|
তিনি কেন্দ্রীয় সঙ্গীত বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়াং ছিন অধ্যাপক লিউ ইউ নিং - আমাদের আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান চরিত্র।
প্রথমবারই যখন লিউ ইউ নিংয়ের সঙ্গে দেখা হয়, তখন তাঁকে দেখে মনে হয় অনেক সহজগ্রম্য, প্রাণচঞ্চল, শুভবাদী ও হাসি-খুশী। তিনি মনে করেন, ইয়াং ছিনের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এক ধরনের কাকতালীয় ব্যাপার। কিন্তু এমন ধরনের কাকতাল সম্ভবত তাঁর ভাগ্য। তিনি বলেন,
'ছোটবেলায় আমাদের পরিবার অনেক আনন্দদায়ক ছিলো। আমার মা গান পছন্দ করতেন এবং খুব ভালো গান গাইতেও পারতেন। আমার বাবা বেহালা পছন্দ করতেন। তাঁরা গত ষাটের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ছিলেন। একবার আমার মা একটি ফোং হুয়াং ছিন কেনেন। মনে হয়, আপনারা কখনও দেখেননি। কেনার পর আমি এটিকে খুব পছন্দ করতাম। একটি স্থানে বসে বসে ফোং হুয়াং ছিন বাজাতাম। আমার মা-বাবা মনে করতেন, শিল্প ক্ষেত্রে আমার প্রতিভা রয়েছে। কারণ আমি বসতে পারতাম।'
লিউ ইউ নিংয়ের মা-বাবার একজন বন্ধু ইয়াং ছিন বাজাতে পারতেন। মাত্র ৯ বছর বয়সে লিউ ইউ নিং তাঁর কাছে ইয়াং ছিন বাজাতে শিখতে শুরু করেন। ১৯৭৭ সালে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সঙ্গীত বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৭৮ সালে 'বসন্ত মুকুল' নামে প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে তিনি 'ইং শান হোং' শীর্ষক একটি ইয়াং ছিন সঙ্গীত বাজিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সুনাম কুড়ান। গত আশির দশকে লিউ ইউ নিং কেন্দ্রীয় সঙ্গীত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর স্কুলটিতে একজন শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।
কেন্দ্রীয় সঙ্গীত বিশ্ববিদ্যালয় হলো চীনের শিল্পকলা বিষয়ক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটি চীনের পেশাগত সঙ্গীত শিক্ষাদানের সর্বোচ্চ মানের প্রতিনিধিত্ব করে। দেশে-বিদেশে এর সুনাম রয়েছে। স্কুলে শিক্ষাদানের পর লিউ ইউ নিং তাঁর অনুসন্ধান ও উদ্ভাবন অব্যাহত রাখেন। তিনি ইয়াং ছিনের সঙ্গে ইলেক্ট্রোনিক সঙ্গীতের সমন্বয় ঘটান; বাদ্যযন্ত্র আর হু-এর পরিবেশনায় ইয়াং ছিনের সঙ্গীত রিমেক করেন এবং নতুন সঙ্গীত সৃষ্টিও করেন, যাতে লোকসঙ্গীতের শৈল্পিক অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে। তাঁর উদ্ভাবিত একটি প্রযুক্তি চীনের ইয়াং ছিন তৈরি করার ক্ষেত্রে একটি শূন্যতা পূরণ করে। ইয়াং ছিন ক্ষেত্রে তাঁর পুরোপুরি আত্মনিবেদনের কারণে তিনি বহুবার পুরস্কার পেয়েছেন।
চীনের ইয়াং ছিনকে চীন থেকে বেরিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং বিশ্বের ইয়াং ছিন পরিবারে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বিনিময় করার জন্য লিউ ইউ নিং বিদেশে অভিজ্ঞতা গ্রহণ করতে শুরু করেন। ২০০৫ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাঠানো একজন সফরকারী পণ্ডিত হিসেবে তিনি হাঙ্গেরিতে অধ্যায়ন করেন এবং ইউরোপের ইয়াং ছিন বাজাতে শিখেন। অধ্যায়নের পর তিনি এক লাখ শব্দের 'পূর্ব ইউরোপের ইয়াং ছিন সঙ্গীতের সংগ্রহ' অনুবাদ করেন, যাতে আন্তর্জাতিক লোকবাদ্যযন্ত্র হিসেবে ইয়াং ছিনের গবেষণার ক্ষেত্রে চীনের শূন্যতা পূরণ হয়। এই সঙ্গীত সংগ্রহ প্রসঙ্গে লিউ ইউ নিং বলেন,
'একজন বাদক হিসেবে, আপনি জানেন, অনুবাদের কাজের জন্য আমি অত সুদক্ষ নই। অনুবাদের সময় কত রাত আমি ঘুমাতে পারিনি তা মনেও করতে পারি না। আমি মনে করি, শুধু আমি নিজেই শিখেছি, অনেকের হাঙ্গেরি আসার সুযোগ হয়নি। আমি এই সঙ্গীত সংগ্রহ তাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চাই।'
হাঙ্গেরি থেকে ফিরে আসার পর লিউ ইউ নিং নিজের ছাত্রছাত্রীদের ডিগ্রি প্রদানের অনুষ্ঠানের জন্য চারটি ভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কনসার্ট ডিজাইন করেন। তাদের মধ্যে একটি হলো হাঙ্গেরি থেকে ইউরোপের ইয়াং ছিন সিম্বালোন দিয়ে বাজানো কনসার্ট। কনসার্টে দর্শক-শ্রোতারা সিম্বালোন দিয়ে বাজানো চীনের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন আদর্শ সঙ্গীত শোনা ছাড়াও চীনের ইয়াং ছিন দিয়ে বাজানো ইউরোপের সিম্বালোন শিল্পকর্ম শুনতে পারেন।
২০০৮ সালে লিউ ইউ নিং ভারতের দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগে সঙ্গীত সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করেন। ভারত থাকার সময় তিনি অনেক শহর সফর করেন এবং ভারতের সঙ্গীত মহলের অনেক কার্যক্রমে অংশ নেন। কোলকাতা সিটি হলে তিনি একক কনসার্টের আয়োজন করেন। এটি হলো ভারতে অনুষ্ঠিত প্রথম চীনা ইয়াং ছিন কনসার্ট। ভারতের অনেক বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ তাঁর সঙ্গে একই মঞ্চে পরিবেশ করেন, যার মধ্য দিয়ে ভারতের ইয়াং ছিনের সঙ্গে চীনা ইয়াং ছিনের প্রথম সংলাপ বাস্তবায়িত হয়। তারপর ভারতে তার আরো বেশ কয়েকটি কনসার্ট সফল ও সমাদৃত হয়। ভারতের যেখানে লিউ ইউ নিং যান সেখানে চীন ও ভারতের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের আলোড়ন সৃষ্টি হয়। লিউ ইউ নিং আমাদের সংবাদদাতাকে বলেন,
'তাই আমি ভারতকে ভালোবাসি। ভারত একটি রঙিন, অবিশ্বাস্য দেশ। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না যে, সেখানে কত বৈচিত্র্য ও স্বাধীনতা। অনেক ভালো। সঙ্গীতের প্রতি ভারতীরা অকৃত্রিম। এটি হলো ভারতীদের একটি বড় বৈশিষ্ট্য।'
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশততম জন্মবাষির্কী উপলক্ষে এবং '২০১১ সালে চীন ও ভারতের বিনিময় বর্ষের' একটি অনুষ্ঠান হিসেবে এ বছরের ৪ মে 'প্রাচ্যের সঙ্গে প্রাচ্যের দেখা' শীর্ষক একটি কনসার্ট কোলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়। চীনের কেন্দ্রীয় সঙ্গীত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পীরা এবং ভারতের পেশাগত ও বিখ্যাত শিল্পীরা একই মঞ্চে পরিবেশন করেন। ভারতের বেশ কয়েকটি তথ্যমাধ্যম এ কনসার্ট প্রসঙ্গে সংবাদ পরিবেশন করে। এবারের অনুষ্ঠানের প্রধান উদ্যোক্তা ও অংশগ্রহণকারী হিসেবে লিউ ইউ নিং বলেন,
'এবারের অনুষ্ঠানের অর্থ হলো প্রভাব সৃষ্টি করা। আমাদের লোকসঙ্গীত-সংশ্লিষ্ট অনেকে বাইরে গিয়ে মাত্র একটি পরিবেশনার আয়োজন করেন। তারপর অনুষ্ঠানের পর বিদায় নেয়া হয়। আসলে চীনের সঙ্গীতকে সত্যিকারভাবে বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো প্রভাব বিস্তার করা। বিদেশের প্রধান তথ্যমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এবং প্রধান সমাজে প্রবেশ করতে হবে।'
লিউ ইউ নিং বিশ্বের ৩০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলে গিয়ে চীনের ইয়াং ছিনকে জনপ্রিয় করে তুলছেন। তিনি বলেন, আধুনিক সমাজে লোকসঙ্গীত উন্নয়ন করতে এবং বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। তা ছাড়া, একটি দীর্ঘকালীন দৃষ্টি এবং সঙ্কটকালের অনুভূতি থাকতে হবে। এভাবে সত্যিকার চীনা সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা সক্ষম। লিউ ইউ নিং বলেন,
'প্রথমত, সঙ্গীতের কোন রাষ্ট্রীয় সীমানা নেই। দ্বিতীয়ত, চীনের সংস্কৃতি প্রভাবশালী। আমি মনে করি, প্রথমে আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে হবে। তারপর আমরা যখন বাইরে যাবো, তখন মাত্র একটি কনসার্টের আয়োজন করবো না। যদি সবাই আমার মতো কাজ করেন, তাহলে চীনা সঙ্গীতের এক ধরনের জোয়ার সৃষ্টি হবে। অবশেষে চীনের অনেক জিনিস স্বাভাবিকভাবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।'
বর্তমানে লিউ ইউ নিংয়ের কাজ করার প্রধান বিষয় হলো চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা বিভাগের প্রবীণ কর্মী পাই খাই ইউয়ানের সঙ্গে সহযোগিতা করে চীনা ভাষায় 'রবীন্দ্রসঙ্গীত সংগ্রহ' প্রকাশ করা। লিউ ইউ নিংয়ের একটি ইচ্ছে আছে। তা হলো ইরানে যাওয়া। তিনি বলেন, ইরান হলো ইয়াং ছিনের উত্পত্তিস্থান। ইরানে যাওয়ার পর তিনি বিশ্বের ইয়াং ছিন নিয়ে একটি সারসংকলন করবেন।
লিউ ইউ নিং বিশ্বের ইয়াং ছিনের বিনিময়কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, সঙ্গীতের প্রতি তাঁর সেই প্রত্যয় সবসময় তাঁকে সমর্থন করে। তিনি বলেন,
'মানুষের প্রত্যয় থাকতে হবে। একজন মানুষের প্রত্যয় না থাকলে তার জীবনের কোনো লক্ষ্য অর্জিত হবে না এবং নিজের দিক হারাবেন। আমি মনে করি, জীবন একটি শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার প্রক্রিয়া। জীবন অত্যন্ত সুন্দর। মনে করি, আমার জীবন চমত্কার।'
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved. 16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040 |