|
প্রথমে পেইচিং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্য ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক চাং কুয়াং লিন 'রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিরদিন চীনা জনগণের মনে বেঁচে থাকবেন' শিরোনামে আলোচনা করেন। বহু বছর ধরে অধ্যাপক চাং কুয়াং লিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তাঁর সাহিত্য-কর্মের ওপর গবেষণা করছেন। তাঁর সাহিত্য-কর্ম প্রচুর এবং প্রভাবও গভীর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর গবেষণা ক্ষেত্রে তিনি একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি ১৯২৪ সালে প্রথমবারের মতো কবি'র চীন সফরের সময় কয়েকজন চীনা পন্ডিতের সঙ্গে তিনি একটি ছবির প্রদর্শনী করেছিলেন। তিনি বলেন,
তা ছিল ৮৬ বছর আগে কবি'র ৬৪তম জন্মদিন উপলক্ষে পেইচিং-এর সিয়ে হো মিলনায়তনে সুই চি মো, লিন হুই ইন ও হু শিসহ প্রমুখ চীনা পন্ডিতগণের কবিগুরুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে তাত্পর্যসম্পন্ন একটি জন্ম দিন পালন।
চীনের সেই জন্মদিনের অনুষ্ঠান রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ে সুগভীর ছাপ ফেলে। তিনি তার ৮০ বছর বয়সে চীনের সেই বিশেষ জন্মদিনের কথা স্মরণ করে একটি কবিতা লিখেছিলেন। পেইচিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপক দেবেন্দ্র শুকলা তাঁর বক্তব্যের সময় আমাদের সেই কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনান।
আগে থাকুন গভীর আবেগের সঙ্গে তিনি বলতেন, বিশ্বাস করুন, আমার পূর্বজীবনে একজন চীনা ছিলাম। আমি জানতাম না, কেন চীনে আসার পর মনে হয়েছে যেন আমার জন্মস্থানে ফিরে এসেছি। আমি বরাবরই মনে করি, ভারত হচ্ছে চীনের অতি কাছের স্বজন। চীন ও ভারত হচ্ছে অতি পুরানো ও প্রিয় ভাই। চীন ও চীনা জনগণের প্রতি রবীর বন্ধুত্বপূর্ণ অনুভূতি রয়েছে। ১৮৮১ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ 'চীনে মৃত্যুর বাণিজ্য'শীর্ষক একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেছিলেন। প্রবন্ধে তিনি চীনে বৃটিশ ঔপনিবেশিকদের আফিম ডাম্পিং করার তীব্র নিন্দা করেছিলেন। তিনি অভিযোগ করেন যে, বৃটিশ বন্দুক দিয়ে চীনাদের আফিম খাওয়াতে বাধ্য করতো এবং নিজেরা প্রচুর মুনাফা লুটতো। এটি সম্ভবতঃ সারা বিশ্বে সবচেয়ে আগে আফিম বাণিজ্যের নিন্দা করার ওপর লেখা প্রবন্ধ। তখন থেকেই চীন রবী ঠাকুরের মনে বিশেষ মর্যাদার আসনে আসীন।
চীনে বক্তব্য দেয়ার সময় রবী ঠাকুর বলেছিলেন, তাঁর চীন সফরের লক্ষ্য পর্যটকদের মতো সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করা নয় এবং ধর্মপ্রচারক হিসেবে কল্যাণ বয়ে আনা নয়, বরং চীনের সংস্কৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য। তিনি বলেন, তাঁর দায়িত্ব হলো চীন ও ভারতের মধ্যে হাজার বছরের বন্ধ হওয়ার সেতু মেরামত করা।
১৯২৪ সালে চীন সফর শেষে চীন-ভারত সাংস্কৃতিক বিনিময় আরো ত্বরান্বিত করার জন্য তিনি বিশেষভাবে নিজের প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি চীনা ইন্সটিটিউট নির্মাণ করেছিলেন। সেখানে চীনা ভাষা ও অক্ষর গবেষণা করা হয়। চীনা ইন্সটিটিউট গঠন অনুস্ঠানে তিনি আবেগময় কন্ঠে বলেছিলেন, আজ একটি মহান দিন। আমি ভারত ও চীনের সংস্কৃতি ও মৈত্রীকে সংযুক্ত করেছি। সত্যি, রবী ঠাকুর চীন ও ভারতের মধ্যে একটি বিস্ময়কর সেতু নির্মাণ করেছেন। এ সেতু নির্মাণের উপাদান পাথর বা সিমেন্ট নয়, টাকা ও ক্ষমতা নয়, বরং তা ছিল তাঁর সাহিত্য-কর্ম এবং জীবনের স্বপ্ন। অনেক আগে ১৯১৫ সালে রবী ঠাকুরের সাহিত্য-কর্মে চীনের পরিচিতি তুলে ধরা হয়। উল্লেখযোগ্য, রবী ঠাকুরের সাহিত্য-কর্ম চীনা ভাষায় প্রথম অনুবাদ করেছিলেন চীনের বিখ্যাত বিপ্লবী ছেন তু সিউ। অধ্যাপক চাং কুয়াং লিন এ সম্পর্কে বলেন,
ছেন তু সিউ রবী ঠাকুরের কাব্য-সংকলনের ইংরেজী সংস্করণ 'গিতানজলী' থেকে চারটি ছোট কবিতা বেছে নিয়ে তাঁর উদ্যোগে প্রকাশিত 'নতুন তরুণ-তরুণী'পত্রিকার ১৯১৫ সালের সপ্তদশ সংখ্যায় প্রকাশ করেছিলেন। তারপর রবী ঠাকুরের সাহিত্য-কর্মে চীনের পরিচিতি উঠে এসেছে এবং বংশ পরম্পরায় চীনা পাঠকদের প্রশংসা পেয়েছে।
গত ৯০ বছরেরও বেশি সময়ে চীনা পন্ডিতগণের প্রকাশিত কয়েক'শরও বেশি প্রবন্ধে রবী ঠাকুর ও তাঁর সাহিত্যকর্মের মূল্যায়ন করা হয়েছে। বর্তমানে তাঁর অধিকাংশ সাহিত্য-কর্ম চীনা ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। চীন আন্তর্জাতিক বেতারের প্রবীণ কর্মকর্তা পাই খাই ইউয়ান রবী ঠাকুরের সাহিত্য-কর্ম অনুবাদকারীদের মধ্যে অন্যতম। কথা প্রসঙ্গে কবি সম্পর্কে তিনি বলেন,
চীনে রবী ঠাকুরকে আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচ্যের একজন অনন্য রচয়িতা বলে মনে করা হয়। তা ছাড়াও, তিনি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ রচয়িতা বলে পরিচিত। তিনি হোমার, দান্তে আলিঘরি, উইলিয়াম শেক্সপিয়ার ও জোহান্স ওল্ফগাং ভন গোথের মতো বিশ্বের মহান রচয়িতা। তাঁর সাহিত্য-কর্ম চীনে খুব বেশি বিক্রি হয় । চীনে রবী ঠাকুর যে এ ধরণের উচ্চ মর্যাদা পান তার কারণ হলো তাঁর আবেগপূর্ণ বিশেষ শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য এবং ভারতের সঙ্গে চীনের ইতিহাস ও চীনা জণগণের প্রতি তাঁর মৈত্রী। এখন শুনুন চীন আন্তর্জাতিক বেতারের কর্মকর্তা সুয়ে ফেই ফেই ও সিয়ে নানের যৌথভাবে আবৃত্তি করা একটিরবী ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা '১৪০০ সাল'
রবী ঠাকুরের কবিতা তাঁর আত্নার সঙ্গীত। তাঁর সঙ্গীতে বিশ্বের অনেক সাহিত্য অনুরাগী মুগ্ধ । 'চায়না ডেইলি'পত্রিকায় কাজ করেন চিত্রালেখা বসু। তিনি একজন বাঙ্গালি। বাংলা ভাষা ও ইংরেজী ভাষায় রবী ঠাকুরকে নিয়ে লেখার ক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ ধরণের অনুভূতি রয়েছে। এদিন তিনি তিনটি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছেন। এখন শুনুন তার মধ্যে একটি।
রবী ঠাকুরের সাহিত্য-কর্ম অতি সমৃদ্ধ। তিনি ৫০টিরও বেশি কাব্য-সঙ্কলন, ১২টি বড় উপন্যাস, একশরও বেশি ছোট উপন্যাস, ২০টিরও বেশি নাটক ও দুই হাজারেরও বেশি গান লিখেছেন। এর রচিত সঙ্গীত খুবই জনপ্রিয়। এবারের স্মরণীয় অনুষ্ঠানে চীনের কেন্দ্রীয় সঙ্গীত ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ছেন চি মিং বেহালায় অতি সুন্দর রবীন্দ্র সুর সৃষ্টি করেছেন। 'আমার প্রিয়তম' রবী ঠাকুরের কবিতাকে সুর করে বাজিয়েছেন তার ছাত্রী। এখন শুনুন অধ্যাপক ছেন চি মিংয়ের ছাত্রী লিউ ইয়াং-এর পরিবেশিত এই যন্ত্র সঙ্গীতটি।
রবী ঠাকুর তার সারা জীবন শিশুদেরকে ভালোবেসেছেন। তিনি বলেছিলেন যে, শিশুদের প্রতিরোধের কোন শক্তি নেই। তাঁর জীবনের বিভিন্ন সময়পর্বে দৃষ্টির ভিন্নতা লক্ষণীয়। তাঁর সাহিত্য-কর্মে বরাবরই সততা, দয়া ও সৌন্দর্যের প্রতি অন্বেষণ প্রকাশিত হয়েছে। 'দি ক্রিসেন্ট মুন' হচ্ছে রবী ঠাকুরের অন্যতম একটি সাহিত্য-কর্ম। এ কাব্য-সঙ্কলনে তিনি প্রাণবন্তভাবে শিশুদের জীবনের কথা বর্ণনা করেছেন এবং দক্ষতার সাথে শিশুদের মনস্তত্ত্ব ও বৈচিত্র্যময়তাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। রবী ঠাকুর নিজের আত্না কাব্য-সঙ্কলনের প্রতিটি লাইন আধ্যাত্নিকতায় ভরপুর। এসব কবিতা পড়লে জনগণের মানসিক উন্নতি সাধন হবে। এখন শুনুন কমিউনিকেশন ইউনিভার্সিটি অব চায়নার বাংলা ভাষা ক্লাসের ছাত্র মোং ফান সিনের আবৃত্তি করা কবিতাটি ছিল 'লুকোওচুরি'। 'লুকোচুরি' কবিতাটি কাব্য-সঙ্কলন 'দি ক্রিসেন্ট মুন' থেকে নেয়া হয়। কবিতায় মিস্টি একটি দুস্ট ছেলের কথা বর্ণনা করা হয়েছে।
একজন সত্যিকারের রচয়িতা হিসেবে তাঁর জীবন মৃত্যুর পরেও শেষ হবে না। লোকজন তাঁর সাহিত্য-কর্ম পড়া এবং তাঁর মর্ম বিশ্বব্যাপি প্রচারের মধ্য দিয়েই তিনি বেঁচে থাকবেন চিরকাল। বেঁচে থাকবেন জনগণের মনোজগতে । কমিউনিকেশন ইউনিভার্সিটি অব চায়নার হিন্দি ক্লাসের ছাত্রী ইয়াং রুই দ্বিতীয়বারের মতো এ ধরণের অনুষ্ঠানে অংশ নেন। তিনি মনে করেন, এ ধরণের আয়োজন রবী ঠাকুরকে পছন্দ করা লোকজন মিলিত হয়ে তাঁর সাহিত্য-কর্ম এবং ভারত, বাংলাদেশ ও চীনের সংস্কৃতি উপভোগ করতে পারেন। তা খুব তাত্পর্যসম্পন্ন। তিনি বলেন,
চলতি বছর হচ্ছে চীন ও ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৬০তম বার্ষিকী। আমি বিশ্বাস করি, এ ধরণের কর্মসূচির আয়োজন চীন ও ভারতের সংস্কৃতি বিনিময়কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। (লিলি)
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved. 16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040 |