|
ভূমিকম্প, বন্যা এবং পাহাড়ধস হচ্ছে মানবজাতিকে মোকাবিলা করতে হয় এমন অন্যতম ভয়াবহ ও ক্ষতিসাধনকারী প্রাকৃতিক দুর্যোগ। অনেক পরিবার ও লোকজন নানা ধরনের দুর্যোগে প্রাণ হারায়। বর্তমান সময়ে পৃথিবীর জলবায়ু উষ্ণ হয়ে হওয়ার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটছে। ২০০৮ সালের ১২ মে চীনের সিছুয়ান প্রদেশের ওয়েনছুয়ান অঞ্চলে সংঘটিত ভয়াবহ ভূমিকম্প এবং ২০১০ সালের ১৪ আগস্ট ইংসিউ অঞ্চলের পাহাড়ধস অনেক পরিবারকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা ইংসিউ অঞ্চলের পুনর্নির্মাণ, দুর্যোগ প্রতিরোধে উপায় এবং দুর্যোগকালে কীভাবে মানুষ জানমালের ক্ষতি এড়াতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করবো।
"আমরা রুমে ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাত্ বন্যা আমাদের ঘরে প্রবেশ করে। তখন আমরা ভাবছিলাম সব শেষ হয়ে যাবে। যদি পালিয়ে যেতে পারি, তাহলে অবশ্যই যাবো।"
২০১০ সালের ১৪ আগস্ট ইয়াং পিং ও তাঁর আত্মীয়স্বজন আবার মৃত্যুদূতের মুখোমুখি হয়। এটি ছিল দুই বছরের মধ্যে তাঁদের দ্বিতীয়বার মৃত্যুর কবল থেকে বেঁচে যাওয়া। এর আগের তাঁর মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন ২০০৮ সালের ১২ মে মাসে। ইয়াংপিংর বাড়ি সিছুয়ান প্রদেশের ইংসিউ জেলায়। এ ছোট জেলা ২০০৮ সালে ১২ মে সিছুয়ান প্রদেশের ওয়েন ছুয়ান ভয়াবহ ভূমিকম্পের কেন্দ্রীয় স্থলে অবস্থিত হওয়ার কারণে অতি বিখ্যাত হয়েছে। সেই ভূমিকম্পে গোটা ইংসিউ অঞ্চল ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। জেলার ১০ হাজারেরও বেশি মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকেন মাত্র প্রায় ৩০০০জন।
গতবারের ভূমিকম্পের পর এবার ইয়াংপিংর পরিবার পাহাড়ধসের সম্মুখীন হয়। আগস্ট মাস শুরু হওয়ার পর কয়েকদিনব্যাপী ঝড়বৃষ্টির কারণে ইংসিউ জেলার সামনে মেনচিয়াং নদীর পানির স্তর বেড়ে যায়। ১৪ আগস্ট ভোরবেলায় আকস্মিক পাহাড়ধসে মিনচিয়াং নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়, ফলে নদীর দিক পরিবর্তন হয়ে নতুন নির্মিত ইংসিউ জেলা ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তখন সেখানকার অধিবাসীরা ইয়াংপিংর মতো স্বপ্ন থেকে উঠছিলেন সবে। অনেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন, কিন্তু প্রাণ বাঁচানোর মতো সৌভাগ্যবান সবাই ছিলেন না।
ইয়াংপিংর বাড়ি পরিবারের সকল সদস্য মিলে এক বছর সময় নিয়ে এক ইট এক ইট গেঁথে নির্মাণ করেন। পাহাড়ধসে তাঁদের বাসভবন গুরুতর রকমে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি। তবে তাদের প্রতিবেশীদের কয়েকটি বাসভবন গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং কয়েকজন আহত হয়েছেন। এবার দুর্যোগে ইয়াংপিং পুনরায় মৃত্যুর উপলব্ধি পান। তবে তিনি বিশ্বাস করেন, নিজের হাতে নির্মিত তাঁর নতুন বাড়ি বেশ নিরাপদ।
"আমি জানি দুর্যোগ এসেছে। আমরা সবাই সম্ভবত মৃত্যুর সম্মুখীন হচ্ছি। কিন্তু আমাদের বাসভবন নিজ হাতে তৈরি, তাই আমার মনে হয় তা নিরাপদ।"
এ ভয়াবহ বন্যা প্রবাহে ইংসিউ জেলায় নতুন নির্মিত পানি কারখানা এবং ৭০টিরও বেশি ভবন নষ্ট হয়। ১২ মে ভূমিকম্পে ত্রাণ সাহায্য লাইন-২১৩ নম্বর পথও কেটে দেয়া হয়। ইংসিউ জেলার প্রধান স্যু হোং চুন অনুমান করেন, বন্যা প্রবাহে ইংসিউ জেলায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
"এবার বন্যা প্রবাহ আমাদের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে এবং দুর্গতির অবস্থাও গুরুতর। আমাদের নির্মিত রাস্তা ব্যবস্থাপনা, পাইপলাইন ও পানি কারখানা সবই বন্যায় বিধ্বস্ত হয়েছে। গোটা জেলায় আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬৩ কোটি রেনমিনপিতে। কুয়াংতুং প্রদেশ থেকে আগত ত্রাণকর্মী নেতা ছেন চি পিয়াও ইংসিউ জেলায় ৭০০ দিনেরও বেশি সময় ছিলেন। এ ধ্বংসস্তুপ এলাকায় আসার পর থেকে তিনি তুংকুয়ান শহরের ত্রাণকারী গ্রুপের উপ-প্রধান হিসেবে তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে দিন রাত কাজ করেন। ১২ মে ভূমিকম্পের পর কুয়াংতুং প্রদেশের তুংকুয়ান শহর ইংসিউ জেলার পুনর্নির্মাণ কাজের দায়িত্ব পালন করেন। নির্মাণের অর্থ ও স্থাপত্য কর্মীসহ সব ব্যবস্থাপনা তুংকুয়ানের দায়িত্ব। এক বছরের নির্মাণের মাধ্যমে একটি ধ্বংসস্তুপ থেকে এক নতুন ইংসিউ জেলা তৈরি হয়। শৃঙ্খলাবদ্ধ রাস্তা, বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন পুনর্বাসন বসতি ইংসিউ জেলাকে একটি আধুনিক শহরের সামর্থ্যবাহী সুন্দর শহরে পরিণত করেছে। নতুন করে বন্যা প্রবাহ না দেখা দিলে শিগগিরই তুংকুয়ান শহর ইংসিউ জেলাকে বাসভবনের চাবি হস্তান্তরের কথা ছিল। এটা পুনর্নির্মাণ কাজ সম্পন্নের প্রতীক। অধিবাসীদের কাছে নতুন বাসা হস্তান্তরিত হওয়ার পর ছেন চি পিয়াও ও তাঁর সহকর্মীদের নিজেদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মিলনের ইচ্ছাও পূর্ণ হবে। তবে আকস্মিক বন্যা প্রবাহের কারণে সকলের সুন্দর ইচ্ছাপুরণ বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
তখন সবারই এ দৃশ্য দেখে মন খারাপ হয়। নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার কারণে ইংসিউ জেলার পুনর্নির্মাণ কাজ কম সময়ের মধ্যে শুরু হতে পারেনি। সংশ্লিষ্ট বিভাগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয় যে, আগের স্থানেই একটি নতুন ইংসিউ পুনর্নির্মাণ করা হবে। ইংসিউ পুনর্নির্মাণের প্রাথমিক পরিকল্পনার সময় অন্যান্য স্থান বাচাই করে এ জেলা পুনর্নির্মাণের প্রস্তাব বার বার দাখিল করা হয়। ইংসিউ জেলার পুনর্নির্মাণের পরিকল্পনা প্রণয়ন করে শাংহাই থোংচি শহর পরিকল্পনা ডিজাইন ইন্সটিটিউটের দক্ষিণপশ্চিম পরিকল্পনা বিভাগ। বিভাগের পরিচালক হিসেবে সিয়াও তা গোটা প্রক্রিয়ায় অংশ নেন। তিনি জানান, রাষ্ট্রীয় ভূভাগ বিভাগ ভৌগলিক পরীক্ষার পর সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, পুরনো স্থানে ইংসিউ শহর পুনর্নির্মাণ করা নিরাপদ। তবে তিনি আরও বলেন, প্রাথমিক পরিকল্পনার পর্যবেক্ষণ রিপোর্টে বলা হয়, ইংসিউ'র কাছাকাছি এলাকায় কিছু ভৌগলিক সমস্যা রয়েছে।
"পর্যবেক্ষণ রিপোর্টে বলা হয়, মধ্যপর্যায়ের দুর্যোগের সম্ভাবনা মাথায় রেখে এটা তৈরি করা হয়েছে। এরপর আমরা সার্বিক পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় এসব জায়গার সংস্কার ও সমাধানের বিষয় দেখবো। ইংসিউ পুনর্নির্মাণের পরিকল্পনা রাষ্ট্রীয় ভূভাগ বিভাগ উত্থাপিত ভৌগলিক পরীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী নির্ধারিত নিরাপদ এলাকার মধ্যে প্রণয়ন করা হয়।"
তবে এ ছোট ভৌগলিক বিপদের সম্ভাবনা ভয়াবহ বন্যা প্রবাহের মূল উত্স্যে পরিণত হয়। স্থানীয় অধিবাসীরা এ অঞ্চলকে হোংছুনকৌ বলে ডাকে। ইংসিউ জেলা থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৫০০ মিটার। সেখানে জমে থাকা নরম পাথর ও মাটির পরিমাণ ৩০ লাখ ঘনমিটারেরও বেশি। পুনর্নির্মাণ কাজে ব্যস্ত লোকেরা এসব পাথর ও মাটির দিকে মনোযোগ দেননি, অবশেষে দুর্যোগ পুনরায় ইংসিউ জেলায় আঘাত হানে।
পুনর্নির্মাণ পরিকল্পনা অনুযায়ী ইংসিউ জেলা একটি ভূমিকম্প প্রতিরোধক পরীক্ষামূলক এলাকা এবং একটি সুন্দর ৫এ শ্রেণীর পর্যটন জেলায় পরিণত হবে। ছেন চি পিয়াও বলেন, তুংকুয়ান শহর ইংসিউ পুনর্নির্মাণ কাজে প্রায় ১.১ বিলিয়ন রেনমিনপি ব্যয় করা হয়েছে। পুনর্নির্মাণের প্রক্রিয়ায় নিরাপত্তার বিষয়টিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে দেখা হয়।
"২০০৮ সালে ইংসিউ পুনর্নির্মাণের পরিকল্পনা শুরু করার সময় থেকে নিরাপত্তাকে প্রধান বিষয় হিসেবে দেখা হয়। আমরা সবসময় নিরাপত্তাকে প্রথম স্থানে রাখি।"
(সুবর্ণা)
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved. 16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040 |