|
শি বাই পুও'র লিথোগ্রাফ গার্ডেন
স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত নেতৃবৃন্দের আবাসস্হল, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও সিন হুয়ার কার্যালয় অর্থাত্ যুদ্ধ পরিচালনার সামরিক ঘাটি থেকে আমরা বেরিয়ে এলাম সামনের খোলা চত্বরে । চারিদিকে জলাধার ঘেরা পাহাড়ের ওপরের এ চত্বরটি পাকা করে দেয়া হয়েছে । গাড়ি পার্কিং-এর উল্টো দিকেই সারিবদ্ধভাবে রয়েছে অনেকগুলো ছোট ছোট দোকান । এসব দোকানে মাও সে তুং-এর কোটপিন, মাও সে তুং-এর রচনাবলী ও তার ছবি দিয়ে মুদ্রিত ভিউকার্ডসহ রং বেরং-এর নানা ধরনের অনেক স্যুভেনির সাজানো রয়েছে । এত সুন্দর যে দেখলেই কিনতে ইচ্ছে করে । বুলবুল ভাই ও মইনুল ভাই বেশ কিছু কিনলেন । আমি শি বাই পুও'র দুই সেট ভিউ কার্ড কিনলাম । এখানে কয়েকটি খাবারের দোকান আছে । তবে এসব দোকানে খাবারের পাশা পাশি স্যুভেনিরও বিক্রি হচ্ছে । এমন একটি খাবার দোকান খুঁজে পেলাম যেখানে খুব সস্তায় খাওয়া যায় । এক বাটি নুডলসের স্যুপ মাত্র তিন ইউয়ান । এক কাপ ইন্সট্যান্ট কফিও মাত্র দুই ইউয়ান । দোকানের পেছনে পাহাড়ের প্রান্ত ঘেষে সুন্দর একটি পার্কের মত রয়েছে । এখানে দাঁড়িয়ে জলাধার ছাড়িয়ে দূরের মনোরম রাশি রাশি পাহাড় আর তাতে ছড়ানো ছিটানো ঘরবাড়ি দেখা যায় । আমরা চারজনই এখানে বসে পড়লাম । খেয়ে নিলাম তৃপ্তিসহকারে । এখানে শুধু এ খাবারের দোকানই নয় । এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি অতি উন্নত মানের রেস্তোরাঁ । রয়েছে তিন তারকা বিশিষ্ট হোটেল আর মোটেলও । এখানে খুব ভালো আর আয়েশীভাবে খেতে চাইলে যেমন খাওয়া যাবে. তেমনি মধ্য মানের এবং আমরা যেখানে খেলাম তেমন সস্তা খাবারের দোকানও রয়েছে । পুরো এলাকাটাই উঁচু নিচু পাহাড়ের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে গড়ে উঠেছে । মসৃণ উঁচু নিচু রাস্তা এ পাহাড় থেকে ও পাহাড় অতিক্রম করে চলে গেছে ঠিক সাপের মতই । এসব জায়গায় নিজের ব্যক্তিগত গাড়ী থাকলে খুব ভালোভাবে আরামে এক স্হান থেকে আরেক স্হানে ঘুরে বেড়ানো যায় । অবশ্য তরুণদের জন্য তেমন একটা অসুবিধা হওয়ার কথা নয় । বয়স্কদের বিশেষ করে যারা সমতল ভূমিতে বড় হয়েছেন তাদের জন্য হেঁটে হেঁটে পাহাড়ে ওঠা নামা করা কিছুটা কষ্টকরতো হবেই ।
আমরা কিছুটা আয়েশী ভঙ্গিতে হাঁটা দিলাম জাদুঘর দেখবো বলে । পথি মধ্যে ভেবে দেখলাম জাদুঘরে প্রথমে না গিয়ে লিথোগ্রাফ গার্ডেন আগে দেখে এলেই ভালো হয় । তার কারণ, জাদুঘরের পরেই রয়েছে তিন পাশে লেকে ঘেরা হস্তলিপির বাগান । ফেরার পথে জাদুঘর দেখে সোজা বাস স্ট্যান্ডে চলে যাওয়া যাবে । তাতে আমাদের সময়েরও সাশ্রয় হবে । জ্বল জ্বল করা সূর্যের উজ্বল রোদের মাঝেও হাড় কাঁপানো শীত । সোয়েটার, জ্যাকেট আর উলের ইনার এবং মাথায় মোটা টুপি, হাতে গ্লাভস এবং পায়ে বিশেষ ধরণের মোজা ও ভেড়ার লোম ওয়ালা জুতা পরা সত্বেও পাহাড় পেড়িয়ে জলাধার ছুঁয়ে আসা বাতাস যেন আমাদের শরীরে ঠান্ডা আবেশ বুলিয়ে যাচ্ছিল । বিশেষ করে নাকে আর চোখে । ভালোই লাগছিল অগুণতি চীনা পর্যটকের মাঝে মাত্র ৭ বা ৮ জন বিদেশী হিসেবে । ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম গ্রুপ বেধে অনেক ছাত্রছাত্রী দেখছে আর নোট বুকে টুকে নিচ্ছে তথ্যাবলি । আহা, যদি আমার দেশের ছাত্রছাত্রীরাও গ্রুপে গ্রুপে নিয়মিতভাবে আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের স্হানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখে তথ্যাবলি টুকে নিয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করতো ?
এসব অস্ত্র দিয়েই যুদ্ধ করেছে পিপলস্ লিবারসন আর্মি
লিথোগ্রাফ গার্ডেনে যাবার পথে পাহাড়ের ওপরে দেখলাম বেশ কয়েকটি নতুন হোটেল । প্রথমবার যখন আমি এখানে এসেছিলাম তখন এসব হোটেলগুলো নির্মানের জন্য প্রস্তুতি চলছিল । একটা জিনিস দেখে অবাক হলাম এর মধ্যেও খালি জায়গায় চাষাবাদ করা হচ্ছে । তা হচ্ছে ত্রিকোণাকৃতি আমাদের দেশের বস্তির মত লম্বা লম্বা ঘরের মধ্যে । তিন পাশে দেয়াল ঘেরা এসব ঘরের ছাউনি মোটা পলিথিন দিয়ে ঘিরে রাখা । কারণ, দিনের বেলায় যাতে সূর্যের আলো ঘরের ভেতর প্রবেশ করতে পারে । দেখলাম ঘরের ওপরে গোল করে বাধা রয়েছে পুরু আকারের খড় দিয়ে তৈরি লম্বা ঢাকনা । রাতে এবং শীত ও বৃষ্টির সময় ঢাকনাগুলো খুলে দিয়ে ঢেকে রাখা হয় । এসব গ্রীণ হাউস ঘরে সাধারণত শাক সব্জির চাষই বেশি হয় । হাঁটতে হাঁটতে আমরা চলে এলাম লিথোগ্রাফ গার্ডেনের সামনে ।
প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে একট খোলা দোতলা ভবন । এটিই হলো লিথোগ্রাফ গার্ডেন । বারান্দার মত করে ঘিরে থাকা চতুষ্কোণ বিশিষ্ট এ ভবনটির ঠিক মাঝখানে তীরের ফলার মত একটি চারকোণা স্তম্ভ ভবনটির মাঝখান দিয়ে উঠে গেছে আকাশের দিকে । এটি একটি বৃহত্ পাথরের খন্ড । এর ওপর চেয়ারম্যান মাও সে তুংয়ের নিজের হাতের লেখা বাণী খোদাই করা রয়েছে । সাথে কোন গাইড না থাকায় আমরা বাণীটির অর্থ উদ্ধার করতে পারলামনা বলে খুবই দু:খ লাগলো । মনও খারাপ হয়ে গেলো । মাও সে তুংয়ের লেখা ছাড়াও পুরো ভবনটি জুড়ে রয়েছে চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির উচ্চ পর্যায়ের নেতা, যুদ্ধকালীন সামরিক কমান্ডার ও প্রশাসক, খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যিক ও বিদগ্ধজনের লেখা বাণীর অনুলিপি । প্রতি লেখাই মূল্যবান পাথর খন্ডে খোদাই করে প্রদর্শন করা রয়েছে । প্রতিটি লেখার পাশেই রয়েছে লেখকের পরিচয় । লিথোগ্রাফ গার্ডেনের এ ভবনে সব মিলিয়ে ৪০০ বিদগ্ধজনের হাতের লেখা রয়েছে । এ ভবনটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, ঘন্টার পর ঘন্টা ঘুরে ঘুরে দেখলেও যেন ক্লান্তি লাগবে না । লিথোগ্রাফ গার্ডেনটি তৈরি করা হয়েছে ১১ হাজার বর্গ মিটারের ওপর । এর মূল মেঝের পরিমাণ হলো ৩ হাজার ১শ বর্গ মিটার । ভবনটি স্হাপত্য নকশা এমনভাবে করা হয়েছে যে, এ ভবনে প্রদর্শিত হাতের লেখাগুলো পড়ার জন্য দিনের বেলা কোন বৈদ্যুতিক বাতির প্রয়োজন হয় না । সূর্যের সরাসরি আলোয় তা আপনিই উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে । চার পাশের গাছগুলোয় অসংখ্য চীনা চড়ুই পাখি এবং বেশ কয়েকটি ঘু ঘু'র ডাকে আমরা আমাদের বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকার অনুভূতি অনুভব করলাম কিছুক্ষণের জন্য ।
জাদুঘরের পথে লেখক
দেখতে দেখতে দিনমণি পূবের আকাশ থেকে পশ্চিমের আকাশের দিকে হেলে পড়তে শুরু করেছে । আমাদের এখনও জাদুঘর দেখা বাকী রয়ে গেছে । তাই এবারে সংগী সবাইকে তাগাদা দিয়ে জাদুঘরের উদ্দেশ্যে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম ।
![]() |
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved. 16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040 |