Web bengali.cri.cn   
শি বাই পোও : চীনের স্বাধীনতার পতাকা উড়ার পাদপীঠ - আট
  2010-02-11 20:56:31  cri

চীনের রেন মিন পি শি পাই পো থেকে প্রথম মুদ্রিত হয়েছিল এ ছাপার চন্দ্র থেকে

আমরা অতিশয় আবেগ আর উচ্ছাসের বসে পাহাড়ের উপরের ছোট্ট এই প্রাঙ্গণটির প্রতিটি ঘরই একটার পর একটা ঘুরে বেড়াচ্ছি । দেখে যাচ্ছি আর হৃদয়ে অনুভবের অস্তিত্বে ধারণ করে নিচ্ছি ভালোলাগার শিহরিত ইতিহাস । যত দেখি ততই ভালোলাগে । অসংখ্য পাহাড়ের ভেতরের ঐতিহাসিক ঘাটি । কম্যুনিস্ট পার্টির এক সময়কার সদর দপ্তর । আমরা ধীর পায়ে হেঁটে দু'একটি ঘর পেরিয়ে ঢুকে পড়লাম কমরেড রেন বিশি'র ঘরে । খুব ছোট্ট ঘর । দেখে মনে হয় যেন অতীতেও এটি খুব সাজানো গোছানো ছিল । তার এ আবাসস্হলটি দু'ভাগে বিভক্ত । পূর্ব দিকের একটি এবং পশ্চিম দিকে আরেকটি । পূর্ব দিকের কক্ষটি হলো রেন বিশি'র অফিস কক্ষ । পশ্চিম দিকেরটি হলো রেন বিশি ও তার স্ত্রী'র থাকার কক্ষ । পশ্চিমাংশের উত্তর দিকের রেন বিশি'র ছেলের থাকার কক্ষ । পূর্বাংশের উত্তর দিকের কক্ষটি ছিল রেন বিশি'র দুই কন্যার জন্য । এ ছাড়া দক্ষিণ দিকের কক্ষটি ছিল রেন বিশি'র কনফিডেন্সিয়াল সেক্রেটারি শি জে'র থাকার জন্য । দক্ষিণ ব্লকের বাকী কক্ষ দু'টি ছিল কর্মচারীদের জন্য ।

কমরেড রেন বিশি ১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাসে শি বাই পুও আসেন । মাও সে তুং-এর পাঁচজন সচিবের মধ্যে রেন বিশি ছিলেন সবচেয়ে কনিষ্ঠতম । রেন বিশি ছিলেন কম্যুনিস্ট পার্টি গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা এবং অগ্রণী সদস্য । তিনি ১৬ বছর বয়সেই সমাজতান্ত্রিক যুব লিগে যোগদান করেছিলেন এবং মাত্র ৪৬ বছর বয়সেই ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন ।

কুয়োমিনতাং-এর শাসনামলে রেন বিশি দু'বার জেল খেটেছিলেন । এ সময় তিনি শত্রু পক্ষের বর্বরোচিত নির্যাতন ভোগ করার নির্মম অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তাকে শত্রুর হাতে অকল্পনীয় নির্যাতনের পর দারুণভাবে ক্ষত-বিক্ষত শরীরে উদ্ধার করা হয়েছিল । শারীরিকভাবে অসুস্হ থাকলেও রেন বিশি ক্লান্তিহীনভাবে একটানা যুদ্ধের সময় চেয়ারম্যান মাও সে তুংকে সহায়তা করে গেছেন । কাজ করে গেছেন কম্যুনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সচিবালয়ের সচিব হিসেবে । তার কক্ষে অনেক সাংস্কৃতিক পুরাকীর্তি দেখা যায় । তার বিছানার ওপর রয়েছে অনেক পুরানো সুতির কার্পেট । এছাড়া আরো আরো রয়েছে একটি কাঠের এবং একটি লোহার বাক্স । এ দু'টি বাক্স তিনি সানপেই থেকে আসার সময় নিয়ে এসেছিলেন । এসব বাক্সে করে তিনি দলীল পত্রাদি বহন করতেন । কমরেড রেন বিশি'র জীবনটাই ছিল সংগ্রামের ও কষ্টের । এর পরও তিনি প্রচুর বই পড়েছেন । সারা জীবন রেন বিশি মার্কস, লেনিন এবং মাও সে তুং-এর রচনাবলি পড়ে গেছেন । দেখলাম তার টেবিলের ওপর রয়েছে একটি ছোট্ট সীল । এ সীলটি তিনি যে বইটি পড়া শেষ করতেন তাতে ব্যাবহার করতেন । তার পাঠকৃত প্রতিটি বইয়েই রয়েছে এই সীল মোহর ।

রেন বিশি সারা জীবন যুবলীগের কাজ করে গেছেন। কাজ করে গেছেন যুবকদের উন্নয়নের জন্য । এ ক্ষেত্রে তিনি একজন ভালো শিক্ষকও ছিলেন । শি বাই পুওতে থাকার সময় তিনি তার ছেলে রেন ইউয়ানকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন 'ট্যাড, তোমাকে গভীর মনোযোগ দিয়ে সব ধরণের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে হবে । যদি তুমি লেখা পড়া না করো, তবে তোমার জীবনটাই বৃথা ।' এটা শুধু তার ছেলেকেই নয় যুবদের উদ্দেশ্যেও তার এ বাণী ছিল । যুবকরা চীরকাল তার এ কথা স্মরণ করবে ।

এ ঘরে থাকতেন রেন পি শি

রেন বিশি চেয়ারম্যান মাও সে তুং-এর সংগে ১৯৪৯ সালের ২৩ মার্চ পেইচিং চলে এসেছিলেন । তিনি এত অল্প বয়সে কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন এবং যখন তার চীনকে আরো দেবার সময় ঠিক তখনই তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছিলেন । চীনারা তার কথা স্মরণ করবে আজীবন । রেন বিশি'র কথা ভাবতে ভাবতে আমরা তার গৃহ থেকে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম ।

শীতের আমেজ আর চিরল পাতার পাহাড়ি গাছ যাতে এখন একটি পাতাও নেই, দেখলে মনে হয় যেন মরে গেছে । কিছু কিছু গাছে হালকা সবুজ পাতা বাতাসে ঝির ঝির করে কাঁপছে । এসব গাছের পাতা কখনোই ঝরে পড়ে না । দেখলাম বেশ কয়েকটি ঘুঘু খাবার খুটে খাচ্ছে । ঘুঘুগুলো ঠিক বাংলাদেশের মতই । কোন পার্থক্য নেই । মাঝে মাঝে ঘুঘুর ডাক হৃদয়টাকে এতটা আবেগ প্রবন করে তুলেছিল যে মনে হয়েছিল আমি ঠিক বাংলাদেশের ছায়া সুনীবিড় শান্তির নীড়ের মত একটি গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছি । পার্থক্য শুধু আমাদের দেশের গ্রামগুলো পাহাড় বেস্টিত নয় ।

হাঁটতে হাঁটতে আমরা চলে এলাম কমরেড তুং বিউ-এর ঘরের সামনে । কমরেড তুং বিউ'র গৃহটিও কয়েকটি কক্ষ বিশিস্ট । একটি কক্ষ তার অফিস, একটি কক্ষ তার স্ত্রীসহ থাকার জন্য, আরেকটি কক্ষ তার কর্মচারীদের থাকার জন্য । তিনি কম্যুনিস্ট পার্টির হুপেই সচিবালয় ব্যুরোর সচিবালয়ের সচিবসহ হুপেই অর্থ কমিটিরও সচিব ছিলেন । দেখলাম তিনি এবং তার স্ত্রী কমরেড হা লিয়ানজি মিলে বাড়ির চত্বরে এপ্রিকট, চিকন বাঁশের ঝাড় ও অনেক ফুলের গাছ লাগিয়েছেন । এছাড়াও তুং বিউ অবসর সময় মুক্তাঞ্চলের পতিত জমিতে সব্জির বীজ রোপণ করে চাষাবাদেও ব্যস্ত থাকতেন । যা এখনো তাদের স্মৃতিকে বহন করে চলেছে । ইয়াননানে থাকার সময় তার স্ত্রী কমরেড হা লিয়ানজি কাপড় বুননের কাজে দক্ষতার জন্য সাংগানিন সীমাস্তে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন । যুদ্ধের সময় লিয়ানজি স্বতপ্রণোদিত হয়ে পার্টির সংশ্লিস্ট বিভাগের হয়ে এলাকায় বাড়ি ঘর নির্মাণে যোগালীর কাজও করেছেন ।

তুং বিউ ১৯৪৭ সালের মে মাসে সানপেই থেকে শি বাই পুও আসেন । তিনিও এখানে দু'বছর ছিলেন । তিনি অবসর পেলেই মার্কস-লেনিন আর চেয়ারম্যান মাও সে তুং-এর বই পড়তেন এবং নিজেও লিখতেন । দেখলাম এসব বই এখনো শেলফে সুন্দর করে সাজানো রয়েছে । সাজানো রয়েছে তার লেখার কলম ও কাগজসহ অন্যান্য জিনিস পত্রও ।

তুং বিউ ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর মাসে 'পিপলস্ ব্যাংক অব চায়না' থেকে গণপ্রজাতন্ত্র চীনের মুদ্রা রেন মিন বি মুদ্রণের পর চেয়ারম্যান মাও সে তুং-এর নির্দেশে প্রথম বাজারে ছেড়ে ছিলেন ।

যুদ্ধের ডামা-ডোলের মধ্যেও তুং বিউ অতি সাধারণ জীবন যাপনের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কথা গভীরভাবে চিন্তা করতেন । একবার এলাকার একটি শিশু মারাত্মক অসুস্হ হয়ে পড়লে স্হানীয় চিকিত্সার পর সবাই ধরে নিয়েছিল যে শিশুটি আর বাঁচবে না । তার মা বাবার চিকিত্সার ক্ষমতাও ছিল না । কিন্তু তুং বিউ খোঁজ খবর নিয়ে তাকে দূরের ভালো হাসপাতালে পাঠিয়ে সুস্হ করে তুলেছিলেন । সে শিশুটি কিন্তু আজও বেঁচে আছে । আসলে এসব নেতাদের ত্যাগ, তিতিক্ষা ও নিরহংকারী স্বাভাবিক জীবন ধারাই চীনকে করেছে সব দিক থেকে মানবিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ । করেছে উন্নতির পথকে সুগম ।

আমাদের এবারে খুব বেশি খিদে পেয়েছিল । বিশেষ করে আমার । আমি চাচ্ছিলাম এখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে কিছু একটা খাই । কিন্তু আমার সংগীরা সব না দেখে কিছুতেই বেরুবে না । কি আর করা, আমরা এবারে

চীনা শিল্পীর আঁকা যুদ্ধের একটি চলচিত্র

ঢুকে পড়লাম প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে । এখানে কর্মকর্তাসহ যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো । ব্ল্যাক বোর্ড, টেবিল চেয়ার সবই ঠিক আগের মতই রয়েছে । পরে আমরা দেখলাম আজকের চীনের সবচেয়ে বড় এবং সারা বিশ্বে সবার কাছে পরিচিত বার্তা সংস্হা সিন হুয়ার তত্কালিন সংবাদ কেন্দ্র । মনেই হয় না যে এমন একটি পরিসরে থেকে তারা সারা পৃথিবীকে যুদ্ধের সঠিক সংবাদ সরবরাহ করতে সক্ষম হয়েছিল । সিন হুয়া বার্তা সংস্হার ঘর থেকে বেড়িয়ে আরো কিছুক্ষণ ঘুরে আমরা হাঁটা দিলাম কোথায় দুপুরের খাবার খাওয়া যায় সে উদ্দেশ্যে । কারণ, এর পরে আমরা দেখতে যাবো শি বাই পুও'র ঐতিহাসিক জাদুঘর । (চলবে)

--আ বা ম. ছালাউদ্দিন

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্যের পাতা
ভিডিও চিত্র
সাক্ষাত্কার
চিঠিপত্র
Play Stop
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040