|
সারা বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে এখন প্রাণীকূলকে রক্ষার জন্য ইতিবাচক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ আন্দোলনে সরকার ও জনগণ একসাথে মিলে চেষ্টা করছে যাতে পশু পাখিরা এ বিশ্ব চরাচর থেকে হারিয়ে না যায়, অর্থাত্ বিলুপ্ত না হয়ে যায়। ইতোমধ্যেই বিশ্বের বহু পশু প্রাণী চিরকালৈর জন্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যাদের আর কোনদিন খুঁজে পাওয়া যাবে না। ক্রমবর্ধনশীল মানুষের কারণেই আজ পৃথিবী থেকে একের পর এক প্রাকৃতিক বন ও বনাঞ্চল ধংস হয়ে গড়ে উঠছে আবাসভূমি আর শিল্পকারখানা। গড়ে নগর ও বন্দর। অপরদিকে চোরাকারবারী ও নির্দয় শিকারীদের হাতেও মারা পড়ছে অকাতরে। নিরাপদ আশ্রয়স্থল ও নিরাপত্তার অভাব এবং বিশেষভাবে তাদের খাদ্যের প্রকট অভাবের মোকাবেলা করতে গিয়েই নিশ্চিত বিলুপ্তির পথে হাটছে পশু প্রাণীরা। এর প্রভাব বাংলাদেশ ও ভারতের ওপরও পড়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল রয়েছে এ দু'টি দেশেই। এখানেও প্রাণীরা মত্স্য ও প্রাণীকূলেরা যেন অনেকটাই অসহায়। তবে বাংলাদেশ ও ভারত সরকার ইদানিং বনাঞ্চল রক্ষাসহ প্রাণীকূলকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার জন্য ইতিবাচক কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। যা কি না প্রশংসার দাবীদার।
সম্প্রতি ভারতের পশ্চিম বঙ্গ সরকার সুন্দরবনের তাদের এলাকার বাঘ রক্ষা ও নিরাপদ বিচরণের জন্য কয়েকটি গ্রামের মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। একই সাথে নিরাপত্তা ব্যবস্থাও জোরদার করেছে। এর ফলে শুধু বাঘ নয় পাখিসহ অন্যান্য প্রাণীরাও কিছুটা হলেও নিরাপদ বোধ করবে।
ওদিকে বাংলাদেশেও কিছুদিন আগে সরকারীভাবে বাঘ রক্ষার জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তারা বাঘ রক্ষা কমিটিও করেছে। এছাড়া সুন্দরবন এলাকায় রয়েছে বিশ্বের কিছু বিরল প্রজাতির ডলফিন।
বিশ্বের বিলুপ্ত প্রজাতির ডলফিনের তালিকার মধ্যে রয়েছে ইরাবতি ডলফিনসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন। যা এখন সুন্দরবন এলাকার নদ নদীতে দেখা যায়। এদের রক্ষার জন্যই বাংলাদেশ সরকারের বন বিভাগ সুন্দরবনের ৩১ কিলোমিটার নদী ও শাখা নদীকে এদের জন্য অভয়াশ্রম ঘোষণা করেছে। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এ অঞ্চলের নদ-নদীতে চরে বেড়ানো ৯ হাজার ডলফিনের জন্য এ অভয়াশ্রম ঘোষণা করেছে। এ অভয়াশ্রম ঘোষণার ফলে এখন সুন্দরবনের তিনটি পয়েন্টের ৩১ কিলোমিটার নদী ও শাখা নদীতে জাল ফেলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের ডিএফও জানান, আড়াই বছর আগে ইরাবতি ডলফিন ছিল বিশ্বের বিলুপ্ত প্রজাতির তালিকায়। বাংলাদেশের জলসীমার সুন্দরবন অঞ্চলে এ ইরাবতি ডলফিনের সন্ধান মেলে। বিশ্বের সর্বোচ্চ সংখ্যক ইরাবতি ডলফিন রয়েছে বাংলাদেশের এই বনের নদ-নদীতে। বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের নদ-নদী, সুন্দরবন উপকূল ও বঙ্গোপসাগরের সোয়াস অব নো গ্রাউন্ডসহ ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত গভীর সমুদ্রে রয়েছে ৫ হাজার ৪০০ ইরাবতি ডলফিন। শুধু ইরাবতি ডলফিনই নয়—বাংলাদেশের এ জলসীমায় আরও রয়েছে ৬ প্রজাতির ডলফিন। সুন্দরবনের এ ৩টি এলাকা হচ্ছে, সুন্দরবনের পূর্ব-উত্তর কোনে ঘাগরামারী ক্যাম্প হতে ঢাংমারী স্টেশন হয়ে করমজল পেট্রল পোস্ট পর্যন্ত ১০ দশমিক ১ কিলোমিটার চ্যানেল, মংলা বন্দরের নিচে সুন্দরবনের জোংড়া পেট্রল পোস্ট থেকে পশুর নদী হয়ে নন্দবালা ও মৃগামারী ক্যাম্প বরাবর শ্যাওলা নদী দিয়ে আন্ধারমানিক ক্যাম্প পর্যন্ত এবং উরুবুনিয়া খাল হয়ে চাঁদপাই খাল থেকে ১৫ দশমিক ৮ কিলোমিটার চ্যানেল, দুধমুখী ক্যাম্প সংলগ্ন খালের ২ কিলোমিটার উত্তরে বেতমারী খাল থেকে বড়শিয়ালা খাল ও দক্ষিণে ভোলা নদী পর্যন্ত ৫ দশমিক ৫ কিলোমিটার অর্থাত্ সুন্দরবনের সর্বমোট ৩১ দশমিক ৪ কিলোমিটার নদী ও খাল। এই অভয়াশ্রম ঘোষণার পর এ এলাকায় যে কোন ধরনের জাল ফেলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের ডিএফও আরও জানান, আড়াই বছর আগে ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটি, এনওয়াই ও বাংলাদেশ সিটাসিন ডাইভারসিটি প্রজেক্টের দেশি-বিদেশি প্রাণী বিশেষজ্ঞরা যৌথভাবে সুন্দরবনসহ বঙ্গোপসাগরে ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে বিলুপ্ত প্রজাতির ইরাবতিসহ ৬ প্রকার ডলফিন ও ১ প্রকার তিমির সন্ধান পায়। ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটি, এনওয়াই ও বাংলাদেশ সিটাসিন ডাইভারসিটি প্রজেক্টের প্রাণী বিশেষজ্ঞ রুবায়েত মনসুর জানান, বিলুপ্ত প্রজাতির ইরাবতি ডলফিনের চারণক্ষেত্র আবিষ্কারের সময় সুন্দরবনসহ উপকূলীয় ওই এলাকায় আরও ৫ প্রজাতির ডলফিন ও ১ প্রজাতির তিমির সন্ধান মেলে। ইরাবতী ছাড়া অন্য ডলফিনের মধ্যে রয়েছে ইন্দো-প্যাসেফিক হাম্প ব্যাক্ট ডলফিন, ফিনলেজ ডলফিন, ইন্দো-প্যাসেফিক বটল নোস ডলফিন, স্পিনার ডলফিন, স্পটেড ডলফিন ও গ্যাংগেজ রিভার ডলফিন ছাড়াও রয়েছে ব্রাইডস হোয়েলস নামের এক প্রজাতির তিমি। অনুসন্ধানে ডলফিনের এই নতুন চারণক্ষেত্রের সন্ধান মেলায় গোটাবিশ্বেও ডলফিন ইরাবতির চারণক্ষেত্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
প্রাণী বিশেষজ্ঞদের যৌথ অনুসন্ধান জরিপ রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, এই ডলফিন চারণক্ষেত্র সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের নদ-নদীসহ বঙ্গোপসাগরের সোয়াস অব নো গ্রাউন্ডে বিশ্বের সর্বোচ্চ সংখ্যক বিলুপ্ত প্রজাতি ইরাবতি ডলফিন রয়েছে ৫ হাজার ৪০০টি। এছাড়াও এই জলসীমার ১৩টি স্পটে ৪০টি ইন্দো-প্যাসিফিক হাম্প ব্যাক্ট ডলফিনের দেখা পাওয়া গেছে। উপকূল থেকে ১১ মাইল সুন্দরবনের মধ্যে ১ হাজার ৩৮২টি ফিনলেস ডলফিন, ১ হাজার ইন্দো-প্যাসিফিক বটল নোস ডলফিন, সুন্দরবন উপকূলের ১৪টি স্পটে সন্ধান মিলেছে স্পিনার ডলফিনের। তবে স্পিনার ডলফিনের কোনো সংখ্যা জরিপ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়নি। সুন্দরবন উপকূলের ৮টি স্পটে সন্ধান মিলেছে ৮০০টি স্পটেড ডলফিনের ও সুন্দরবনসহ উপকূলের ১৩টি স্পটে ২২৫টি গ্যাংগেজ রিভার ডলফিন দেখতে পাওয়া গেছে। এছাড়া ব্রাইডস হোয়েলস প্রজাতির ৫০টি তিমির দেখা মিলেছে। প্রাণী বিশেষজ্ঞদের নতুন এই তিমি চারণক্ষেত্রের সন্ধান লাভের খবরটি বিশ্বের সব পশু ও পাখি প্রেমিকদের দারুণভাবে উত্সাহিত করেছে।
এটা ঠিক যে আজ সারা বিশ্ব প্রাণী বৈচিত্রকে রক্ষায় নতুন নতুন উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে। এটা আমাদের সবার জন্য সত্যিকার অর্থেই আশাব্যঞ্জক। এ ধারা বিশ্ব জুড়ে অব্যাহত থাকুক এ আমাদের কামনা।-আবাম।
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved. 16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040 |