|
কেটে মন্দির তৈরি করার ভারতীয় স্থাপত্যবিদ্যার চরম উত্কর্ষ ঘটেছে এলোরার মন্দিরগুলোতে ।ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের আওরঙ্গবাদ জেলা শহর থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে চরনন্দ্রি পাহাড় কেটে এই মন্দিরগুলো তৈরি করা হয়েছে ।৩৪টি গুহা মন্দির রয়েছে এখানে ।এখানে রয়েছে বৌদ্ধ,হিন্দু ও জৈন মন্দির,বিহার ও মঠ ।খ্রিস্টিয় পঞ্চম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে রাষ্ট্রকূট রাজবংশের রাজত্ব কালে এই মন্দিরগুলো নির্মাণ করা হয় ।প্রথম থেকে ১২ নম্বর গুহা হলো বৌদ্ধ বিহার ।বিহারগুলো দোতলা বা তিনতলা । এর মধ্যে রয়েছে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বসবাসের জন্য অনেকগুলো ঘর,রান্নাঘর এবং অন্যান্য ঘর ।৫ম থেকে ৭ম শতাব্দীর মধ্যে বৌদ্ধ বিহারগুলো নির্মিত হয়। প্রতিটি বিহারে বোধি সত্বের বিভিন্ন প্রতিকৃতি,গৌতম বুদ্ধের অসংখ্য মূর্তি এবং জাতক কাহিনীর চিত্র রয়েছে । বৌদ্ধ গুহাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো চন্দ্রশালা ।সাধারণভাবে এটি বিশ্বকর্মা গুহা নামে পরিচিত ।এই বিহারের মধ্যে স্তূপের মতো হলঘর রয়েছে যাকে চৈত্য বলা হয়। হলঘরের মাঝখানে রয়েছে গৌতম বুদ্ধের ১৫ ফুট উঁচু একটি অপূর্ব মূর্তি ।মূর্তির পিছনের দেয়ালে উত্কীর্ণ করা হয়েছে একটি বিশাল বোধিবৃক্ষ ।হলঘরটিতে এমন শিল্পনৈপুণ্যের সাথে ছাদের নকশা খোদাই করা হয়েছে যে অনেক সময় পাথরকে কাঠ বলে মনে হয় ।বিশ্বকর্মা গুহায় বারান্দায় রয়েছে ঘট ও পল্লবের দৃষ্টি নন্দন নকশা ।প্রথম গুহাটি হলো আট ঘর বিশিষ্ট একটি বিহার ।এর কোনো কোনো ঘরে খাদ্য শস্য রাখার ব্যবস্থা ছিল বলে অনুমান করা হয় ।
এলোরার হিন্দু মন্দিরগুলো ষষ্ঠ শতক থেকে অষ্টম শতকের মধ্যে নির্মিত হয় ।১৭ নম্বর গুহা থেকে ২৯ নম্বর গুহায় হিন্দু মন্দিরগুলো নির্মাণ করা হয়েছে । এর মধ্যে কৈলাশনাথের মন্দির সবচেয়ে বিখ্যাত ।পিরামিড আকৃতির এ মন্দিরটি দক্ষিণ ভারতীয় দ্রাবিড় রীতিতে নির্মিত হয়েছে ।শিব মন্দিরের বৈশিষ্ট অনুযায়ী এখানে রয়েছে শিবলিঙ্গ ।মন্দিরের প্রবেশ মুখেই প্রশস্ত নন্দী মন্ডপ ।নন্দী মন্ডপে একটি বিশাল ষাঁড় বা নন্দীর মূর্তি রয়েছে ।মন্দিরের ভিতরে স্তম্ভ,বাইরের ঘর, গর্ভগৃহ,সভাগৃহ সবকিছুই রয়েছে ।আলো প্রবেশের জন্য রয়েছে চতুষ্কোণ জানালা । মন্দিরের দেয়ালে উত্কীর্ণ রয়েছে শিব পার্বতী,শিবের অনুচর,বিষ্ণুর অনুচর,বিভিন্ন দেবদেবী ও মিথুন মূর্তি ।রাবনের কৈলাশ পর্বত উত্তোলনের চেষ্টা করার একটি অনন্য ভাস্কর্য রয়েছে এ মন্দিরে ।এ মন্দিরটি নির্মাণের জন্য ২ লাখ টন পাথর কাটা হয়েছিল এবং সময় লেগেছিল প্রায় ১০০ বছর ।
১৫ নম্বর গুহাটির নাম দশাবতার । এতে বিষ্ণুর দশ অবতারের পৃথক মূর্তি রয়েছে । এর মধ্যে হিরণ্যকশিপুকে বধ করার জন্য বিষ্ণুর নৃসিংহ অবতারের চিত্রায়নটি শিল্প হিসাবে অনবদ্য ।মন্দিরটির দেয়ালে প্যানেলে বিষ্ণুপুরাণ অনুযায়ী অসংখ্য কাহিনীর ভাস্কর্য রয়েছে ।এই দেয়ালের রিলিফের কাজগুলোও অপূর্ব শিল্পসুষমা মন্ডিত ।অন্যান্য হিন্দু মন্দিরের মধ্যে রামেশ্বর,গঙ্গা,যমুনা, রাবন কি খাই ও নীলকণ্ঠ নকশা ও কাহিনী চিত্রায়নের জন্য উল্লেখযোগ্য ।এলোরায় ৫টি গুহায় রয়েছে জৈন মন্দির ।জৈন ধর্মের আদর্শ ও ভাবধারা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এ গুহাগুলোর ভাস্কর্য,দেয়ালচিত্র ও মুরালের মাধ্যমে ।নবম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে এই মন্দিরগুলো নির্মিত হয়েছিল ।অন্য গুহাগুলোর চেয়ে এগুলো আকারে বড় নয় কিন্তু শিল্পকর্মের জন্য বিখ্যাত ।৩০ নম্বর গুহায় ছোট কৈলাশ মন্দির,৩২ নম্বর গুহায় ইন্দ্রসভা এবং ৩৩ নম্বর গুহায় জগন্নাথ সভা মন্দির অনবদ্য শিল্প সম্পদে সমৃদ্ধ । ইন্দ্রসভা মন্দিরটি দোতলা ।মন্দিরের ছাদে পদ্মফুলের খোদাই কাজ খুব সুন্দর । এই মন্দিরে রয়েছে হাতির ওপর যক্ষ মাতঙ্গের একটি অসাধারণ সুন্দর ভাস্কর্য ।হাতির পিঠে বসা যক্ষকে অনেকে ইন্দ্র বলে ভুল করেন ।এছাড়া রয়েছে ফলভরা আমগাছের নিচে সিংহের পিঠে বসা যক্ষিনী অম্বিকার দৃষ্টিনন্দন ভাষ্কর্য ।
এলোরার মন্দিরগুলোকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের অন্তর্ভুক্ত বলে ঘোষণা করেছে ।প্রাচীন ভারতের স্থপতি,ভাস্কর ও চিত্রশিল্পীদের অনন্যসাধারণ প্রতিভা ও দক্ষতার পরিচয়বাহী এ মন্দিরগুলো এখানে আগত পর্যটকদের বিষ্ময়ে বিমুগ্ধ করে। (শান্তা)
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved. 16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040 |