ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার মিতালী লিসনার্স ক্লাবেরএকই ক্লাবের শিভেনদু পাউল চীনের সুন্দরতম ভূমি-সিচুয়ান শিরোনামে একটি রচনা লিখেছেন। তিনি এমন লিখেছেন, কল কল ছল ছল শব্দে এঁকে বেঁকে বয়ে চলা চারটি নদীর সুন্দর প্রদেশ সিচুয়ান। ইয়াংশি নদীর উত্স স্থলের এ প্রদেশটির আয়তন পাঁচ লাখ সত্তুর হাজার বর্গ কিলোমিটার। চীনের বৃহত্তম প্রদেশগুলের মধ্যে এটি অন্যতম একটি প্রদেশ। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে এটি তিন হাজার মিটার উঁচুতে অবস্থিত হলেও এর সর্বোচ্চ চূড়ার উচ্চতা হচ্ছে ৭৫৫৬ মিটার। প্রদেশটির রাজধানী ছেং তু ইয়াংশি নদীর আববাহিকার সমতল ভূমিতে অবস্থিত। সারা চীনের মধ্যে এ প্রদেশের 'দুচিয়াংইয়ান' সেচ পদ্ধতির মাধ্যমে সারা বছরই ফসল উত্পাদন করা সম্ভব হচ্ছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ছ'লাখ হেক্টর জমি নির্বিঘ্ন চাষের আওতায় রয়েছে। প্রদেশটির উত্তর পশ্চিম দিক থেকে ঢালু হয়ে দক্ষিণ পূর্ব দিকে নেমে গেছে। সিচুয়ান পর্যটকদের জন্য ভূস্বর্গ হলেও এখানে রয়েছে গাছ পালা ও বিভিন্ন প্রাণীর সম্মিলনে এক মোহনীয় প্রাকৃতিক পরিবেশ। এখানকার তেরটি জলাধার খাড়া বাঁশের বনে মনোহারিনী পান্ডার ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য সত্যিই বিশ্ববাসীর দৃষ্টিকে কেড়ে নিয়েছে। সব মিলিয়ে এ প্রদেশটিতে এক হাজার তিনশ' নদী রয়েছে। অন্যতম নদীগুলোর মধ্যে হেই হা, পেই হা এবং চিসছুই নদী হোয়াং হা'তে এসে মিশেছে। বাকী নদীগুলো ইয়াংশি নদীতে এসে মিশেছে। আসলে এ প্রদেশটি পানি সম্পদে সমৃদ্ধ। সিচুয়ানের আবহাওয়া বৈবিত্রময়। এখানে শীতকালীন উষ্ণতা, গ্রীষ্মকালীন উত্তাপ, দ্রুত বসন্তের ছোঁয়া এবং দীর্ঘ সময়ের বরফের আচ্ছাদন। রয়েছে সারি সারি পাহার আর অসংখ্য গিরিপথ। সিচুয়ান হচ্ছে বহুজাতিক মানুষের আবাসভূমি। এ প্রদেশে ১৫টি ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠি রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ছিয়াং, ঈ, মিসো, হুই, মঙ্গোলীয়, চাং ( যারা তিব্বত থেকে এসে বসবাস করছে), থুচিয়া, বউইয়েই, লিসু, নাশি, পাই, মান্চু, চুয়াং এবং তাই। যদিও এসব জাতি গোষ্ঠিগুলোর নিজ নিজ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রয়েছে; তারপরও তারা সবাই একসাথে মিলে মিশে শান্তি ও সম্প্রীতির ভেতর বসবাস করছে। তারা সবাই মিলে জাতীয় বীর যোদ্ধাদের জয়গাথার ওপর হান ও ছিয়াং জাতির নিবিড় ঐক্যবদ্ধতায় সমবেত কন্ঠে গান গায়। সিচুয়ানের রাজধানী ছেং তু হচ্ছে পর পর তিন সাম্রাজ্যের রাজধানী। এর রয়েছে দু'হাজার বছরের ইতিহাস। এখানে কবি দু ফু'র স্মরণে রয়েছে একটি পার্ক এবং একটি বিখ্যাত মন্দির, যেটি ষষ্ঠ শতকে নির্মিত হয় রাষ্ট্র প্রধান ও খ্যাতিমান পরিসংখ্যানবিদ মারকুইস উয়ো'র স্মরণে। থাং ডাইনাস্টির আমলের একটি পার্ক ছাড়াও চিড়িয়াখানায় রয়েছে ১০ট বড় পান্ডা ও সোনালী চুলের বানরসহ ২০০ প্রজাতির পশু প্রাণী। সিচুয়ানের রয়েছে নিজস্ব স্টাইলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এখানকার ইমেই পাহাড়কে বলা হয়ে থাকে স্বর্গের পর পৃথিবীর সুষমাময় সৌন্দর্য। ছিনছাং পাহাড় হচ্ছে বিশ্বের মধ্যে নেশা ধরানো প্রাকৃতিক দৃশ্যের ভূমি। চিয়ানমেন পাস আর ইয়াংশি গিরিখাত পর্যটকের চোখ ধাধিয়ে দেয়। ছেং তু থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ড্রাগন সংরক্ষণ পার্ক। এখানে আরো রয়েছে শহর থেকে প্রায় ২৪০ কিলোমিটার দূরে ডাইনোসর জাদুঘর। সিচুয়ান প্রদেশের পূর্বাঞ্চলীয় শহর তাজু'তেই রয়েছে ৫০ হাজারেরও বেশি প্রাচীনদ পাথরের ভাষ্কর্য। যেসব ভাষ্কর্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ৪০টি স্থানে। থাং ও সুং ডাইনাস্টির এসব ভাষ্কর্যের বেশির ভাগই পাওতিং এবং উত্তরের পাহাড়ের সৌন্দর্য বর্ধন করে আছে। এছাড়াও আছে বিষ্ময়কর এক হাজার হাতের ক্ষমার দেবী এবং ৩১ মিটার লম্বা ঘুমন্ত বুদ্ধের ভাষ্কর্য। এ দু'টি ভাষ্কর্য ৮৯২ সাল থেকে শুরু করে তিনশ বছর লাগে তা নির্মাণ কাজ শেষ করতে। সিচুয়ানের এত বেশি দৃষ্টি নন্দন সব দেখার ও উপলব্ধি করার স্থান রয়েছে যা লিখে শেষ করা যাবে না। একটির কথা না বললেই নয়। তা হলো উয়োহুয়া হাই তার অর্থ হলো পাঁচটি ফুলের নদী। এটিকে বিশ্বের অন্যতম আশ্চর্য্যও বলা হয়ে থাকে। এর পাশাপাশি ১০০ মিটার চওড়া ৩০ মিটার উচ্চতা সম্পন্ন জলপ্রপাত। যার অতি স্বচ্ছ পানিতে পাখির ডুব সাঁতার খুব ভালোভাবেই দেখা যায়। সত্যি কথা বলতে কি সিচুয়ান হচ্ছে রূপকথার পরীর দেশের মত একটি মন ভোলানো দেশ।
হুগলি জেলার নিউ হোরাইজন রেডিও লিসনার্স ক্লাবের সেক্রেটারি রবী শংকর বসু ওহ, মোহনীয় সিচুয়ানের ডাক শিরোনামে একটি রচনা লিখেছেন। তিনি এমন লিখেছেন, নি হাও। প্রিয় সিআরআই উপস্থাপকবৃন্দ আন্তরিকভাবে আশা করি আপনারা সবাই ভাল আছেন। আমি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার বোমনগর নমের এক প্রত্যন্ত গাঁয়ে বাস করি। ১৯৮৫ সালের শেষ দিকে শর্টওয়েভে একদিন আমি সিআরআইকে খুঁজে পাই। সেই থেকে প্রতিদিন সিআরআই'র ইংরেজি, হিন্দি ও বাংলা অনুষ্ঠান শুনে আসছি। এক কথায়, সিআরআই গত ২৫ বছর ধরে আমার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে হয়ে রয়েছে। আমি ৪০টি বসন্ত পার করে এসেছি এবং অংগীকার করছি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত আমি সিআরআই'র সঙ্গে থাকব। সিআরআই আমার হৃদস্পন্দের মতো। আমি এ বেতারের অধিকাংশ অনুষ্ঠানই পছন্দ করি। আপনাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান আমাকে সিআরআই'র একজন একনিষ্ঠ শ্রোতায় পরিণত করেছে। প্রতিরাতে সিআরআই'র মাধ্যমে আমি চীনের হৃদস্পন্দন উপলব্ধি করি। প্রাইভেট টিউশন থাকার কারণে আমি সকালে এ বেতারের অনুষ্ঠান শুনতে পারিনা। আমার স্বপ্নরাজ্য চীনকে জানার জন্য আমি তিনটি জানালা ব্যবহার করি। সেগুলো হল: (১) চীন আন্তর্জাতিক বেতার, (২) মেসেঞ্জার ও (৩) সিআরআই ইংরেজী ওয়েবসাইট। সিআরআই'র সঙ্গে গত ২৫ বছরের সংশ্লিষ্টতায় আমি মাতৃভূমির পরেই চীনকে আমার ভালবাসার স্থান দিয়েছি। এই তিন জানালা দিয়ে চীনা সংস্কৃতির রহস্যময়তা, চীনের ব্যাপক আধুনিকায়ন ও গত ৬০ বছরের পরিবর্তন দেখে আমি আবিভূত হয়েছি। আমি আনন্দের সঙ্গে জানাতে চাই যে, বছরের পর বছর সিআরআই'র বিশ্ব জ্ঞান যাচাই প্রতিযোগিতা ব্যাপক আবেদন সৃষ্টি করে চলেছে। কবিতার অদৃশ্য ডানায় ভর করে আমি চীনের সর্ববৃহত্ ও সবচেয়ে দূর্গম দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সিচুয়ান প্রদেশ দুবার ভ্রমণ করেছি -- প্রথমবার ২০০৬ সালে এবং দ্বিতীয়বার ২০০৯ সালে। আপনাদের বেতার আয়োজিত "সিচুয়ান: বিশালকায় পান্ডার জন্মস্থান শীর্ষক জ্ঞান যাচাই প্রতিযোগিতা ২০০৬" এবং "আকর্ষণীয় সিচুয়ান জ্ঞান যাচাই প্রতিযোগিতা ২০০৯"-এর ধারাবাহিক প্রতিবেদন শুনে আমি সৌন্দর্যময় সিচুয়ান প্রদেশ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। আপনাদের প্রতিবেদন কল্পনায় মোহনীয় সিচুয়ান দেখতে আমাকে সাহায্য করেছে। এছাড়া আপনাদের ওয়েবসাইটও কল্পচোখে সিচুয়ানের তরঙ্গায়িত সুউচ্চ চূড়া, গর্জনমুখর জলপ্রপাত, ঘন বন, বিশাল বাঁশগাছ, সুগন্ধি ফুল, পর্বত, মঠ, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির জীবনধারা, লোক রীতিনীতি, বৃহদাকার পান্ডার অভয়ারণ্য, লেশাসের বৃহদাকার বুদ্ধ ও স্বর্গতুল্য চিউচাইকুও উপত্যাকা দেখতে আমাকে সাহায্য করেছে। সত্যি বলতে কি, সিচুয়ান এক সৌন্দর্যের আধার এবং সেখানকার অধিবাসীরা অত্যন্ত বন্ধুবাত্সল। আজ আমি আমার মনশ্চক্ষে দেখা সিচুয়ানের বর্ণনা শোনাবে আপনাদেরকে। আমি সিচুয়ানের ৫২টি আদিবাসী জাতিকে জানার চেষ্টা করি। এই জাতি গোষ্ঠিগুলো তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও জীবনধারা, স্ববৈশিষ্টময় লোক ঐতিহ্য ও উত্সবগুলোকে লালন-পালন ও সংরক্ষণ করে চলেছে, যা কিনা কেবল সিচুয়ানেই দেখা যায়। স্বর্গতুল্য সিচুয়ান ভ্রমণকালে আমি ইয়ি আদিবাসী জাতির মশাল উত্সব ও চিকং লন্ঠন উত্সবে যোগ দিতে ভুলিনি। ২০০৬ ও ২০০৯ সালে সিআরআই'র বিশ্বব্যাপী জ্ঞান যাচাই প্রতিযোগিতার সাফল্যের কল্যাণে এবং তার গর্বের বিষয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সৌন্দর্যময় মন্দির ও মঠ এবং প্রিয় পান্ডার জন্য সিচুয়ান আমাদের কাছে প্রতিদিনের নামে পরিণত হয়েছে। আমি জানি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক স্থানের পাশাপাশি সিচুয়ানে রয়েছে বহু পর্যটক আকর্ষক স্থান যা আমার মতো শ্রোতাদেরকে সিচুয়ানে টানে। সিচুয়ানের যে জিনিসটি আমাকে সর্বপ্রথম আকর্ষণ করে তা হল সেখানকার মোহনীয় সৌন্দর্য আর দ্বিতীয় হল সেখানকার মানুষের অতিথিপরয়াণতা। 'প্রাচুর্যেভরা ভূমি' নামে খ্যাত সিচুয়ানের প্রাণীকূল এ বৈচিত্রময় বিস্তীর্ণ ভূমির প্রতি একজন শ্রোতা অবশ্যই টান অনুভব করবেন। বলতে আমার কোন দ্বীধা নেই, সিআরআই'র একজন নিয়মিত শ্রোতা এবং এর ইংরেজি বিভাগের ওয়েবসাইটের পাঠক হিসেবে আমার মতো বিষয়হীন শ্রোতারা কোন পয়সা ব্যয় না করেই সিচুয়ানকে জানতে পেরেছে। কল্পনায় আমি যত জায়গা বেড়িয়েছি আমার দৃষ্টিতে তার প্রত্যেকটিরই নিজস্ব বৈশিষ্ট রয়েছে। শারীরিকভাবে কখনও সিচুয়ান না গিয়ে কল্পচোখে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ছেংতু শহরের ১৬০ কিলোমিটার দূরে এ্যামেই পাহাড় দেখা থেকে শুরু করে, পৃথিবীর স্বর্গ চিউচাইকুওর যাদুর পানি উপভোগ করা, সান সিংতুইয়ের ২০০০ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক তাম্র তৈজসপত্র দেখা, বন্ধুবাত্সল সিচুয়ানবাসীদের সঙ্গে ছেংতু শহরে ছুয়ান অপেরার বিখ্যাত 'মুখ বদল' কৌশল উপভোগ করা এবং অবশেষে চীনকে সবচেয়ে নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নেয়া সিচুয়ানের প্রতীকরূপী আদুরে বৃহদাকার পান্ডা দেখা পর্যন্ত পুরো সফরটি ছিল সারাজীবনের একবারের এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। আকষ্মিক আমি বাস্তবজগতে ফিরে আসি এবং নিজেকে এক চন্দ্রালোকিত রাতে নিজের মাটির তৈরি ঘরে বিছানায় আবিস্কার করি। জন কিটসের কবিতা একটু বদলে আমি বলতে চাই: "সিচুয়ান, ও আমার প্রবঞ্চক পরী! আমি তোমার কাছে উড়ে আসব। এটা কি কল্পনা ছিল, নাকি দিবাস্বপ্ন? আমি কি জেগে আছি, নাকি ঘুমিয়ে?" আমি সিচুয়ান ও আপনাদের সৌন্দর্যমন্ডিত দেশ চীন ভ্রমণ করতে চাই। আমি অত্যন্ত আনন্দিত হব যদি সিআরআই'র জ্ঞান যাচাই প্রতিযোগিতার প্রথম শ্রেণীর পুরস্কার লাভ করতে পারি।