|
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম দিককার বছরগুলোতে যে সাংস্কৃতিক জাগরণ পরিলক্ষিত হয় তার প্রাথমিক অভিব্যক্তি 'অমর একুশে গ্রন্থমেলা'। এটি এখন গ্রন্থোৎসব। এ উৎসব এদেশে প্রথম আয়োজিত হয় বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে ১৯৭২-এ।
স্বাধীনতা লাভের কিছু দিনের মধ্যেই ১৯৭২ সাল থেকে বাংলা একাডেমী তার নিজস্ব প্রকাশনা একুশ উপলক্ষে হ্রাসকৃত মূল্যে প্রথম বই বিক্রি শুরু করে। ১৯৭৪ সালে একুশ উপলক্ষে একাডেমীতে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে একাডেমীর বই বিক্রি ও প্রদর্শিত হয়।
১৯৭৫ সাল থেকে বাংলা একাডেমীর একুশের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান একাডেমীর গেটের পাশে বই বিক্রি শুরু করে। পরবর্তীতে তিন বছরের মধ্যে বিক্রেতার সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। ১৯৭৮ সালে এসে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ মেলায় রূপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এ কারণেই এ বছর থেকে মেলাটিকে গ্রন্থমেলা হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বাংলা একাডেমী এই মেলার আয়োজন করে।
পরের বছর অর্থাৎ- ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি গ্রন্থমেলা আয়োজনে বাংলা একাডেমীর সহযোগী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১৯৮৪ সালে এসে গ্রন্থমেলার জন্য বিধিবদ্ধ নীতিমালা প্রণীত হয় এবং এই গ্রন্থমেলার নাম হয় 'অমর একুশে গ্রন্থমেলা'। সেই থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা প্রতি বছর প্রায় একই আঙ্গিকে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
১৯৯২ সালে এসে মেলার পরিধি, আয়োজনের ব্যাপকতা ও বৈচিত্র্য পুনরায় পরিবর্তিত হয়। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংখ্যা বেড়ে যেতে থাকে। ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমীর পাশাপাশি মাত্র একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান 'মুক্তধারা' একুশের মেলায় বই বিক্রি করে, ১৯৮০ সালের গ্রন্থমেলায় সে সংখ্যা বেড়ে হয় ৩০। মাত্র পাঁচ বছর পর ১৯৮৫ সালে সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮২তে, এবং আর মাত্র ছয় বছর পর ১৯৯১ সালে এই সংখ্যাটি ১৯০তে উন্নীত হয়।
আরো আশ্চর্যের ব্যাপার, মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭০এ। তাই বাংলা একাডেমীর দেয়ালঘেরা স্বল্প-পরিসর প্রাঙ্গণে এই মেলা আর আবদ্ধ থাকলো না। একাডেমীর দেয়াল ভাঙা হলো, জনগণের জন্য প্রবেশ-দ্বার প্রসারিত হলো, আর মেলার একাংশ ছড়িয়ে পড়লো সোহরাওয়ার্দি উদ্যান-সংলগ্ন রাস্তার দু'পাশে। মিলন চত্বর থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত চিহ্নিত হলো 'অমর একুশে গ্রন্থমেলা'র প্রাঙ্গণরূপে।
সত্তর দশকের শেষ দিকে মেলার ব্যাপক আয়োজন শুরু হলেও এই আয়োজন পূর্ণতা পায় আশির দশকের মাঝামাঝিতে এসে। নব্বইয়ের শুরুতেই মেলা অভাবনীয় ব্যাপ্তি লাভ করে। তারই ফলস্বরূপ ১৯৯২ সাল থেকে মেলা-প্রাঙ্গণেরও বিস্তৃতি ঘটে। ১৯৯৩ সালে মেলা প্রাঙ্গণ প্রকৃত অর্থেই দোয়েল চত্বর থেকে মিলন চত্বর পর্যন্ত প্রসারিত হয়। '৯২-এর তুলনায় মেলায় অনুমোদিত স্টলের সংখ্যাও একশো'র মতো বৃদ্ধি পায়।
১৯৯৩-এ মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৩৩৮। ১৯৯৪ সালে ছিল ৬৫৩, ১৯৯৫ সালে ৪৬৭, ১৯৯৬ সালে ৪৮৬, ১৯৯৭ সালে ৫২০। আর ২০০৫ সালে এই মেলায় স্টলের সংখ্যা ছিলো ৪৬৪টি। ২০০৬ সালে ৩১৭, ২০০৭ সালে২৫৫, ২০০৮ সালে ২৩৬, এবং ২০০৯ সালে ৩২৬টি প্রতিষ্ঠান বইমেলায় অংশ নেয়। আর চলতি বছর অর্থাৎ ২০১০ সালে মেলায় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৫০৫টি স্টল।
এই অমর একুশে গ্রন্থমেলা আজ কেবল পুস্তকমেলা নয়। এটি লেখক-পাঠক-প্রকাশক ও সর্বসাধারণের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে। এই মেলা এদেশের সাংস্কৃতিক জাগরণকে দিন দিন আরও সংহত ও শাণিত করে তুলছে।
--তথ্যসূত্র: বাংলা একাডেমী ওয়েবসাইট, সম্পাদনা: মাহমুদ হাশিম।
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved. 16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040 |