|
(যুদ্ধের দিক নিদ্বেষণা নিয়ে চেয়ারম্যান মাও জে তোং আলোচনা করছেন)
আমরা মাও সে তুং-এর ঘরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখার সময় বুল বুল ভাই ও মইনুল ভাই বলছিলেন, দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি কতটা ভালোবাসা থাকলেই কেবল স্বাধীনতা লাভের পরও কতটা আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও সততার সংগে নিজের দেশকে গড়ে তোলা যায় দৃঢ় ভিত্তির ওপর আর মাথা তুলে দাঁড়ানো যায় বিশ্বের প্রতিযোগিতার মঞ্চে । এ জন্যে সাহস আর আত্মত্যাগের মনোভাবটাই সবচেয়ে জরুরী । কথা বলতে বলতে আমরা মাও সে তুং-এর বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আমরা হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি কমরেড লিউ শাও চি'র ঘরের কাছে । 'চাওলিংগুও' সম্মেলনের পর পরই লিউ শাও চি, শি বাই পুও'র পূ্র্ব দিক দিয়ে ইয়েলো রিভার অর্থাত্ হোয়াং হো নদী অতিক্রম করে তার সঙ্গিদেরসহ ১৯৪৭ সালের ২৬ মে চলে আসেন এ ঘাটিতে । তখন থেকে চীনের স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত এখানেই ছিলেন দু'বছর । তিনি যে বাড়িটিতে থাকতেন সে বাড়িটিতে বেশ কয়েকটি কক্ষ রয়েছে । বাড়িটির পূর্ব দিকের কক্ষটি ছিল লিউ শাও চি'র অফিস আর পশ্চিম দিকের কক্ষটি হলো ওয়াং কুয়াংমেই'র অফিস ঘর । পূর্ব দিকের উত্তরের কক্ষটি তার সচিব লিয়াও লুইয়ানের । এর দক্ষিণ পাশেরটাই হলো তত্কালীন কমান্ডার জেনারেল চু-এর সচিব কমরেড হুয়াং হুয়ার থাকার কক্ষ । আর চু'র থাকার ঘরটি ঠিক লিউ শাও চি'র ঘরের প্রাঙ্গণের সামনের দিকে ।
(মাঝখানের ঘরে থাকতেন চৌ এন লাই)
লিউ শাও চি মুক্তি যুদ্ধের দ্বিতীয় বছর শি বাই পুও এসছিলেন । এর পরপরই ১৯৫৭ সালের ১৭ জুলাই থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তার সভাপতিত্বেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল কম্যুনিস্ট পার্টির জাতীয় সম্মেলন । এসব সম্মেলনেই হাজার বছরের সামন্তবাদী প্রথার উচ্ছেদ শুরু হয়েছিল । চীনের ভূমি আইন এ সম্মেলনেই অনুমোদিত হয়েছিল । যা চীনের উত্তরাঞ্চলীয় এলাকায় স্বাধীনতা যুদ্ধকে আরো বেশি বেগবান করে তুলেছিল ।
১৯৪৮ সালের মে মাসে চেয়ারম্যান মাও সে তুং-এর শি বাই পুও আসার পরই কম্যুনিস্ট পার্টির সাবেক ও তার পরবর্তি কমিটি কেন্দ্রীয় কমিটির সংগে একীভুত হয়ে যায় । তখন থেকেই চীনের গণবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে শি বাই পুও'তে তার কর্মকান্ড শুরু করে । এ সময় কমরেড লিউ শাও চি'কে চীনের সামরিক কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় । তিনি আরো দায়িত্ব পান কেন্দ্রীয় মার্কস-লেনিন ইনিস্টিটিউটের ডীন হিসেবেও ।
লিউ শাও চি খুবই সাধা সিধে জীবন যাপন করতেন । তার অফিস কক্ষটি কাউন্সিল চেম্বার এবং সেন্ট্রাল ওয়ার্কিং কমিটির ব্যুরো হিসেবেও ব্যাবহার করা হতো । সে সময় ওয়ার্কিং কমিটির অনেক সভাই তার এ অফিস কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়েছিল । তার অফিস কক্ষে দেখলাম একটি ছোট্ট টেবিল, সাধারণ একটি রিভলবিং চেয়ার, একসেট সোফা ও আনুষঙ্গিক জিনিস পত্র । কমরেড লিউ শাও চি একটি ছোট্ট কাঠের বাক্স ব্যবহার করতেন । যাতে মূল্যবান দলিলপত্র সংরক্ষণ করা হতো । পাশের থাকার কক্ষে দেখলাম দেয়ালে ঝুলানো রয়েছে কমরেড লিউ শাও চি এবং তার স্ত্রী'র একটি যুগল ছবি ।
এরপর আমরা সেখান থেকে সোজা চলে আসি চীনের সাবেক ও জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী চো এন লাই-এর ঘরে । বাংলাদেশের প্রায় সবার কাছেই তার নামটি চেয়ারম্যান মাও সে তুং-এর পরেই খুব জনপ্রিয় । তার ঘরটিও সবার ঘরের মতই । কোথাও কোন কিছুর বাহুল্য নেই । কেমন করে যে তারা এসব ঘরে থাকতেন তা সত্যিই ভাবার বিষয় । দক্ষিণ পাশের পূর্ব দিকের কক্ষটি ছিল চৌ এন লাই'র অফিস কক্ষ এবং পশ্চিম দিকের ঘরটি তার থাকার কক্ষ । এ বাড়িটিতে আরো কয়েকটি ঘর রয়েছে । এসব ঘরগুলো কমরেড দেং ইয়াংছাও, লি থাও এবং ছাং ছিংহুয়া নিজেদের অফিস এবং থাকার জন্য ব্যবহার করতেন।
(সেনা সদস্যদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র )
তখন চৌ এন লাই ছিলেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি সচিবালয়ের সচিব এবং কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান ও একই সঙ্গে সেনা বাহিনীর জেনারেল চীফ অব স্টাফ । যুদ্ধকালিন দিনগুলোয় তাকে খুবই ব্যস্ত সময় কাটাতে হতো । তিনি তখন শুধু চেয়ারম্যার মাও সে তুং ও সেনা বাহিনী প্রধান কমরেড চু'র সংগে যুদ্ধের পরিস্হিতিই তদারকী করতেন না, তাকে সন্মুখ সমরের খবরা খবর নিতে হতো, সামরিক তথ্যাবলী পরীক্ষা করে দেখতে হত এবং বিভিন্ন জায়গায় টেলিগ্রাম পাঠানোর জন্য নির্দেশাবলীর ম্যসেজও তৈরী করতে হতো । তিনি সার্বিক যুদ্ধের সময় নিয়মিত চেয়ারম্যান মাও সে তুংকে শত্রুর প্রতিটি ক্যাম্পের অবস্হান এবং গণবাহিনীর অগ্রযাত্রার খবর সঠিকভাবে জানাতেন । চৌ এন লাই ১৯৪৮ সালে নিজেই কেন্দ্রীয় সংশোধনী শিক্ষা কেন্দ্রে সেনা সদস্যদের দীক্ষা দিতেন এবং তাদের সংগে খোলাঢ়মেলা কথা বার্তা বলতেন । তিনি তাদেরকে আরো বলতেন 'জনগণের সেবার জন্য সত্যিকারের শিক্ষা গ্রহণ করো'। ১৯৪৮ সালের ৩০ জুলাই'র রাতের একটি ঘটনা ছিল খুবই উল্লেখ করার মত । যা কোনদিন ভোলার নয় । সে রাতে প্রচন্ড বৃস্টির মধ্যে বিরামহীন যুদ্ধ চলছিল । এ সময় পাহাড়ের একটি গুহা-ঘর ধ্বসে পড়ে ।
এর নিচে চাপা পড়ে যায় চারজন সহযোদ্ধা । এ খবরটি পাওয়া মাত্রই চৌ এন লাই তাত্ক্ষণিকভাবে রেইন কোট পরে তার টেবিলের বাতি ও একটি বেলচা হাতে নিয়ে তাদের উদ্ধার করতে ছুটে গিয়েছিলেন সেখানে । তিনি অন্য ডরমিটরিগুলোতে থাকা সদস্যদেরও নিরাপদ স্হানে সরিয়ে দেন । তিনি অন্যান্যদের সংগে মিলে তাদের উদ্ধার করেছিলেন । এ রকম অনেক ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, বিপ্লবী সহযোদ্ধাদের প্রতি ছিল তার কতটা আবেগময়তায় ভরা গভীর মমতা । ভাইস চেয়ারম্যান চৌ এন লাই ১৯৪৯ সালের ৫ থেকে ১৩ মার্চ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত কম্যুনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সপ্তম সম্মেলনের দ্বীতীয় বৈঠকের পর চেয়ারম্যান মাও সে তুং-এর সাথে শি বাই পুও থেকে বেইপিং অর্থাত্ আজকের পেইচিংয়ে চলে আসেন । ঘুরে ঘুরে আমরা যতই দেখছি ততই যেন মুগ্ধ হচ্ছি । মুগ্ধ হচ্ছি তাদের কথা ভেবে । ভীড় ঢেলে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম কমরেড চু'র ঘরের দিকে । (চলবে)
আ বা ম. ছালাউদ্দিন ।
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved. 16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040 |