|
সুদূর পেইচিং থেকে চীন আন্তর্জাতিক বেতারের শ্রোতা বন্ধুদের জানাই অনেক অনেক প্রীতি ও শুভেচ্ছা। ইতিহাস ও ঐতিহ্য পর্বে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি শান্তা মারিয়া । আজ আপনাদের শোনাবো কলকাতার বিখ্যাত মার্বেল প্যালেস বা মর্মর প্রাসাদের কথা।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতা একসময় পরিচিত ছিল প্রাসাদ-নগরী হিসেবে। সপ্তদশ শতকে ইংরেজ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির উদ্যোগে হুগলী নদীর তীরে গড়ে ওঠে কলকাতা শহর। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে রাজধানী কলকাতায় ধনী জমিদার ও অভিজাত বাঙালিরা গড়ে তোলেন অসংখ্য সুরম্য ভবন,প্রাসাদ ও বাগান বাড়ি। এমনি একটি সুরম্য প্রাসাদ হলো মার্বেল প্যালেস । ১৮৩৫ সালে রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক এই প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতায় গড়ে ওঠা ভবনগুলোর মধ্যে মার্বেল প্যালেস তার সৌন্দর্য ও শিল্প সম্ভারের জন্য অত্যন্ত বিখ্যাত। আরেকটি কারণে এই প্রাসাদ বিখ্যাত। এই মল্লিক বাড়ির উদ্যানেই গড়ে উঠেছিল কলকাতার প্রথম চিড়িয়াখানা।
বিখ্যাত বাঙালী ব্যবসায়ী ও জমিদার নীলমণি মল্লিকের দত্তকপুত্র ছিলেন রাজেন্দ্র মল্লিক। নীলমণি মল্লিক উত্তর কলকাতার মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে তাঁর বসতবাড়িতে জগন্নাথদেবের মন্দির নির্মাণ করেন। মার্বেল প্যালেসের অন্দর মহলের প্রাঙ্গণে মন্দিরটি এখনো রয়েছে। এই ৪৬ নম্বর মুক্তারামবাবু স্ট্রিটেই রাজেন্দ্র মল্লিক গড়ে তোলেন অসাধারণ সৌন্দর্যমন্ডিত মার্বেল প্যালেস। অতুল সম্পদের জন্য রাজেন্দ্র মল্লিক রাজা বাহাদুর খেতাব পেয়েছিলেন। নিউক্ল্যাসিকাল স্থাপত্যরীতিতে গড়ে তোলা এই তিনতলা ভবনটির সামনে বাঙালী রীতিতে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ ও বিশাল বাগান রয়েছে। ভিতরে রয়েছে বাঙালী রীতিতে তৈরি ঠাকুরদালান। এই মন্ডপে যেমন পূজা হতো তেমনি যাত্রাপালা ও কীর্তনের আসরও বসতো। তিনতলা ভবনটির সামনে রয়েছে কোরিন্থিয়ান রীতিতে তৈরি স্তম্ভ এবং কারুকার্য করা বড় বারান্দা। চীনা প্যাভিলিয়নের ধরণে নির্মিত হয়েছে ঢালু ছাদ।
ভবনটির ভিতরে রয়েছে অসংখ্য ভাস্কর্য। বিশেষ করে গ্রীক ও রোমান পুরাণের দেবদেবী জিউস,মিনার্ভা,মার্কারি, এ্যাপোলো,হেরা, ভেনাস,কিউপিড যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে শ্বেত পাথরের দেহে। ভাস্কর্য ছাড়াও রয়েছে অসংখ্য পেইন্টিং বা চিত্রকর্ম। বিশাল বিশাল ক্যানভাসে আঁকা এই চিত্রকর্মগুলো দর্শকদের মুগ্ধ করে অনায়াসে। এই চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে ষোড়শ শতকের বিখ্যাত জার্মান শিল্পী রুবেনস এর আঁকা দুটি ছবি রয়েছে। এ দুটি ছবি হলো দ্য ম্যারেজ অব সেন্ট ক্যাথেরিন এবং দ্য মার্টারডম অব সেন্ট সেবাস্টিয়ান। রুবেনস এর এ দুটি মূল চিত্রকর্ম এ সংগ্রহশালার বিখ্যাত সম্পদ। ইংরেজ শিল্পী স্যার জোশুয়া রেনল্ড এরও দুটি মূল চিত্রকর্ম এখানে রয়েছে। এ দুটি হলো সাপের সঙ্গে যুদ্ধরত শিশু হারকিউলিস আর ভেনাস ও কিউপিড। এছাড়া টিটান,মুরিল্লোসহ অনেক বিখ্যাত চিত্রকরের চিত্রকর্মের কপি এখানে রয়েছে।
পাশ্চাত্য রীতিতে গড়া তোলা অসংখ্য দৃষ্টি-নন্দন ভাস্কর্য,বিশাল আকৃতির সব চিত্রকর্মের পাশাপাশি রাজা রাজেন্দ্র মল্লিকের পোট্রেটটিও দর্শকদের দৃষ্টি কেড়ে নেয় ।
তিনতলা ভবনের পুরোটিই অত্যন্ত মূল্যবান মার্বেল পাথরে তৈরি। সে জন্যই এর নামকরণ করা হয়েছে মার্বেল প্যালেস। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বিস্তৃত বেলজিয়ামে তৈরি আয়না ঘরগুলোর শোভা যেন আরো বাড়িয়েছে। এছাড়া রয়েছে ভিক্টোরীয় যুগে তৈরি কারুকার্য-খচিত কাঠের ও পাথরের আসবাবপত্র,বিশাল ঝাড়বাতি,বিভিন্ন আকারের দৃষ্টিনন্দন ঘড়ি,অত্যন্ত দামী কার্পেট,নকশা করা বাতিদান,বাদ্যযন্ত্রসহ বিভিন্ন শিল্প-সামগ্রী।
মার্বেল প্যালেসের সামনে যে বিশাল বাগানটি রয়েছে সেখানেও আছে বিভিন্ন ভাস্কর্য ও ফোয়ারা । বিশেষ করে সিংহের মূর্তিগুলো অত্যন্ত সুন্দর। এই বাগানে এখনো একটি ছোট চিড়িয়াখানা রয়েছে । এই চিড়িয়াখানায় দশর্করা দেখতে পাবেন ময়ূর,পেলিক্যান পাখি,সারস,,বিভিন্ন প্রজাতির বক, বিভিন্ন প্রজাতির বুনো হাঁস,হাড়গিলে পাখি,বানর,সজারু,চিতাবাঘ,বনবিড়াল,গন্ধগোকুল ও কয়েক প্রজাতির হরিণ ।
মল্লিক বাড়ি নামে সর্বসাধারণের কাছে পরিচিত এই মার্বেল প্যালেস কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তি । রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক বাহাদুরের উত্তরাধিকারীরা এখনো এই প্রাসাদে বাস করছেন । যেহেতু রাজার পরিবারের সদস্যরা এখনো এ বাড়িতে বাস করেন তাই দর্শনার্থীরা শুধু ভবনটির একটি অংশেই ঢুকতে পারেন ।প্রাসাদের অন্দরমহলে এবং প্রসাদের ভিতরে অবস্থিত জগন্নাথদেবের মন্দিরে ঢোকার অধিকার তাদের নেই।
উত্তর কলকাতার এই মার্বেল প্যালেস এখনো অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর বাবু-সংস্কৃতি ও বিলাস বৈভবের কথা মনে করিয়ে দেয়। (শান্তা)
![]() |
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved. 16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040 |