Web bengali.cri.cn   
ভারতের বলিউড—স্বপ্ন গড়ার কারখানা
  2012-07-25 15:11:42  cri
ভারতে মানুষ প্রায়ই একটি কথা বলে। সেটি হলো, "একটি আনুষ্ঠানিক খাবার খাওয়া বাদ দেওয়া যায়, কিন্তু একটি চলচ্চিত্র দেখা বাদ দেওয়া যায় না।" চলচ্চিত্র ভারতের সাধারণ জনগণের সাংস্কৃতিক জীবনযাত্রার গুরুত্বপূর্ণ দিক বর্ণনা করার পাশাপাশি কিছু মাত্রায় বর্তমানে ভারতীয় সমাজ উন্নয়ন ও পরিবর্তন তুলে ধরে। ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বকারী দিকগুলোর অন্যতম এ চলচ্চিত্র। জমকালো রঙ, অতিরঞ্জিত পরিবেশনা, ধুমধাড়াক্কা নাচ-গান এবং বিভিন্ন সুপারস্টার বহুবর্ণ বলিউড গড়ে তুলেছে। ভারতে চলচ্চিত্র এতো জনপ্রিয় কেন? বলিউডে যারা কাজ করেন, সেই তরুণ-তরুণীদের জীবনযাত্রা কেমন? কেন নাচ-গান বলিউড চলচ্চিত্রের অপরিহার্য অংশ? তাহলে এখন শুনুন ভারতে সিআরআই'র সংবাদদাতা ওয়াং ছাওয়ের মুম্বাই থেকে পাঠানো এ সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন।

ভারতের তরুণ-তরুণীদের জন্য বলিউড হচ্ছে একটি বিস্ময় ও স্বপ্ন সৃষ্টি করার কারখানা। বলিউডের চলচ্চিত্র কেবল যে অভিষ্ট ও সুন্দর বিশ্ব সৃষ্টি করেছে তা নয়, বরং অনেক তারকাও সৃষ্টি করেছে। স্বপ্নের পিছনে ছুটে প্রায় প্রতি মিনিটে অনেক ভারতীয় বলিউডে আসেন। তারা একদিন চলচ্চিত্রের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকায় পরিণত হওয়ার প্রত্যাশা করেন।

এখানে সবেমাত্র চলচ্চিত্রে প্রবেশ করা আস্থা-ভরপুর সুন্দরী রয়েছেন।

"আমার নাম প্রিয়ানকা। আমি আগে বিমানবালা ছিলাম। আমি জানি না কেন আমি মুম্বাই এসেছি। আমি শুধু মনে করি, বলিউড আমাকে আকর্ষণ করছে। এখন আমার মনে হয় আমি এর মধ্যে একজন।"

এখানে রয়েছেন গ্রাম থেকে বড় শহরে এসে সাফল্য অর্জনের সংস্কৃতি এবং শিল্প পছন্দ করা তরুণ-তরুণী।

"আমার নাম মুকেশ কুমার। আমি বিহার থেকে এসেছি। আমার মুম্বাইয়ে আসার কারণ হচ্ছে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আমি একজন ভদ্র-নম্র মানুষ। কাহিনী লেখাকে আমি আমার সারা জীবনের কাজ হিসেবে দেখি। খুব সহজ।"

এখানে আরো রয়েছেন ভারতের সিলিকন ভ্যালি খ্যাত ব্যাঙ্গালোরের কাজ ত্যাগ করে নিজের স্বপ্নের পিছনে ছোটা চলচ্চিত্রের কাহিনী রচয়িতা।

"আমি আগে একটি আইটি কোম্পানির উপদেষ্টা দিলাম। আমার ভালোবাসা সঙ্গীতের চেয়ে সেটা ছিল অসৃজনশীল কাজ। একটি সঙ্গীত রচনায় আমি অসীম তৃপ্তি পাই। এরকম তৃপ্তি আগের চাকরি থেকে পেতাম না। তাই আমার জীবন এখন আগের চেয়ে অনেক আনন্দদায়ক।"

অন্য মানুষ এমনকি তাঁদের বন্ধু বা আত্মীয়স্বজনের চোখে স্বপ্নের পিছনে ছোটা এসব তরুণ-তরুণীদের জীবনযাত্রা কিছুটা কঠিন। কিন্তু তাঁদের নিজেদের জন্য তুষ্টির অভাব নেই। স্বপ্নের পিছনে ছোটার প্রক্রিয়া এনে দেওয়া তৃপ্তি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা তরুণ ও আত্মবিশ্বাসী। ছোটবেলা থেকে বলিউড-সৃষ্ট সুন্দর চলচ্চিত্রের স্বপ্নে বড় হয়েছেন। এখন তাঁরা বলিউডে এসে নিজেদের স্বপ্ন গড়েন।

কিন্তু তাদের জীবনযাপন খানিকটা নিষ্ঠুর। বলিউড-সৃষ্ট স্বপ্ন যত মিষ্টি ও সুন্দর হোক না কেন, তাদেরকে কাজে এসে যোগ দিতে হয় এমন সময়, যখন মানুষ সাধারণত ঘুম থেকে জাগে। অনেক তরুণ-তরুণী যেমন আগের ভালো পেশা ছেড়ে বলিউডে এসেছেন, তেমনি রাজেশ সিং নিজের স্বপ্নের পিছনে ছুটেছেন টাটা স্টিল কোম্পানির ভালো সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন প্রকৌশলীর কাজ ত্যাগ করে। কয়েকটি চলচ্চিত্রের প্রধান অভিনেতা হওয়ার সুযোগ পান তিনি। বলিউডে পেশাগত অবস্থার ওঠা-নামার দশ-বার বছর পর বলিউডের পিছনে ছোটায় তাঁর আরো গভীর অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন,

"বলিউডে আসার চার-পাঁচ বছর পর আমি প্রথমবারের মতো একটি চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পাই। আমি খুব আনন্দিত হই। তারপর আমি দ্বিতীয় ও তৃতীয়বারের মতো চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করি। আমি খুবই উত্তেজিত বোধ করি। কিন্তু তৃতীয় চলচ্চিত্রের পর আমার ভাবনা বদলায়। আমি সবসময় অপেক্ষা করছিলাম আমার চলচ্চিত্র মুক্তি পাবে। কিন্তু দেখা যায় কেউ তা কেনে না। কারণ আমি জনপ্রিয় তারকা ছিলাম না। বলিউডের চলচ্চিত্র পুরোপুরিভাবে তারকা-নির্ভর চলচ্চিত্র। তারপর আমি বিয়ে করি। আমার একটি সন্তান আছে। তার বয়স এখন ৫ বছর। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আগের ক্যারিয়ার ভুলে গিয়ে আবার শুরু করবো। আমি মডেল ছিলাম, কণ্ঠপরীক্ষাও অংশ নিয়েছি। আমি বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি, অনেক মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে এবং সব সময় যথাসাধ্য কাজ করেছি।"

সৌভাগ্যবশত ৩৬ বছরের রাজেশ এক সময় পুনরায় স্বপ্ন খুঁজে বের করেন। পেশা পরিবর্তন করার কিছু সময় পর তিনি হঠাত্ নতুন চলচ্চিত্রের অভিনয়ের প্রস্তাব পান। এখন তিনি বলিউডের একজন বিখ্যাত অভিনেতা হয়েছেন।

বলিউডের স্বপ্নের পিছনে ছোটা এসব অভিনেতা-অভিনেত্রীরা একদিন যখন চলচ্চিত্রের সুপারস্টারে পরিণত হন, তখন তা তাঁদের চাকরির স্বপ্নের পিছনে ছোটা থেকে স্বপ্ন সৃষ্টিতে পরিণত হয়। তাঁরা সৌন্দর্যভরা নাচ এবং প্রাণভরা গান গাওয়ার মধ্য দিয়ে কোটি কোটি ভারতীয় চলচ্চিত্র দর্শকদের নিত্য জীবনযাত্রার চেয়ে অন্য রকম সুন্দর স্বপ্ন সৃষ্টি করেন।

ভারতীয় দর্শকরা, বিশেষ করে দারিদ্র, রোগ ও মনঃকষ্টে বেঁচে থাকা মানুষেরা, এসব মানুষের জন্য সৌন্দর্য এনে দেওয়া চলচ্চিত্র দেখতে পছন্দ করেন। বলিউড চলচ্চিত্র হচ্ছে তাঁদের জন্য সবচেয়ে ভালো সহানুভূতি। বলিউড চলচ্চিত্র ভারতে এতো জনপ্রিয় হওয়ার কারণ সম্পর্কে বলিউডের প্রবীণ চলচ্চিত্র ভাষ্যকার, চলচ্চিত্র শিল্পের পর্যবেক্ষক রাজেশ কুমার সিং বলেন,

"ভারত হচ্ছে একটি বৃহত দেশ। এর জনসংখ্যা অনেক। চলচ্চিত্র হচ্ছে সবচেয়ে অল্প খরচের বিনোদন পদ্ধতি। মঞ্চ পরিবেশনা দেখতে অনেক পয়সা ব্যয় করতে হয়। কিন্তু সিনেমা হলে প্রবেশ করলে আপনি মঞ্চের মতো সকল বিনোদনের উপাদান পাবেন। চলচ্চিত্র হচ্ছে ভারতীয় মানুষের সবচেয়ে অল্প ব্যয়ের বিনোদনের উপায়। এ ছাড়া চলচ্চিত্রের প্রতি সাধারণ মানুষের চাহিদা রয়েছে। ভারতীয়দের জন্য চলচ্চিত্র এক ধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যে পরিণত হয়েছে।"

কুমার বলেন, মানুষ যাতে সব চলচ্চিত্র দেখে সেজন্য ভারতের কিছু স্থানীয় সরকার বিভিন্ন উপায়ে চলচ্চিত্রের টিকিটের দাম নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন এখন দিল্লি ও মুম্বাইসহ বিভিন্ন নগরে একটি চলচ্চিত্র টিকিটের দাম ১৫০ থেকে ৩শ' রুপি। কিন্তু অনেক ছোট শহর বা গ্রামে একটি টিকিটের দাম মাত্র ২০ থেকে ৩০ রুপি। তিনি বলেন,

"ছোট জায়গায় চলচ্চিত্র টিকিটের দাম হচ্ছে সীমিত। সরকারকে নিশ্চিত করতে হয় দরিদ্র মানুষেরা যাতে চলচ্চিত্র দেখতে পারে। চলচ্চিত্র টিকিটের দাম বাড়ানোতে তাদের উত্সাহ নেই। কারণ তা সম্ভবত নির্বাচনে ভোট কমাসহ বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করবে। সুতরাং সরকার চলচ্চিত্র টিকিটের দাম নিয়ন্ত্রণে খুবই মনোযোগী।"

ভারতের সিনেমা হলে দর্শকদের সবচেয়ে ভালো লাগা হচ্ছে উদ্দীপনাময় নাচ-গান। আনন্দদায়ক সঙ্গীতের সঙ্গে প্রাণভরে নাচ করায় মানুষ বাস্তব জীবনের দুঃখ ও উদ্বেগ ভুলে যায়। নাচ-গান এ কারণেই ভারতের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। কুমার বলেন,

"ভারতের সংস্কৃতিতে অনেক উদযাপনী বিষয় রয়েছে। ভারতে অনেক দিবস ও উত্সব আছে। হোলি হোক, দিওয়ালি হোক অথবা অন্য কোন দিবস হোক, নাচ-গান হচ্ছে অপরিহার্য উপাদান। এর পাশাপাশি চলচ্চিত্রের কাহিনী মানুষের দৈনন্দিন জীবন থেকে নেওয়া হয়। বলিউড চলচ্চিত্রের নাচ ও গান জনপ্রিয় হওয়ায় আসলে ভারতীয় সমাজের সংস্কৃতিতে প্রভাব পড়েছে।

কুমার আরো বলেন, কিছু খাঁটি শৈল্পিক চলচ্চিত্র বাদে বলিউডের প্রায় সব চলচ্চিত্রে নাচ-গান, ঠাট্টা-তামাশা ও রোমান্সসহ বিভিন্ন উপাদান রয়েছে। কারণ সব প্রযোজক-পরিচালক ভাল করে জানেন ভারতীয় দর্শকরা কী চায়। সেকারণে তারা সকল জনপ্রিয় বিনোদন উপাদান চলচ্চিত্রে দেখান। সুতরাং বলিউডের চলচ্চিত্র মাঝেমাঝে জগাখিচুড়িতে পরিণত হয়।

বলিউড হচ্ছে সব স্বপ্ন মিশ্রিত জায়গা। কেউ কেউ এখানে এসে স্বপ্নের পিছনে ছোটেন। কিন্তু একই সময় বলিউড চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আরো বেশি মানুষের জন্য স্বপ্ন সৃষ্টি করেন। বিশেষ করে কঠিন পরিবেশে থাকা ভারতীয় দর্শকদের জন্য চলচ্চিত্র তাদের আসল জীবনযাপনের চেয়ে ভিন্ন ও স্বপ্নের মতো বিশ্ব সৃষ্টি করে। পাশাপাশি সঠিক স্বপ্নের পেছনে ছোটা এবং স্বপ্ন সৃষ্টির মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্র শিল্প ভারতে সবচেয়ে বেশি মাত্রার সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। (প্রেমা/এসআর)

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্যের পাতা
ভিডিও চিত্র
সাক্ষাত্কার
চিঠিপত্র
Play Stop
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040