|
১৯৭৪ সালের ১৫ আগস্ট চীন ও ব্রাজিলের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও অ্যালুইসিও চীনে নিযুক্ত ব্রাজিলের প্রথম রাষ্ট্রদূত হিসেবে দু'দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় বছরে চীনে আসেন। তিনি নিজেও কল্পনা করতে পারেন নি যে, তিনি এ পদে দুই মেয়াদে থাকতে পারবেন। নিজের বাবা'র চীনে নিযুক্ত হওয়ার কথা স্মরণ করে হুগো বলেন :
এখনো আমার বাবার প্রেসিডেন্টের নিযুক্তির নির্দেশ পাওয়ার দিনের কথা আমার মনে আছে। আমার বাবা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঠানো বার্তাটি পান এবং জানতে পারেন যে, তাঁকে চীনে ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে। তিনি এ তথ্য জানার পর অনেক আনন্দিত হন। তিনি আমাকে বলেছেন, তা হলো তার ৪৫ বছরের কূটনৈতিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের কথা। আমার বাবা "পূবের মহা ড্রাগন"—চীনে ব্রাজিলের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন বলে আমার পরিবারের সবাই এর জন্য অনেক গর্ব বোধ করেন।
অ্যালুইসিও এবং চীনের কূটনীতিকদের যৌথ প্রচেষ্টায় চীন ও ব্রাজিল যথাক্রমে ধারাবাহিক আর্থ-বাণিজ্যিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। দু'দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক সুষ্ঠুভাবে সূচনার পর্যায় অতিক্রম করেছে, তা পররবর্তী মেয়াদের রাষ্ট্রদূতের জন্য দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করেছে। হুগো বলেন, তার বাবা চীনে নিযুক্ত বাজ্রিলের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বের ওপর অনেক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৭৬ সালে চীনের হো পেই প্রদেশের থাং শান শহরে ভয়াবহ ভূমিকম্প ঘটেছিল। সেসময় এতে অনেকেই হতাহত হয় এবং আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল অনেক বেশি। তখন ব্রাজিলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অ্যালুইসিওকে চীন থেকে চলে আসার নির্দেশ দেয়। তবে তিনি দ্বিধা না করে তা নাচক করে দেন। হুগো তখনকার কথা স্মরণ করে আমাকে বলেন:
যখন চীন ভয়াবহ দুর্যোগের সম্মুখীন হয়, তখন তার মনে হয়েছিল তার উচিত হবে নিজের পদে থেকে কাজ করে যাওয়া, এ দেশকে ছেড়ে নিজেই নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়া ঠিক নয়। তখনই ব্রাজিলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে পেইচিং ত্যাগ করে অন্য দেশে গিয়ে কূটনৈতিক হিসেবে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছিল। তবে আমার বাবা বলেন, তার কার্যমেয়াদকালে চীনে এত ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটলো আর তিনি চলে যাবেন, তা ঠিক হবে না। তিনি অবশ্যই পেইচিংয়ে থাকবেন।
বাবা'র চীনের প্রতি গভীর অনুভূতি'র" প্রভাবে হুগো নিজেই চীনকে জানতে অনেক আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি চীনের সংস্কৃতি সম্পর্কে এখন অনেক জানেন। বিশেষ করে তিনি মনে করেন চীনা ভাষা খুব চমত্কার একটি শিল্পকলা। তিনি বলেন:
আমার মনে হয়, চীনের এ শিল্পকলা প্রথমেই চীনা অক্ষর লেখার মাধ্যমেই প্রকাশ পেয়েছে। চীনা অক্ষরকে চীনের জনপ্রিয় শিল্পকলার খুব ভালো মাধ্যম হিসেবে মনে করা হয়। চীনা ভাষা শুনতেও অনেক মিষ্টি। যারা চীনা ভাষা শুনছেন, তাদের কাছে অনেক সুন্দর লাগে। এ ছাড়া চীনের সুদীর্ঘ সাংস্কৃতিক ইতিহাসে বিভিন্ন রাজবংশের পুরাকীর্তির সবই সব মানবজাতির একটি মূল্যবান সম্পদ। চীনের প্রাচীনকালের স্থাপত্যের মান অনেক উন্নত। মহাপ্রাচীর ও নিষিদ্ধ নগর হলো এ ক্ষেত্রের সবচেয়ে ভালো উদাহারণ। এ দু'টি নির্মাণ প্রকল্প সব দর্শকের হৃদয় জয় করেছে। তা হলো মানবজাতির নির্মাণ ইতিহাসের এ যেন এক মহা বিষ্ময়!
হুগো নাপোলিও ১৯৮০ ও ১৯৯৩ সালে দু'বার চীনে এসেছিলেন। প্রথমবার চীনে আসার উদ্দেশ্য ছিলো তার বাবাকে দেখা। তখন তার বাবা চীনে নিযুক্ত ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। দ্বিতীয়বার তিনি ব্রাজিলের টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী হিসেবে তখনকার চীনের ডাক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য এসেছিলেন। তিনি আমাদের সাংবাদিককে বলেন, এ দু'বারের চীন সফরকালে চীন তার মনে যে ছাপ ফেলেছে তা একদম ভিন্ন। সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতির কারণে চীনের সমাজের আকাশ পাতাল পরিবর্তন ঘটেছে। তিনি হলেন এসব পরিবর্তনের প্রতক্ষদর্শী। তিনি বলেন:
চীনের পরিবর্তন জনসাধারণের পোশাক পরিচ্ছদ দেখেই উপলব্ধি করা যায়। যখন আমি প্রথমবার চীনে আসি, তখন পুরুষের কাপড়ের রং সুবজ আর ধূসর ছিল, আর কোন রং বলতে গেলে দেখা যেতো না। বিয়ের আগে মেয়েরা সবাই চুলকে দু'টি বেনী করে রাখতো। বিয়ের পর মহিলারা চুলকে ছোট করে দেয়। ১৯৯৩ সালের সময় পুরুষরা পশ্চিমা দেশের পুরুষের মত আধূনিক পোশাক পড়তে শুরু করে। রাস্তায় জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের লোকজনকে তখন থেকেই দেখা যেতে শুরু করে। তখন ম্যাকডোনাল্ড রেস্তরা মাত্র শুরু হয়েছে। আমি এ দেশের ঘটা বিরাট পরিবর্তনকে নিজের চোখে দেখেছি। আমি বিশ্বের কাছে নিজের দরজা উন্মুক্ত করার একটি চীনকে দেখেছি।
চীন ও ব্রাজিলের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৩৫ বছরে, বিশেষ করে ১৯৯৩ সালে দু'দেশের কৌশলগত অংশীদারি সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকেই দু'দেশের উচ্চ পর্যায়র বিনিময় অনেক ঘনিষ্ঠ এবং রাজনৈতিক পারস্পরিক আস্থাও দিনে দিনে গভীর হচ্ছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রের বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা ফলপ্রসু হয়েছে। আন্তর্জাতিক ব্যাপারে দু'দেশের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা বজায় রয়েছে। বিশ্বজুড়ে আর্থিক সংকট দু'দেশের সহযোগিতা জোরদারের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে। হুগো বলেন:
আর্থিক সংকট সারা বিশ্বে যখন ছড়িয়ে পড়ে। তখন চীন হোক আর ব্রাজিল হোক, উভয় দেশই এতে সংক্রমিত হয়। আমাদের দু'দেশ উপলব্ধি করে যে হাতে হাত রেখে যৌথ চেষ্টা চালানোর মাধ্যমে আর্থিক সংকটের নেতিবাচক প্রভাব দূর করা সম্ভব এবং যৌথ উন্নয়ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব। তাই আমাদের উচিত পরস্পর দেশের কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রের পুঁজি বিনিয়োগ জোরদার করা এবং অব্যাহতভাবে দু'দেশের আর্থিক বিনিময় ত্বরান্বিত করা।
হুগো বলেন, অর্থনীতির বিশ্বায়নের পাশাপাশি চীন ও ব্রাজিলের জনগণের পারস্পরিক উপলব্ধি ও মৈত্রীও প্রতিদিনই দৃঢ় হচ্ছে। ব্রাজিলের জনগণের কাছে চীন আর আগের রূপকথার একটি দেশ নয়। চীন এখন তাদের কাছে অনেক পরিচিত। তিনি বলেন:
আগে ব্রাজিলের জনগণের কাছে চীন ছিলো রূপকথার রাজ্যের একটি বহু দূরের দেশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনীতির বিশ্বায়নের উন্নয়ন এবং দু'দেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চীন সম্পর্কে ব্রাজিলের জনগণের উপলব্ধিও দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। ব্রাজিল হলো ৫ হাজার বছরের ইতিহাসের একটি অভিবাসনকারীদের দেশ। তবে চীনের ইতিহাস ৫ হাজারেরও বেশি বছরের। চীনের কাছ থেকে ব্রাজিল এবং সারা বিশ্বের শেখার অনেক কিছুই আছে। সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে আমারা অনেক কিছুই শিখতে পারি। ২০০৮ সাল থেকে চীনের রাষ্ট্রীয় চীনা ভাষা কার্যালয় ব্রাজিলের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ব্রাজিলে কনফুসিয়াস ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে। এ পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে দু'দেশের সহযোগিতার ক্ষেত্র অনেক সুষ্ঠু। কনফুসিয়াস ইন্সটিটিউটের মাধ্যমে ব্রাজিলের লোকজন চীন সম্পর্কিত অনেক তথ্য এখন পেতে পারছে। চীনা ভাষা শেখা ছাড়াও তারা সেখানে চীনের সংস্কৃতি এবং চীনের কুং ফুও শিখতে পারছে। এ ধরনের বিনিময়ের ফলে দু'দেশের সম্পর্কের বিরাট আগ্রগতি হবে। দু'দেশের জনগণের মৈত্রীও হবেআরো ঘনিষ্ঠ ।
সাক্ষাত্কারে হুগো আরো বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন, চীন ও ব্রাজিল এ দু'টি উন্নয়নশীল দেশ অবশ্যই পরস্পরের সবচেয়ে শক্তিশালী সমর্থক হবে। তিনি দু'দেশের সম্পর্কের ভবিষ্যত সম্পর্কে যথেষ্ট আস্থাবান।
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved. 16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040 |