠিক আছে শুধু ডান পাশের খোলা স্হানটি নেই। মাঝখানে থাকা প্রার্থনার আগরবাতি পাত্রে লম্বা লম্বা আগরবাতি জ্বালিয়ে পরম ভক্তি ভরে বেশ কয়েকজন নারী ও পুরুষ প্রার্থনায় নিমগ্ন রয়েছে। মন্দিরের ডানপাশের ঘরটির বারান্দায় দু'তিনটি মেয়ে ত্রিপাটক পাঠ করছে আনমনে। সামনেই বসে রয়েছেন একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু। ভীড়ের মাঝে আমি ছবি তুলছি আর হাঁটছি। দেখছি একটা দেশ যেখানে ধর্মীয় স্বাধীনতাও কতটা উন্মুক্ত আমি যা করবো তা আমার ইচ্ছের ওপরই নির্ভর করছে। মন্দিরে যারা আসছে তারা কেউ কেউ ইতিহাস ঐতিহ্যকে জানার জন্য আবার কেউবা ভক্তি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। সবারই ভেতর কাজ করছে এক পরম শান্তির ললিত ফল্গুধারা।

মন্দিরের প্রার্থনার স্থান

প্রথম ধাপের মতই এখানেও প্রবেশ তোরণ। তোরণের মধ্যস্হানে মহান বুদ্ধের বিরাট এক আবহ মূর্তি। বা পাশে ধর্মীয় সভার একটি বিশাল পেইন্টিং আর ডান পাশে রয়েছে নিরাপত্তা রক্ষির রঙিন মূর্তি। এ ধাপের ডান দিকে রয়েছে দু'টি ভবন। উত্তর পূর্ব দিকেরটি হলো বুদ্ধের আমলের দু'একটিসহ এটি নির্মাণকালীন সময় থেকে শুরু করে বিভিন্ন ডাইনাস্টির সময়কালের সাংস্কৃতিক পুরাকীর্তি প্রদর্শন ভবন।

উত্তর পশ্চিম দিকেরটি হলো রয়েছে প্রাচীনকালে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ব্যবহার্য থেকে শুরু করে শেষ রাজবংশ পর্যন্ত সময়কালের বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রদর্শনী ভবন। এ ভবনে ঢুকলে মনে হবে যেন আমরা বৌদ্ধ সংস্কৃতির অনুভূতিতে আলোড়িত হচ্ছি। খুব সুন্দর করে সাজানো রয়েছে নিরাপদ সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে।

এ চত্বরের দক্ষিণ পূর্ব পাশে যে ভবনটি রয়েছে তাতে প্রদর্শিত হচ্ছে প্রাচীনকালের ভারতীয় বুদ্ধ দেবের বেশ কিছু ব্রোন্জের দৃষ্টি নন্দন ভাষ্কর্য । এ ভবনে ৮০টি ব্রোন্জের তৈরি বুদ্ধ মূর্তি রয়েছে। ৭৫০ থেকে ১১৫০ সময়কালে পলা রাজত্ব এবং ছোলা ডাইনাস্টি ৮৪৬ থেকে ১২৭৯ সময়কালে এসব বুদ্ধ মূর্তি তৈরি ও সংগ্রহ করা হয় । এর মধ্যে চিং ও মিং ডাইনাস্টির সময়কালের ২৮টি বুদ্ধ মূর্তি রয়েছে। এসব মূর্তির বেশির ভাগই প্রাচীন ভারতীয় । এসব মূর্তির অনেকগুলোতেই চীন ভারতের সংস্কৃতির ছাপ রয়েছে । ঘরে ঢুকলেই চোখের সামনে পড়বে বুদ্ধের এক বিশাল ভাষ্কর্য। তার দু'পাশে রয়েছে অনেকগুলো ছোট ছো্ট ব্রোন্জের মূর্তি । ডান পাশে আর বা পাশে রয়েছে কাঁচের কাসকেটের ভেতর ধ্যানী বুদ্ধের সোনালী রংয়ের আকর্ষণীয় মূর্তি। এসব মূর্তি সোনার প্রলেপ দেয়া। বৈদ্যুতিক বাতির আলোয় তা যেন ঝল মল করছে। খুব অবাক হয়ে দেখলাম তীর্থানুরাগী মানুষগুলো খুব কাছে থেকে তা দেখছে। ঝুকে পড়ে দেখছে। কিন্তু কেউই তাকে স্পর্ষ করছে না। এটা সভ্যতার এক সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দেশে হলে হয়তো এক্ষেত্রে অন্যরকম দৃশ্য হতো। যে ধরণের নিরাপত্তা ব্যবস্হা দেখলাম তাতে আমাদের দেশে এটি এখানে দ্বিতীয় দিন থাকতো কি না তা বলা মুশকিল। পাহাড়ের ওপর আবার তার চারদিকেও পাহাড় আর ফসলের ক্ষেত । মন্দিরের কারণে এখানে হাতে গোনা কয়েকটি দোকান পাট রয়েছে বটে । কিন্তু সন্ধ্যার পর এ স্হানটি শুধু খাঁ খাঁ করে। নি:সীম অন্ধকারের কালো চাদরের গায়ে বয়ে যাওয়া নি:সঙ্গ বাতাসের সুরেলা গান ছড়িয়ে যায় এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত জুড়ে । অসীম আকাশের অসংখ্য তারার সাথে কিছু সৌর শক্তির বৈদ্যুতিক বাতি খেলা করে তার টিপ টিপ হালকা আলো আভায়।

গৌতম বুদ্ধের ভাষ্কর্য

আমি ধীর পায়ে ভবন থেকে বেরিয়ে এলাম প্রাঙ্গণে। এ ধাপের পশ্চিম পাশে পাহাড় ঘেসে রয়েছে শাক্যমুনি ভবন। এটিকে চীনা ভাষায় 'তা শিং পাও তিং' বলা হয়। পুণ্যার্থিরা ভেতরে ঢুকে গৌতম বুদ্ধের বিশাল মূর্তির সামনে করজোরে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা এবং প্রণাম করে তাদের শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। ভবনের ভেতরে দু'পাশে রয়েছে ভিক্ষু ও তীর্থযাত্রীদের জন্য অনেকগুলো প্রার্থনার আসন ।

চত্বরের দক্ষিণ পশ্চিম পাশের ভবনটিতে রয়েছে পাথরের গায়ে খোদাই করা ও ছাপ দেয়া সে আমলের বৌদ্ধ সুত্রা বা মন্ত্র । হাতের লেখাগুলো ক্যলিগ্রাফির মত । এত সুন্দর যে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভাবতে হয়। এখানে মন্দির নির্মানের পর মন্দিরের খ্যাতিমান ভিক্ষু 'চিং ওয়ান' এসব সুত্রা লিখেছিলেন। তার মৃত্যুর পর তার অনুসারী ছাত্রছাত্রিরা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে এসব সুত্রাগুলো ত্রিপিটক থেকে ক্যালিগ্রাফির মত করে লিপিবদ্ধ করেছিল। এ ভবনটির প্রবেশ দ্বারের সামনেই রয়েছে বুদ্ধের শরীরের অংশ বিশেষসহ পাথরের পুরাকীর্তি । সংস্কৃত ভাষায় একে বলা হয়, 'সাতিয়ার' আর চীনা ভাষায় 'শেলিলুয়ো' বা 'পাইলিলুয়ো'। যার অর্থ শরীরের যে কোন অঙ্গের অংশের পুরাকীর্তি বা Relics. গৌতম বুদ্ধের রেলিক্স আবার তিন প্রকারের । এর একটি হলো সাদা হাড়ের পুরাকীর্তি ( White bone relics), দ্বিতীয়টি হলো কালো চুলের পুরাকীর্তি ( Black hair relics) আর তৃতীয়টি হলো লাল মাংশের পুরাকীর্তি (Red flash relics) । ফাংশানের থিয়ানখাই টাওয়ার থেকে যে রেলিক্সটি পাওয়া গেছে তা হলো সাদা হাড়ের পুরাকীর্তি (White bone relics)। এটি সত্যিকারের অংগ এবং তা বুদ্ধের সময়কালীন পাথরের পুরাকীর্তি দিয়ে মঠের মত করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এ রেলিক্সটি সারা বিশ্বের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।

আমি এবারে পাহাড়ের আরো উপরে তৃতীয় ধাপে উঠে এলাম । এ ধাপটিও ঠিক আগের মতই সাজানো । অর্তাত্ সবগুলো ভবনই একই স্হানে রয়েছে । প্রবেশ তোরণ দিয়ে ভেতরে ঢোকার পর দেখা যায়, চত্বরের ডান দিকে উত্তর পূর্ব পাশে রয়েছে ঐতিহাসিক তথ্যাবলি সমৃদ্ধ প্রদর্শনী হল । দক্ষিণ পশ্চিম পাশে বৌদ্ধ ধর্মের ওপর জিনিস পত্রের একটি সাজানো গোছানো স্টল । অনেকেই অনেক কিছু সেখান থেকে কিনছেন । এর অপর দিকে রয়েছে আগত দর্শনার্থীদের প্রয়োজনীয় সিনিস পত্র কেনার একটি দোকান ।

বুদ্ধের সাদা হাড়ের রেলিক্স

পশ্চিম পাশে পাহাড় ঘেসে রয়েছে ইয়াওশি প্রাচীনকালের ঔষধের প্রাসাদ । যেখানে সে আমলে কবিরাজ বা চিকিত্সক ঔষধ তৈরি করতেন অসুস্হ বৌদ্ধ ভিক্ষুদের চিকিত্সার জন্য । চত্বরের দক্ষিণ পূর্ব পাশে রয়েছে পাথরের উপর লেখা সুত্রা বা ত্রিপিটকের বাণী লেকার ইতিহাস ।

ঘুরে ঘুরে আমি কিছুটা বলতে গেলে ক্লান্ত । একটু বিশ্রামের জন্য পাহাড়ের একেবারে দক্ষিণ দিকে চলে এলাম । ঝক ঝকে রোদের আলোয় বয়ে আসা ঠান্ডা বাতাস আমার সারা শরীরে আলতো করে ছুঁয়ে গেল তার তুলোর মত নরম হাতে। পাহাড়ের কোল ঘেষা পত্র পুষ্পহীন গাছের ছায়ায় গা'টা এলিয়ে দিলাম নির্ধিদায়।

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্যের পাতা
ভিডিও চিত্র
সাক্ষাত্কার
চিঠিপত্র
Play Stop
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040