|
চীনের স্বাধীনতা সংগ্রামী সৈনিকদের ভাস্কর্য
রেল স্টেশনের কাছাকাছি একটা মাঝারি পর্যায়ের হোটেলে উঠলাম । এটি হলিডে ইনের একটি চেইন হোটেল । হোটেলে সংগে থাকা মালপত্র রেখে আমরা বেড়িয়ে পরলাম শহরটি ঘুরে দেখার জন্য । রাত প্রায় দশটা পর্যন্ত হেঁটে বেড়ালাম এবং অনেক ছবি তুললাম । এতকিছুর পরেও আমরা একটু উত্তেজিত ছিলাম কখন ভোর হবে আর সবাই মিলে সেখঅনে যাবো । আমাদের কথা ছিল ঠিক ভোর ছ'টায় আমরা হোটেলের নিচ তলার লবিতে অপেক্ষা করবো ড. সুং-এর জন্য । আমরা সবাই প্রস্তুত নিচে নামবো বলে আর ঠিক সে সময় ড. সুং নিজেই উপরে এসে হাজির হলেন । আসলে চীনের সবাই যেন বন্ধুত্ব আর আথিতেয়তায় ভরপুর সরল মানুষ । তার গাড়িতেই আমরা রওয়ানা দিলাম বাস শ্টেশনের উদ্দেশ্য । আমাদের বাসটিই এ যাত্রার প্রথম বাস । হাড় কাঁপানো শীতের আঁধারি আলোয় কুয়াশাচ্ছন্ন পথে ছুটে চললো । শহরের পথ ছেড়ে পাহাড়ী আঁকা বাঁকা প্রশস্ত সড়কের দু'পাশ জুড়ে পত্র পুষ্পহীন গাছগুলো তার উদোম শরীরে নি:সঙ্গতাকে স্বাক্ষী করে দাঁড়িয়ে আছে একটার পর একটা যেন প্রাণহীন । বাসের জানালা দিয়ে আমাদের খুব ইচ্ছে ছিল ছবি তোলার, কি আর হবে, এ সি বাসের জানালার কাঁচ জলীয় বাস্পে ঘোলাটে হয়েই থাকলো বেশির ভাগ সময় । মাঝ পথে ছোট্ট একটা কাউন্টিতে দাঁড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণের জন্য । এই ফাঁকে বাস থেকে নেমে সবার সকালের নাস্তার জন্য কিছু কেক বিস্কুট ও পানি কিনলাম । আর এর ফাঁকে কয়েকটা ছবিও তুলে নিলাম । ঘন্টাখানের পর সকালের আলোয় সব কিছু পরিস্কারভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠলো । যেতে যেতে দেখলাম পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝর্ণা ধারার পানিকে আটকে রেখে সেচ সুবিধার কাজে লাগানোসহ বিদ্যুত তৈরি করছে । সব কিছুই যেন সাজানো গোছানো । শীতের আমেজে পাহাড়ের রং তামাটে হলেও তা সত্যিই দৃষ্টি নন্দন । শি বাই পোও যত কাছে এগিয়ে আসছে ততই যেন আমার সংগী চারুশিল্পী ও ফটো সাংবাদিক-এর উত্তেজনাও বেড়ে যাচ্ছে । শি বাই পোও যেতে অনেকগুলো পাহাড়ী টানেলের মধ্য দিয়ে যেতে হয় । কয়েকটি বেশ বড় ধরনের টানেল । বেশ রোমাঞ্চকর । সকাল ন"টার সময় আমরা কাঙ্খিত স্হানে পৌঁছে গেলাম । স্হানীয় কয়েকটি মেয়ে এসে পরিস্কার ইংরেজিতে আমাদের জিজ্ঞেস করলো গাইড লাগবে কি না ? আমি যেহেতু আগেরবার এসেছিলাম তাই আমরা নিজেরাই হাঁটা দিলাম ধীর পায়ে । প্রথমেই আমাদের সামনে পড়লো জাতীয় বীর শহীদদের স্মরণে পাহাড়ী চূড়ায় নির্মিত বিশালাকায় স্মৃতি স্তম্ভটি । পাশ দিয়ে আমরা নেমে গেলাম সোজা ভাষ্কর্য বাগানে । এখানে শি বাই পোও'তে যে সব সংগ্রামী নেতারা ছিলেন তাদের ভাষ্কর্য নিখুঁতভাবে তৈরী করে রাখা হয়েছে । একটু দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন জ্বলজ্যান্ত মানুষগুলোই দাঁড়িঁয়ে বা বসে আছে । চৌ এন লাইয়ের পরিবারের ভাষ্কযের পাশে দাঁড়িয়ে নিজেই একটা ছবি তুললাম । এ যেন অপার আনন্দ আর আবেগের বহি:প্রকাশ । চারদিকে অসংখ্য পাহাড়ের পর পাহাড় । এটিকে আবার ঘীরে রয়েছে বিশাল এক লেক বা জলাধার । দেখলে মনে হয় কোথাও কোথাও সাগরের মত । তার মাঝে এই মুক্তাঞ্চল । এখানেই ছিল চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদর দপ্তর । এত সাদা মাটা যে তা এখানে না আসলে কল্পনাও করা যাবে না । একটি কথা এখানে বলে রাখা ভালো যে এ বিশাল পাহাড়ী এলাকার নিম্নাংশ ১৯৫১ সালের ভয়াবহ বণ্যায় ডুবে যায় । পরবর্তি সময় এটিকে জলাধার হিসেবে সংরক্ষণ করা হয় । মহান নেতা চেয়ারম্যান মাও সে তুং অবশেষে এটিকে জলাধার হিসেবে রাখার সম্মতি দিয়েছিলেন । আর এর নিচেই কিন্তু রয়েছে মূল সদর দপ্তরের বেশির ভাগ ঘর বাড়ি আর যুদ্ধকালিন ইতিহাস। যার অনেক কিছুই উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি । এটিও কিন্তু ইতিহাস । আমরা যা দেখবো তার কিছু অংশ অর্থাত আবাসন ব্যবস্হার অবিকল নকল । তবে যুদ্ধের সময় ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহৃত জিনিস এবং ঐতিহাসিক দলিলাদী ও যুদ্ধ সরন্জাম উদ্ধার করে বর্তমান জাদুঘরে এবং নির্ধারিত স্হানে রাখা হয়েছে । পাহাড়ের ওপর নতুন করে হুবুহু একই রকম নির্মিত হয়েছে প্রশাসনিক দপ্তর, কম্যুনিস্ট পার্টির নেতাদের ঘর বাড়ি, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, সিনহুয়া বার্তা সংস্হার দপ্তর এবং অন্যান্য আনুসঙ্গিক অবস্হান । পাহাড়ের অভ্যন্তরে যেখানে যে অবস্হায় ছিল হুবুহু ঠিক সে অবস্হায়ই রাখা হয়েছে । মাও সে তুংসহ পার্টির নেতারা যে অবস্হায় থাকতেন ঠিক সেভাবেই তাদের বিছানা পত্র, চেয়ার টেবিল ও দাপ্তরিক জিনিস সব কিছুই সংরক্ষণ করা হয়েছে নিখুঁতভাবে। সব কিছুই আসল শুধুমাত্র গৃহটি ছাড়া । ভাবতে অবাক লাগে যে এমন একজন মহান নেতা জাকজমকহীন সবার মত অর্থাত্ একেবারেই সাধারণ মানুষের মত জীবন যাপন করে নেতৃত্ব দিয়েছেন দৃঢ়তার সংগে ১৩০ কোটি মানুষের এ বিশাল দেশটির স্বাধীনতার জন্য । এ যেন নির্লোভ আর সততার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত । আসলে মহান নেতৃত্বের এ এক অবিস্মরণীয় দিক । এখানে একটা কথা উল্লেখ করতে হয় যে চেয়ারম্যান মাও সে তুং তার সারা জীবনে কোনদিন কখনো নিজের কাছে একটি কপর্দকও রাখেন নি । এট সবাই জানেন যে তিনি যুদ্ধের শুরু থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কোনদিন কোন কিছুই নিজ হাতে কেনা কাটা করেন নি ।এ জলাধারের নিচে রয়েছে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সদর দপ্তর
আমরা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সর্পিল পথে এগুতে থাকলাম অদম্য ও অস্হিরতার আবেগে মহান নেতার যুদ্ধকালীন যুদ্ধ পরিচালনা কেন্দ্রের দিকে । ( চলবে )
--আবাম ছালাউদ্দিন
![]() |
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved. 16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040 |