Web bengali.cri.cn   
শি বাই পুও – শেষ পর্ব
  2010-03-02 20:12:57  cri

যুদ্ধকালীন সময় চেয়ারম্যান মাও সেতুং এ জিপ গাড়িটি ব্যবহার করতেন। পাশে রয়েছেন যুদ্ধের একজন অন্যতম স্বাক্ষী

আমরা লিথোগ্রাফ গার্ডেন থেকে বেড়িয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে নেমে এলাম । আসার সময় দেখলাম অনেক গাছের সারি । তাতে পাখিরা কিচির মিচির করে মিষ্টি সুরে ডাকছে । পাশের বিশাল লেক থেকে ঠান্ডা বাতাস গাছের পাতাগুলোয় ঝিরি ঝিরি কম্পন তুলে বয়ে যাচ্ছে । শীতের বিকেলের শীতল আমেজের অনুভুতি আমাদের শরীর ও মনের ভেতর এক ধরণের শিহরণের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে । নামার সময় চীনের অন্য প্রদেশের বেশ কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী আমাদের সংগী হলো । তাদের সংগে গল্প করতে করতে ক্লান্ত শরীরে পথ চলতে বেশ ভালোই লাগছিল। ওরা আমাদের দেশ সম্পর্কে জানতে খুব উত্সাহী। আমি ওদের আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ বলায় ওরা প্রথমে চিনতে পারে নি। অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল আমাদের মুখের দিকে। হঠাত্ মনে পড়লো আরে চীনেতো পৃথিবীর সব দেশেরই নিজেদের দেয়া একটি নাম আছে। যেমন আমেরিকাকে ওরা বলে 'মেই কুয়ো। ইংল্যান্ডকে বলে ইঙ্গুয়ো আর ইন্ডিয়াকে ইন্দো। আমাদের দেশটাকে ওরা বলে 'মুনচিয়ালা' ! ওরা খুব দ্রুত বলার সময় মনে হয় বলছে 'মুনজালা' । আমি সে নামটি উচ্চারণ করতেই ওরা উল্লসিত হয়ে সমস্বরে বলে উঠলো 'মু ন্ জা লা'। এ যেন তাদের কত দিনের চেনা একটি সুন্দর দেশ । কতটাই না যেন ওদের সংগে আমাদের ঘনিষ্ঠতা । আসলে চীনের সংগে আমাদের সৌহার্দপূর্ণ সম্প্রীতির বন্ধন দু'হাজার বছরেরও বেশি সময়ের । সেকালে আমাদের দেশের মনিষী অতীশ দীপঙ্কর প্রথম চীনে গিয়েছিলেন । এবং সেখানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার শুরু করেন । এর পরবর্তী সময় চীনের বিখ্যাত পন্ডিত হিউয়েন সাং এসেছিলেন আমাদের দেশে । উভয় দেশের আর্থ-সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল শান্তি ও সম্প্রীতিময় বন্ধুত্বের অটুট বন্ধন । যা আজও চীনে আসলে সহজেই অনুভব করা যায় । ভাষাগত সমস্যা না থাকলে কিছুতেই বোঝা যেত না যে চেহারার পার্থক্য ছাড়া আমাদের মধ্যে কোন অমিল রয়েছে । আমাদের সাথে ওরা পৃথক পৃথকভাবে অনেক ছবি তুললো ।

যুদ্ধের অবসরে কমরেড লিউ শাও ছি এ চ্যায়ারে বিশ্রাম নিতেন

আমরা নেমে এলাম মাঝ পথে । একটু ডান দিকে মোড় নিয়ে আমরা লেকের পাড়ে চলে এসে বসে পড়লাম একটি গাছের ছায়ায় । জাদুঘরে ঢোকার আগে একটু বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন । বেঁকে আসা এ পথটির পাশেই রয়েছে অনেক স্মারক বস্তুর দোকান । খুবই সাজানো গোছানো । বিভিন্ন রঙিন স্মারকের ওপর পরন্ত বিকেলের সূর্যের হরিদ্রাভ আভা ছড়িয়ে পড়ায় তা আরো ঝল্ মল্ করে জ্বলছে । লেকের পাড়েই বাধা রয়েছে কয়েকটি নৌকা ও স্পিড বোট । ইচ্ছে করলে ভাড়া নিয়ে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে ঘুরে আসার সময় চোখ জুড়ানো মনোরম সব দৃশ্য দেখা যাবে প্রাণ ভরে । মইনুল ভাই'র খুব ইচ্ছে ছিল নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর । কারণ, শিল্পী মানুষতো । তার ছবি আঁকার খোরাক পেয়ে যাবেন অনেক । হাতে সময় কত থাকায় আমরা পাশের একটা ছোট্ট খাবারের দোকান থেকে এক কাপ কফি খেয়ে নিয়ে পাহাড়ের দ্বিতীয় ধাপে শি বাই পুও জাদুঘরের সামনে চলে এলাম ।

জাদুঘরের সামনের উন্মুক্ত প্রাংগণের ঠিক মাঝখানে পত পত করে উড়ছে চীনের জাতীয় পতাকা তার পাঁচ তারকার বর্ণিল ছটায় । পতাকার সামনেই রয়েছে চীনের অবিসংবাদিত মহান নেতা চেয়ারম্যান মাও সে তুং ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী চার সম্পাদক, লিউ শাও ছি, চু তে, চৌ এ্যান লাই ও রেন বি শি'র কালো পাথরের নিখুঁত ভাষ্কর্য । তারা যেন দাঁড়িয়ে আছেন সাহসী দৃষ্টিতে অদম্য আর অসীম মনোবল নিয়ে বিজয় আর নির্যাতিত, নিপীড়িত, শোষিত ও বঞ্চিত অগণিত মানুষের কল্যাণের অভিব্যক্তিকে ধারণ করে । আমরা সবাই তাদের সামনে দাঁড়িয়ে দলবদ্ধ ও পৃথক পৃথকভাবে ছবি তুললাম । এখানে আমাদের সাথে দেখা হলো আরো কয়েকজন বিদেশির সাথে । তারাও তখন সারিবদ্ধভাবে ছবি তুলছিল ।

শি বাই পুও'তে শি চিয়া জুয়াংয়ের কলেজের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে লেখক

আমরা সবাই বিনামূল্যের টিকিট দেখিয়ে ঢুকে পড়লাম জাদুঘরের অভ্যন্তরে । বিশাল এ ভবনের একতলা ও দোতলায় প্রদর্শন করা হয়েছে শি বাই পুও'র যুদ্ধকালিন সময়কালের অনন্য ইতিহাস । প্রথমে ঢুকেই আমরা দেখলাম মাঝখানে রাখা হয়েছে একচাকা বিশিষ্ট একটি টানা কাঠের গাড়ি । এতে যুদ্ধের সময় সৈনিকরা যাতায়াতসহ মালামাল বহন করতো । সে সময় শি বাই পুও'র প্রতিটি পরিবারে থাকাসহ প্রায় এরকম টানা গাড়ি ছিল । এ কক্ষেই দেখা হয়ে গেল এমন একজন বৃদ্ধের সাথে যার বয়স এখন প্রায় পচাত্তুরের কাছা কাছি । তিনি এ শি বাই পু্ও'রই সন্তান । যুদ্ধের সময় তিনি কিশোর ছিলেন। যুদ্ধ করতে পারেন নি বলে তার খুব দু:খ হয় । তার পরিবারের বেশ কয়েকজন যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন । তিনি তার স্ত্রী ও নাতি নাতনিকে নিয়ে এসেছেন জাদুঘর দেখাতে । কলেজ পড়ুয়া নাতনীটি মোটামুটি ইংরেজীতে কথা বলতে পারে । এ কক্ষে অনেক কিছুর মধ্যে দেখলাম লি শাও চি'র ব্যবহৃত টেবিল, চেয়ার ও অবসর নেয়ার সময়কার ইজি চেয়ার । তার চারপাশে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তখনকার প্রাকৃতিক পরিবেশ । ঘুরে ঘুরে দেখছি পাহাড়ের গুহায় কেমন করে সৈনিকরা থাকতেন, কীভাবে যুদ্ধে অংশ নিতেন আর তার অনন্য দৃশ্যাবলী । যে সব অশ্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছেন । সবই খুব পুরানো যুদ্ধাশ্ত্র । এর মধ্যে দেখলাম রাইফেল, সাবমেশিনগান, মেশিনগান, দূরপাল্লার রকেট লাঞ্চার ও পিস্তলসহ নানাবিধ অশ্ত্র সশ্ত্র । দেখে মনে হলো এধরণের সাধারণ অশ্ত্র দিয়ে তারা কীভাবে বিদেশি আধুনিক সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করেছেন । সত্যিই ভাবলে অবাক হতে হয় । এখানে রয়েছে এককেন্দ্র থেকে আরেক কেন্দ্রে বার্তা প্রেরণের যন্ত্র । তত্কালিন সিনহুয়া বার্তা সংস্হার ব্যবহৃত ইকুইপমেন্টস । এই শি বাই পুও থেকেই প্রথম মুদ্রিত হয়েছিল চীনের মুদ্রা রেন মিন পি । আর এ টাকা ছাপা হতো সাধারণ একটি ট্রেডেল মেশিনে । মেশিনটি এত ছোট ছিল যে তা যখন তখন যেখান সেখানে বহন করে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব ছিল । আমরা দেখলাম চীনের রাষ্ট্রীয় নেতৃবৃন্দের সে সময়কলের অনেক মূল্যবান ছবি । দেখেছি চীনের যুদ্ধের সময় চালু হওয়া জাপানী ভাষায় প্রচারিত বেতার কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি । মাও সে তুং তার চারজন সচিবের সংগে পরামর্শরত মূল্যবান ছবি ।

এ জাদুঘরে যুদ্ধের আবহ সৃষ্টি করে তৈরি করা হয়েছে একটি গ্যালারী । দেয়ালের উপরে নিচে ও তিনপাশে আঁকা রয়েছে ভয়াবহ সম্মুখ যুদ্ধের তৈল চিত্র । এটি দেখে আমার মনে পড়লো আমি যখন দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের চল্লিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে রাশিয়ার মস্কোয় ও সাইবেরিয়ায় আয়োজিত আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক উত্সবে অংশ নিতে বাংলাদেশের চল্লিশ সদস্যের সাংস্কৃতিক দলের ম্যানেজার হিসেবে ১৯৯৪ সালে গিয়েছিলাম । তখন রাশিয়ার জাদুঘরে এধরণের গ্যালারী দেখেছি । আসলে একটি দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা না গেলে আগামী প্রজন্মের কাছে তা অজানা থেকে যায় । আর জাতি তার আত্মসম্মান বোধে উজ্জীবিত হয়েও ওঠে ন । গড়ে ওঠে না দেশ মাতৃকার প্রতি অকৃত্তিম ভালোবাসা । দেখতে দেখতে আমরা এসে দাঁড়ালাম চেয়ারম্যান মাও সে তুং-এর ব্যবহৃত পুরানো দিনের জীপ গাড়িটির সামনে । যুদ্ধের সময় একমাত্র এ গাড়িটিই তার বাহন ছিল । ঐতিহাসিক এ গাড়িটিকে ছুঁয়ে দেখে বুকের ভেতর অনুভব করেছি এক

অনাবিল শান্তি । মাও সে তুং – এর এ গাড়িটিতে যখন কোথাও যেতেন তখন এ গাড়িটির ভেতর বোঝাই থাকতো তার বই পত্র । তিনি বই পত্র ছাড়া কখনও কোথাও যেতেন না । বিশাল আকারের একটি ছবি । ছবিতে চেয়ারম্যান মাও সে তুং ১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর ঘোষণা করছেন মহান চীনের স্বাধীনতার কথা ।

আমার হৃদয়ে তখন অনুরণিত হচ্ছিল মুক্তির আনন্দের সুর । দুলছিল নিজের আপন ঠিকানায় বাবুই পাখির মত ছোট্ট একটি নীড়ে অসংখ্য স্বপ্নের দোলা । কর্ণ কুহরে বাজছিল আগামী দিনের ভোরের সূর্যের আলোয় অনাগত প্রজন্মের মাথা উঁচু করে নিজে পায়ে দাঁড়াবার ভিতকে গড়ে তোলার অনন্য প্রয়াসের অপ্রতিরোধ্য যাত্রার পদ ধ্বনি । আমরাও স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছি । স্বাধীনতাও পেয়েছি । কিন্তু কী পেয়েছি আর কী পাই নি সেই সব এলো মেলো অনেক কথার ভীড়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম কিছুক্ষণ । বুল বুল ভাইর ডাকে যেন সম্বিত ফিরে এলো ।

জাদুঘরের প্রায় সব দর্শকই বিদায় নিয়েছে । সময়ও প্রায় শেষ । আমরা বিদেশি বলেই হয়তো একটু বেশি সময় পেয়েছি ।

একদিকে শি বাই পুও'র সংগ্রামের সাহস, শক্তি আর বিজয়ের অদম্য মনোবলও পথ চলার অনুপ্রেরণাকে সংগী করে নেয়ার পাশা পাশি এমন একটি মহান স্হান থেকে চলে যাবার বেদনাকে বুকে চেপে নিয়ে বেড়িয়ে এলাম ইতিহাসের পাতা থেকে । চীন আর চীনের জনগণের ত্যাগ তিতিক্ষার মহান ইতিহাস আজ যেন সারা বিশ্বের প্রতিটি মানুষের কাছে শান্তি ও মানবতার অনন্য প্রতীক ।

শেষ বাসটি প্রায় চলেই যাচ্ছিল । আমরা সবাই দৌঁড়ে গিয়ে হাপাতে হাপাতে বাসে উঠে পড়লাম । বাসটি পাহাড়ী আঁকা বাঁকা পথ ছাড়িয়ে ছুটে চললো সন্ধ্যার আবছায়া আঁধারকে সংগী করে । (শেষ পর্ব) ---আ. বা. ম. ছালাউদ্দিন ।

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্যের পাতা
ভিডিও চিত্র
সাক্ষাত্কার
চিঠিপত্র
Play Stop
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040