Web bengali.cri.cn   
ফাংশানের 'ইউন জু' মন্দিরে একদিন-২
  2010-03-11 17:49:40  cri

মূল মন্দিরের কারুকার্যময় কাঠের তৈরী প্র্রধান গেট

বাসে প্রথম ওঠার সুযোগ পাওয়ায় সামনের দিকেই ডান পাশের একটা সিট পেয়ে গিয়েছিলাম। আমার সামনে একটি ছো্ট্ট শিশু বসার কারণে আমার জন্য ধাবমান বাসের ভেতর থেকে দু'পাশের দোকান পাট, দালান কোঠা ও গ্রামীণ দৃশ্য উপভোগের সুযোগও পেয়েছিলাম স্বাভাবিক কারণেই । খুবই ভালো লাগছিল যখন দেখছিলাম দু'পাশের প্রান্ত জুড়ে বিস্তির্ণ ফসলের ক্ষেত আর মাঝে মাঝে মাঠে শুকিয়ে যাওয়া ভুট্টা গাছের সারি । একটানা প্রায় দেড় ঘন্টা চলার পর বাসটি একটি স্টপেজে এসে থামে । এরপর ছিল ঘন ঘন স্টপেজ । এতে আমি ভাবছিলাম যে ঠিকমত নামতে পারবোতো ? যাই হোক, বাসের সহকারী মহিলা আমাকে জানালো পরের স্টপেজেই নামতে হবে । আমি প্রস্তুতি নিলাম । দু'একজন যাত্রীর সংগে ইউন চু সি বাস স্ট্যান্ডে নেমে দেখি এটি একটি তিন রাস্তার মোড় । একপাশে একটি হোটেল ও রেস্তোরাঁ ছাড়া আর কিছু নেই । দেখলাম পার্কের মত একটি ছোট্ট চত্বরে সাদা কালো রংয়ের শিং উঁচু করে বসে থাকা দু'টি গরুর সুন্দর ভাষ্কর্য । একজন মহিলা যাত্রী বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন । হাতে একটি চীনা পত্রিকা । নিবিষ্ট মনে পড়ছেন । চীনের যেখানেই গিয়েছি দেখতে পেয়েছি কেউ না কেউ পত্রিকা বা বইয়ের পাতায় নিমগ্ন তার চলার পথে । যেটা সাধারণত: পাশ্চাত্যের দেশসমূহেই বেশি দেখা যায় ।

মন্দিরের প্র্রার্থনার মূল ঘন্টা ঘর

আমি ভাবছি ১২ অথবা ৩১ নম্বর বাস আমাকে ধরতে হবে ইউন চু মন্দিরে যাওয়ার জন্য । দশ মিনিটেরও বেশি আমি আশে পাশের এলাকায় হেঁটে বেড়ালাম । ডান দিকের সড়কে একটু হেঁটে যেতেই দেখি লেকের মত একটি স্হানে ঘুরে বেড়ানোর জন্য কয়েকটি ছোট ছোট সেতু রয়েছে । তার চারদিকে ঘীরে এখন বরফের ওপর সূর্যের আলোর ঝিলি মিলি খেলা । এরই ফাঁকে দু'একজনের সংগে ভাব বিনিময়ও হলো । খুবই ভালো লাগলো । প্রায় ৬০০০ বর্গ কিলোমিটারের ফেং শান জেলায় অনেকগুলো দর্শনীয় স্হান রয়েছে । এবারে আমি যেখানে যাবো সে স্হানটি ১৩ কিলোমিটার দূরে । ১৪ কিলোমিটার দূরে স্টোন কার্ভিং পার্ক, ২০ কিলোমিটার দূরে ঐতিহাসিক চাং ফেং শহর, ৩১ কিলোমিটার দূরে লুং শিয়াংকুং গুহা, ৪০ কিলোমিটার দূরে সিদু ন্যাশনাল জিওলজিকাল পার্ক এবং ৬০ কিলোমিটার দূরে পুওয়া হান্টিং পার্ক । একদিনে একটির বেশি ঐতিহাসিক স্হান ঘুরে দেখা খুবই কষ্টকর । এরই মধ্যে ১২ নম্বর বাস এসে পড়ায় একটু দৌঁড়ে এসে উঠে পড়লাম বাসে ।

মধ্য দুপুরে এসে পৌঁছলাম বলতে গেলে চারদিকে পাহাড় আর শস্য ক্ষেতের পাশে থাকা ইউন চু মন্দির বাস স্ট্যান্ডে । সেখান থেকে প্রায় আধা কিলোমিটারেরও বেশি হেঁটে পৌঁছে গেলাম ছুং ডাইনাস্টির সময়কালের বৌদ্ধ মন্দিরে । 'পাই তাই' পাহাড়ের গায়ে নির্মিত এ বৌদ্ধ মন্দিরটি পেইচিং-এর দক্ষিণ – পশ্চিম দিকে অবস্হিত । মন্দিরের পূর্ব পাশে রয়েছে 'শাং ফেং' পাহাড় আর পশ্চিম পাশে 'চু মার' নদী ।

মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হলো নামের সাথে এ মন্দিরের একটি অপুর্ব মিল রয়েছে । ইউন চু'র অর্থ হলো মেঘের দেশ । সুউচ্চ বিশাল পাহাড়ের মাঝে এ মন্দিরটি পেইচিংয়ের শিজিংসানে আমার বাসা থেকে প্রায় একশ' কিলোমিটার দূরে । মন্দিরের সামনে রয়েছে পাহাড় ঘেরা বিশাল চত্বর । সেখানে গাড়ি পার্কিং ও রেস্তোরাঁ রয়েছে । সব কিছুই সাজানো গোছানো । মন্দিরের প্রবেশ দ্বারের দু'পাশে রয়েছে দু'পায়ের ওপর ভর করে গর্জনরত সিংহের ভাষ্কর্য । আর দু'পাশের গাছগুলোকে সাজানো হয়েছে চিনের ঐতিহ্যিক লাল লন্ঠন এবং রঙিন পতাকায় । পাহাড়ের পূর্বমূখী মন্দিরটি ৭ হেক্টরেরও বেশি এলাকা নিয়ে গঠিত হয়েছে । এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় 'সুই' ডাইনাস্টির সময়কালে ৬০৫ সালে । মন্দিরের নির্মাণ কাজ শেষ হয় সপ্তদশ শতকের ৬১৬ সালে । ইয়ৌচৌ-এর চিছুয়ান মন্দিরের প্রধান ভিক্ষু চিংউয়ান এ মন্দিরের নির্মাণ কাজ প্রথম শুরু করেন । মন্দিরের পাহাড়ের পাদদেশ থেকে শুরু করে প্রায় শিখর পর্যন্ত মোট

বুদ্ধের বাণী সমৃদ্ধ পাথরের ফলক ও শান্তি কামনা করে বেধে দেয়া রঙিন ফিতা

পাঁচটি ধাপে তৈরী হয়েছে ছয়টি মূল হল বা প্রার্থনা ভবন । মূল হলগুলোর দু'পাশেই রয়েছে রাজ প্রাসাদ এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বসবাসের জন্য ঘর । দু' পাশেই অর্থাত উত্তর দিকে একট এবং দক্ষিণ দিকে রয়েছে দু'টি প্যাগোডা । এ মন্দিরে থাং এবং লিয়াও ডাইনাস্টির সময়কালের বৌদ্ধ সংস্কৃতির পাথরের সুত্রা'র গুহাও রয়েছে । এতে কাগজের মত পাতলা পাথরে লেখা এবং কাঠের ওপর লেখা সুত্র বা বাণীকে তিনটি শ্রেষ্ঠ কাজ বলে ধরা হয়ে থাকে । আমি টিকিট কেটে ঢুকে পাড়ি মন্দিরে । প্রবেশ পথের কক্ষটিতে বুদ্ধের বিশাল মূর্তি ঠিক মাঝখানে । দু'পাশে রয়েছে দু'জন করে চারজন নিরাপত্তা রক্ষির মূর্তি । রঙিন এবং খুবই আকর্ষণীয় । প্রাঙ্গণে ঢুকতেই বিশাল আকারের ঐতিহ্যিক কাঠের কারুকার্যে ভরা তোরণ । এতে রঙিন সব ফিতে লাগানো রয়েছে । প্রথম প্রাঙ্গণের ডান দিকেই রয়েছে মন্দিরের বৃহত্তম ঘন্টা । দ্বিতল বিশিষ্ট কাঠের পাটাতনের সাথে পোড়ানো ইট ও টাইলস দিয়ে তৈরী মঞ্চের মাঝখানে এ ঘন্টাটি ঝুলে আছে । এটির উচ্চতা ৯.৮ মিটার । ছিং ডাইনাস্টির সময়কালে খাংশি সম্রাট এটি প্রথম তৈরী করেছিলেন । পরবর্তি সময় ১৯৯৯ সালে এটির সংস্কার করে বর্তমান রূপ দেয়া হয় । মন্দির ও ঘন্টা ঘরের উত্তর পূর্ব পাশে রয়েছে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বিশ্রাম স্হল । গাছের নির্মল ছায়ায় ঘেরা এ স্হানটি এখন তীর্থ দর্শনে আসা পূণ্যার্থীদের ক্ষণিকের বিশ্রাম নেয়ার উপযুক্ত স্হান । দেখলাম অনেক বয়স্ক ও শিশুরা সেখানে বিশ্রাম নিচ্ছেন, গল্প করছেন আর কেউ কেউ জপমালা নিয়ে জপ করছেন । বা দিকে বিশাল পাহাড়ী পাথরের গায়ে লিপিবদ্ধ বৌদ্ধ ধর্মের বাণী । তার সামনেই রয়েছে বৃক্ষ জুড়ে নানা ধরণের বাণী লেখা অসংখ্য ছোট ছোট ফিতে । বাতাসে তা দুলছে । একটা ধর্মীয় আমেজ যেন ছড়িয়ে যাচ্ছে চারদিকে । আসলে সব ধর্মই মানুষের কল্যাণে । মানুষের আত্মিক অনুভূতিকে শাণিত করার জন্য । মানুষে মানুষে মৈত্রির বন্ধনকে দৃঢ় করার জন্য । হিংসা দ্বেশ ভুলে পরস্পরকে আপন করে নেয়ার জন্য । প্রথম ধাপের মূল মন্দিরের পুরোহিত হাসি মুখে আমাকে স্বাগত জানালেন তার মন্দিরের অভ্যন্তরে । দেখলাম মন্দিরের সামনে রাখা প্রার্থনার ঘটে বড় ধরণের আগরবাতি জ্বালিয়ে চীনা তরুণ তরুণিরা ভক্তি ভরে আনত মস্তকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে । অসংখ্য ভক্তবৃন্দরা তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে মন্দিরের একধাপ থেকে আরেক ধাপে নিষ্পাপ হয়ে শব্দহীন পায়ে হেঁটে যাচ্ছে পবিত্রতার মধ্য দিয়ে । দর্শনার্থীদের সবাই চীনের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছেন । পুরো মন্দির জুড়ে আমিই শুধু একমাত্র বিদেশী । ধীর পায়ে আমি সবার সাথে এবারে পাহাড়ের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলাম মন্দিরের দ্বিতীয় ধাপের দিকে ।

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্যের পাতা
ভিডিও চিত্র
সাক্ষাত্কার
চিঠিপত্র
Play Stop
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040