|
চলতি বছর চীন ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৩৫ বছর পূর্তি হবে। কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর দু'দেশ সবসময় বন্ধুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। বিশেষ করে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন ও বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের পারস্পরিক সফরের মাধ্যমে দু'দেশের দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নের সুষ্ঠু প্রবণতা দেখা দিয়েছে। বাণিজ্যের পরিমাণ ও দ্বিপক্ষীয় পূঁজিবিনিয়োগ দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। দু'দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতা দিন দিন বাড়ছে। সদ্যসমাপ্ত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর চীনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশে আরো বেশি পুঁজিবিনিয়োগ করার বড় উত্সাহ দিয়েছে।
বন্ধুরা, পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, এখন চীন ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক অভূতপূর্ব পর্যায়ে আছে। গত দশ বছরে দু'দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় চার গুণ বেড়েছে। যেমন ২০০০ সালে দু'দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল মাত্র ৯০ কোটি মার্কিন ডলার ছিল। ২০০৫ সালে দু'দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ২৪০ কোটি মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। ২০০৯ সালে প্রায় ৪৬০ কোটি মার্কিন ডলার পৌঁছেছে। ২০০৩ সাল থেকে চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম পুঁজি বিনিয়োগকারী দেশে পরিণত হয়েছে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে চীনের সরাসরি পুঁজিবিনিয়োগের পরিমাণ ৮ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ চীনে পুঁজিবিনিয়োগ করেছে ৩ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার।
১৯ মার্চ চীনে রাষ্ট্রীয় সফররত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য উন্নয়ন কমিটি আর চীনে বাংলাদেশ দূতাবাসের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত 'চীন-বাংলাদেশ বাণিজ্য ফোরামে' উপস্থিত ছিলেন। চীন ও বাংলাদেশের বিভিন্ন মহলের প্রায় ২০০ প্রতিনিধি এ ফোরামে দ্বিপক্ষীয় অর্থনীতি, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ক সহযোগিতা নিয়ে ব্যাপক মত বিনিময় করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণিজ্য ফোরামে প্রধান ভাষণ দেন
জানা গেছে, বাংলাদেশে ১৫ কোটি জনসংখ্যা আছে। বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সম্পদ, অপেক্ষাকৃত উচ্চ গুণগত মানের শ্রম শক্তি আর বড় বাজার আছে। বাংলাদেশের পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের বাজারে প্রবেশ করতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ বিদেশী পুঁজি আকর্ষণের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দেয় এবং পুঁজিবিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য বহু সুবিধাজনক নীতি চালু করেছে। ফলে চীনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ওপর বড় আকর্ষণশক্তি আছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ শুনে ফোরামে অংশগ্রহণকারী চীনের শিল্পপতিরা উত্সাহিত হন এবং পরপর প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন। সড়ক নির্মাণ হচ্ছে এবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়ের অন্যতম। চীনের শিল্পপতিদেরও বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থা উন্নয়নের আগ্রহ রয়েছে। চীনের পূর্তকর্ম প্রকল্প গোষ্ঠীর উপ-ব্যবস্থাপক ছু হো ছাই প্রশ্ন করেন, 'চীন-মিয়ানমার-বাংলাদেশ সড়ক নির্মাণের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাশা কী? এ সড়ক নির্মাণে চীন ও বাংলাদেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতায় কী কী নতুন সুযোগ ও পরিবর্তন বয়ে আনবে?'
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার পাশাপাশি চট্টগ্রামে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ সম্পর্কেও তথ্য দেন। তিনি বলেন, ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। এ খবর জেনে অনেকে উত্সাহিত হয়েছে। চীনের চুংসিং টেলিযোগাযোগ সরঞ্জাম লিমিটেড কোম্পানির প্রতিনিধি জানতে চান, ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার টেলিযোগাযোগ শিল্পে কী কী সুবিধাজনক নীতি দেবে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পর বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভবিষ্যত সম্ভাবনা কেমন?
এটা সত্যি এক ভালো প্রশ্ন। আমার বিশ্বাস আমাদের শ্রোতাবন্ধুরাও তা জানতে আগ্রহী। শুনুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কী উত্তর দেন?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের প্রশ্নের উত্তর দেন
আমরা জানি, বাংলাদেশের বস্ত্রখাত দ্রুত বিকশিত হয়েছে এবং চীনের কিছু বস্ত্র শিল্পপ্রতিষ্ঠানও বাংলাদেশে পুঁজিবিনিয়োগ করেছে। যেমন চীনের বস্ত্র সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি আমদানি ও রপ্তানি কোম্পানি গত বিশ বছর ধরে বাংলাদেশের বস্ত্রখাতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক বিদেশী কোম্পানি এক বড় সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। তা হলো জ্বালানি সরবরাহ। যেমন বিদ্যুত ও প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের ঘাটতি। এমন কি কিছু নতুন প্রতিষ্ঠিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ না পেয়ে অনির্দিষ্ট কালের জন্য উত্পাদন স্থগিত রাখা হয়েছে। এর ফলে চীনসহ বিদেশী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর বাংলাদেশে পুঁজিবিনিয়োগ করার আস্থাও নড়বড়ে হয়ে যায়। বাণিজ্য ফোরামে চীনের বস্ত্র সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি আমদানি ও রপ্তানি কোম্পানির প্রতিনিধি ওয়াং চাং ছাও প্রশ্ন করেন, 'প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ ঘাটতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে কি? বাংলাদেশের জ্বালানি সরবরাহ সংকট কবে দূর হবে? চীনসহ বিদেশী পুঁজিবিনিয়োগকারীদেরকে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করার কোন প্রতিশ্রুতি দেয়া যাবে কি?'
আমার মনে হয়, এটা সত্যি এক কঠিন সমস্যা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তার উত্তর দিতে কোন দ্বিধা দেখান নি। তিনি বলেছেন, দু'দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য সরকার এবং বেসরকারী সংস্থাগুলোর যৌথ প্রচেষ্টা দরকার। চীন ও বাংলাদেশের বাণিজ্যের পরিমাণ অবিরাম বৃদ্ধির পাশাপাশি চীন সরকার দু'দেশের বাণিজ্যের ভারসাম্যহীনতার সমস্যাও লক্ষ্য করেছে। বাণিজ্য ফোরামে চীনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য উন্নয়ন ফোরামের সহ-সভাপতি চাং ওয়েই বলেন, 'চীন বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বিদ্যমান ভারসাম্যহীন অবস্থার ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। চীনের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য আদানপ্রদানের উদ্দেশ্য হচ্ছে পারস্পরিক কল্যাণমূলক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা। ফলে চীন সরকার বাংলাদেশ থেকে আমদানী বাড়ানোর জন্য নানা ক্ষেত্রে প্রচেষ্টা চালিয়েছে। ২০০৬ সাল থেকে চীন বাংলাদেশের কিছু পণ্যকে শূন্যশুল্ক সুবিধা বা বিশেষ শুল্ক সুবিধা দিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন সরকার বাংলাদেশে ক্রয় দল পাঠিয়েছে এবং বহু ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ২০০৯ সালে যদিও দু'দেশ আন্তর্জাতিক আর্থিক সংকটের প্রভাবের শিকার হয়েছে, তবুও চীন বাংলাদেশ থেকে ১৪ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের আমদানি করেছে। এ সংখ্যা এর আগের বছরের তুলনায় ৭ শতাংশ বেশি।'
জানা গেছে, চীনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য উন্নয়ন কমিটি সর্বদাই বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের সঙ্গে বিনিময় ও সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে। ২০০৪ সাল থেকে এ সংস্থা সার্কের শিল্প ও বাণিজ্য ফেডারেশনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে চীন-দক্ষিণ এশিয়া বাণিজ্য ফোরাম প্রতিষ্ঠা করেছে। এখন এ ফোরাম চীন ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যকার কার্যকর আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতার ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। এ বছরের ৫ জুন চীনের ইউন্নান প্রদেশের রাজধানী খুনমিংয়ে পঞ্চম চীন-দক্ষিণ এশিয়া বাণিজ্য ফোরাম অনুষ্ঠিত হবে। এ ধরনের ফোরামে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার শিল্পপতিরা চীনের পুঁজি বিনিয়োগ পরিবেশ ও চীনের বাজারের ওপর আরো বেশি ধারণা পাবেন এবং পরস্পরের সহযোগিতার সুযোগও বাড়বে। (ইয়ু কুয়াং ইউয়ে)
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved. 16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040 |