Web bengali.cri.cn   
সেনইয়াংয়ের রাজপ্রাসাদের কাহিনী
  2011-07-25 19:49:17  cri
উত্তরপূর্ব চীনের সেনইয়াং শহরেও একটি রাজপ্রাসাদ আছে। আকার ও রক্ষণাবেক্ষণের দিক থেকে চীনের রাজকীয় স্থাপত্যগুলোর মধ্যে পেইচিংয়ের রাজপ্রাসাদের পরই এটার স্থান। সেনইয়াং রাজপ্রাসাদ মান জাতির রাজা নির্মাণ করেছিলেন। এই প্রাসাদের ইতিহাস আর তার সংখ্যালঘু জাতির বৈশিষ্ট্য সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

উত্তর-পূর্ব চীনের লিয়াওনিং প্রদেশের রাজধানী সেনইয়াংয়ের পুরনো নগরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সেনইয়াং রাজপ্রাসাদ ছিং রাজবংশেরও রাজপ্রাসাদ ছিলো। এই প্রাসাদের ইতিহাস বৈশিষ্ট্যময় বলা যায়। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে চীনের উত্তর-পূর্ব ভ্রাম্যমাণ মান জাতি চিং রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। এরপর চিং রাজ্যের রাজা নুরহাছি সেনইয়াংকে চিং রাজ্যের রাজধানী হিসেবে নির্ধারণ করেন এবং সেনইয়াংয়ে রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করার নির্দেশ দেন। নুরহাছির ছেলে হুয়ান থাইচি রাজা হওয়ার পর রাজ্যের নাম ছিংয়ে পরিবর্তন করেন এবং রাজপ্রাসাদের নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করেন। এটাই সেনইয়াং রাজপ্রাসাদ। ছিং রাজবংশের প্রথম দুজন রাজা হুয়ানথাইচি ও ফুলিন সেনইয়াং রাজপ্রাসাদে রাজা হয়েছিলেন। পরে ছিং বাহিনী মধ্য চীনে গিয়ে মিং রাজবংশের পতন ঘটিয়ে চীনের নতুন প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করে। সেই সময় ছিং রাজবংশের রাজধানী সেনইয়াং থেকে পেইচিংয়ে স্থানান্তরিত হয়। ওই সময় থেকে ছিং রাজবংশের রাজারা পেইচিংয়ের রাজপ্রাসাদে বসবাস করতে শুরু করেন। সেনইয়াং ছিং রাজবংশের বিকল্প রাজধানী আর সেনইয়াং রাজপ্রাসাদ বিকল্প রাজধানীর রাজপ্রাসাদে পরিণত হয়।

সেনইয়াং রাজপ্রাসাদের আয়তন ৬০ হাজার বর্গমিটার। এতে ৭০টির বেশি স্থাপত্যের মধ্যে তিন শ'রও বেশি ঘর আছে। চীনের ঐতিহ্যবাহী রাজপ্রাসাদের তুলনায় সেনইয়াং রাজপ্রাসাদের বৈশিষ্ট্য হলো এই প্রাসাদের ঘন ভ্রাম্যমাণ জাতির স্থাপত্য শৈলী। সেনইয়াং রাজপ্রসাদের স্থাপত্যগুলো মধ্য, পশ্চিম ও পশ্চিম - এ তিন ভাগে বিভক্ত। এই তিন ভাগের স্থাপত্যের মধ্যে পূর্ব ভাগের স্থাপত্য সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যময়। পূর্ব অংশের প্রধান স্থাপত্য হলো তাচেন হল, এটা হলো রাজার দৈনন্দিন প্রশাসনিক কাজের আর বড় অনুষ্ঠানের আয়োজনের হল। এই বড় হলের দুই পাশে দশটি প্যাভিলিয়ান আকারের ক্ষুদ্র হল আছে। এই দশটি ক্ষুদ্র হল উত্তর থেকে দক্ষিণে দুই দল বড় পাখি উড়ার আকারে নির্মিত হয়েছে। এটাই সেনইয়াং রাজপ্রসাদের সিওয়ানথিন। এই দশটি প্যাভিলিয়ন দশজন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। আসলে রাজার অবস্থান করা তাচেন হলও একটি বড় প্যাভিলিয়ন, তবে এই প্যাভিলিয়ানের আকার বড়, ভিতরের সাজসজ্জা সুন্দর বলে তাকে প্রাসাদ বলা হয়েছে। তাচেন হল ও সিওয়ানথিনের স্থাপত্যশৈলী ভ্রাম্যমাণ জাতির তাবু থেকে নেওয়া। এই এগারটি প্যাভিলিয়ান এগারটি তাবুর প্রতীক। ভ্রাম্যমাণ তাবু থেকে স্থায়ী প্যাভিলিয়ানে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়ায় ভ্রাম্যমাণ জাতির সংস্কৃতির বিকাশ প্রতিফলিত হয়েছে।

  সেনইয়াং রাজপ্রাসাদে মান জাতির রীতিনীতি সম্পর্কিত জিনিস দেখার মতো। যেমন রাজপ্রাসাদের মধ্যভাগের ছিংনিন প্রাসাদের বড় দরজার সামনে একটি সাত মিটার লম্বা কাঠের দণ্ড খাড়া করে রাখা আছে। দামি পাথরের মঞ্চের উপর খাড়া করা এই দণ্ডের উপরিভাগে টিনের তৈরি একটি পাত্র আছে। সুন্দরভাবে সাজানো রাজপ্রাসাদে এই ধরনের একটি কাঠের দণ্ড যেন চারপাশের রাজকীয় স্থাপত্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। কিন্তু এই দণ্ড কোনো সাধারণ দণ্ড নয়। এটির নাম সোলুন দণ্ড; মান জাতির মানুষ আকাশের প্রতি শ্রদ্ধাতর্পন ও প্রার্থনার সময় এই দণ্ড ব্যবহার করে। মান জাতির রীতি অনুসারে আকাশের প্রতি শ্রদ্ধাতর্পন করার সময় দণ্ডের উপরিভাগের টিনের পাত্রে চাউল ও শুকরের নাড়িভুড়ি রাখতে হবে। এইসব খাবার কাকের জন্য রাখা হয়। এই রীতির একটি উপকথাও আছে। উপকথায় বলা হয়েছে, ছিং রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নুরহাছি রাজা হওয়ার আগে একবার বিপদে পড়েছিলেন। পিছনে শত্রুরা তাঁর পিছু ধাওয়া করেছিল, কিন্তু তিনি পালানোর পথ পাচ্ছিলেন না। কোনো উপায় না দেখে নুরহাছি ঘাসের উপর শুয়ে পড়েন। ঠিক এমন সময় একদল কাক তাঁর গায়ের উপরে পড়ে তাঁকে পুরোপুরি ঢেকে রাখে। নুরহাছিকে দেখতে না পেয়ে শত্রুরা চলে যায়। তিনি বিপদ থেকে মুক্তি পান। পরে নুরহাছি ছিং রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে রাজা হন। কাককে ধন্যবাদ জানানোর জন্য তিনি মান জাতির অধিবাসীদের নিজের বাড়ীর উঠানে খাড়া করা কাঠের দণ্ডের উপরে টিনের পাত্র রাখার নির্দেশ দেন। আকাশের প্রতি শ্রদ্ধাতর্পনের সময় পাত্রে সুস্বাদু খাবার রেখে কাককে খাওয়াতে হবে। এটাই সেনইয়াং রাজপ্রাসাদের সোলুন দণ্ডের ইতিহাস।

  সেনইয়াং রাজপ্রাসাদে মান জাতির সংস্কৃতি ও রীতিনীতির লক্ষণ সুস্পস্ট। যেমন এই প্রাসাদে রাজা ও মন্ত্রীদের প্রশাসনের কাজ করার হলগুলোর তুলনায় তাদের বাস করার হলগুলো বেশি উঁচু স্থানে নির্মিত। এটা মান জাতির একটি বৈশিষ্ট্য। মানজাতির অধিবাসিরা দিনের বেলায় বনে ঘুরে ঘুরে শিকার করে; রাত্রে উচু জায়গায় থাকতে পছন্দ করে। তবে চিং রাজবংশের প্রথম দিকে শাসকরা মধ্য চীনের হান জাতির সংস্কৃতি গ্রহণ করতে শুরু করে। তাই সেনইয়াং রাজপ্রাসাদে হান জাতির সংস্কৃতির চিহ্নও দেখা যায়। যেমন এই প্রাসাদের প্রধান হলের স্থাপত্য রীতি সুং রাজবংশের স্থাপত্যশৈলী অনুসরণে নির্মিত হয়েছে। তাছাড়া হান জাতির প্রণালী অনুসারে প্রাসাদের আবাসিক হলগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে। যেমন কুয়ান চু ভবন ও লিনচি ভবনের নাম হান জাতির বিখ্যাত সাহিত্য 'সিচিং' থেকে নেওয়া।

  সেনইয়াং রাজপ্রাসাদের প্রধান অংশের নির্মাণকাজ ১৬২৫ সালে শুরু হয়। নির্মাণকাজে দশ বছর সময় লেগেছিল। পরে ছিং রাজবংশের খানসি, ইয়োনচেন ও ছিয়েন লুন – এই তিনজন রাজা প্রাসাদটি পুনর্নির্মাণ ও সম্প্রসারণ করেন। তাই সেনইয়াং রাজপ্রাসাদে হান, মান, মঙ্গোলিয়া, হুই ও তিব্বত জাতির স্থাপত্যশৈলী দেখা যায়। সেনইয়াং রাজপ্রাসাদ চীনা জাতির সংস্কৃতি ও একত্রিত বহুজাতির চীনের প্রতীক।

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্যের পাতা
ভিডিও চিত্র
সাক্ষাত্কার
চিঠিপত্র
Play Stop
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040