সুবর্ণা.আচ্ছা, তাহলে হুলুনবে' নিয়ে এখন একটি গান শোনা যাক। গানটির নাম হুলুনবে'র তৃণভূমি আর এর কথাগুলো হচ্ছে এমন- 'আমার আকাঙ্খা আকাশের কাছে, কেননা আকাশের কাছেই রয়েছে একটি বিস্তীর্ণ তৃণভূমি, নীল আকাশের নিচে সবুজ জমিন, সবুজ ঘাসের জমিনের ওপরে বিছানো সাদা রঙয়ের তাঁবু নদী/ আমার মেয়ে উঁচু পাহাড়ে থাকে, আর পাহাড়ের উপর থেকে দেখা যায় ঘন তাসিংআন বন, বনের হাল্কা কুয়াশা ভেদ করে ইগলের চোখ খুঁজে বেড়ায় সবুজ তৃণভূমিতে / হুলুনবে'র তৃণভূমি যেন আমার মনের সাদা মেঘ, এই তৃণভূমিই হচ্ছে আমার প্রিয়, আমার ভালোবাসা....
লিপন. মঙ্গলীয় জাতির গান শুনে মনে হয় তাদের গান অনেক সুন্দর আর রোমান্টিক। তাদের মন অনেক খোলা আর প্রাণবন্ত, সরলতা তাদের বৈশিষ্ট্য। আসলে হুলুনবে' তো শুধুমাত্র একটি তৃণভূমি নয়, এই ভূমির কোল ঘেঁষে ছড়িয়ে থাকা বুনো জঙ্গল তৃণভূমির চেয়েও কয়েকগুণ বড়। তাসিংআনলিং বনে বার্চ, পাইন গাছ আর মাশরুমসহ নানা রকমের উদ্ভিদ রয়েছে, রয়েছে নাম না জানা কতশত বাহারি বুনো ফুল। মজার বিষয় হচ্ছে এখানে এমন কিছু উদ্ভিদ রয়েছে যা কেবল নির্দিষ্ট একটি ঋতুতেই দেখা পাওয়া যায়। এখানকার সাদা ও সুউচ্চ বার্চ গাছ যেন মানুষের মনে গভীর প্রেমের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যুগ যুগ ধরে। বার্চ বনের অপার সৌন্দর্য তাই অনেক রোমান্টিক প্রেমের গল্প, চলচ্চিত্র আর গানের বিষয় হয়ে উঠেছে। আপনি যদি রুশ সংস্কৃতি জানেন বা পছন্দ করেন তাহলে প্রায়শই বার্চ বৃক্ষকে খুঁজে পাবেন একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক উপাদান হিসেবে। এই বৃক্ষ যেন রুশ জনমানসের বিশেষ প্রতীক হয়ে দৃঢ়তার সাথে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সত্যি এই বৃক্ষ আপনাকে ভিন্নরকম এক অনুভূতির জগতে নিয়ে যাবে।
সুবর্ণা. হুলুনবে'র তৃণভূমির গেনহো জলাভূমি এশিয়ার বৃহত্তম ও সবচেয়ে সুন্দর জলাভূমির অন্যতম। আকাশ থেকে পাখির চোখ দিয়ে নিচে দেখলে এ জলাভূমির দারুণ সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করা যায়। জলাভূমিটি অসংখ্য ছোট পুকুর আর বন দিয়ে ঘেরা। এখানে রয়েছে হরেক রকমের পশুপাখির অভয়ারণ্য। দেখতে যেন রূপকথার গল্পের স্বর্গ উদ্যানের মতো। তাশিংআনলিং বনে একধরনের বিশেষ প্রাণী দেখতে পাওয়া যায়, এর নাম reindeer. এটি কেবলমাত্র বড় দিনের সান্টা ক্লাউসের পশু নয়। তাশিংআনলিং বনে বসবাসকারী চীনের সংখ্যালঘু জাতি এওয়েনখে জাতির একটি শাখা আওলুকুইয়াদের কাছে এই reindeerএর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তারা এই প্রাণীটিকে গৃহপালিত পশু হিসেবে পালন করে নানাবিধ কাজে ব্যবহার করে। এই জাতিটি চীনের একমাত্র পশু শিকারী জাতি হিসেবে খ্যাত। যদিও এদের মোটসংখ্যা এখন পর্যন্ত মাত্র ২০০ জনের সামান্য কিছু বেশি। তবে এখনো তাদের মধ্যে অধিকাংশই গভীর জঙ্গলে শিকারির জীবনযাপনে অভ্যস্থ রয়েছে।
সুবর্ণা. আচ্ছা, তাহলে এখন আমরা বার্চ বৃক্ষ নিয়ে একটি সুন্দর গান শুনতে পারি। এ গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন বিখ্যাত শিল্পী পুশু। গানের কথায় রয়েছে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য আর জীবনাচারের বর্ণনা-শান্ত একটি গ্রাম, তুষার পড়ছে অবিরত, অন্ধকার আকাশে উড়ে যায় কবুতর আর বার্চ বৃক্ষের বুকে খোদাই করা থাকে প্রেমিক ও প্রেমিকার নাম। প্রেমিক প্রেমিকার আজীবন প্রতিজ্ঞা দু'জন দু'জনকে ছেড়ে যাবে কখনোই। কিন্তু হঠাত্ একদিন শুরু হয় যুদ্ধ, ছেলেটি চলে যায় যুদ্ধের ময়দানে, আর মেয়েটি উত্কণ্ঠার চোখে তাকিয়ে থাকে বার্চ বনের আকাবাঁকা পথের দিকে। কিন্তু হায়! ছেলেটি যুদ্ধে প্রাণ হারায়, মেয়েটি নাম লেখা বার্চ বৃক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে দু'জনের প্রেমের গল্প স্মরণ করে.. দু'চোখে গড়িয়ে যায় কান্নার জলধারা।
লিপন. এ গানটি শুনে মনে ভীষণ চাপ লাগে, ভীষণ কষ্ট বোধ হয়। প্রেম হল মানুষের জীবনী সুধা, যা পান করলে জীবনে বেঁচে থাকা, এগিয়ে চলার মানে তৈরি হয়.. পৃথিবীকে মনে হয় স্বর্গধাম। কিন্তু যখন এই প্রেম হারিয়ে যায়, মনের গহীনে বিনেসুতার মালাটি কোথায় যেন ছিড়ে যায়, একাকি দাঁড়িয়ে থাকা বার্চ বৃক্ষের মতো ভীষণ নিসঙ্গ মনে হয় এই সবুজ পৃথিবীকে। আচ্ছা, এবারে হুলুনবে'র ভ্রমণ সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য জানা যেতে পারে। যেমন হুলুনবে'র কি কি পর্যটন স্থান বেশ আনন্দদায়ক? পেইচিং থেকে তৃণভূমিতে পৌঁছাতে কত সময় লাগবে? তৃণভূমিতে বেড়াতে আসলে কতদিন দরকার? ইত্যাদী।
সুবর্ণা. বিমানে পেইচিং থেকে হুলুনবে' যেতে প্রায় ৩ ঘন্টা সময় নিবে এবং সেখানে তৃণভূমিতে বেড়াতে গেলে কমপক্ষে এক সপ্তাহের সময়ের প্রয়োজন। আপনি যদি সেখানে যান, অবশ্যই মানচৌলি শহরেও যেতে হবে আপনাকে। এ শহর থেকে একটি গাড়ি ভাড়া করে তৃণভূমির বিভিন্ন এলাকায় ভ্রমণ করতে পারেন। আমি যখন সেখানে যাই, তখন ঘন বার্চ বন আমারে মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। বারবার গাড়ি থামিয়ে রাস্তার দু'পাশে থাকা গভীর বার্চ বনের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করেছি। এখানে পার্কের মত বসার জন্য কাঠের বেঞ্চ রয়েছে, আপনি চাইলেই একটু বসে বিশ্রাম নিতে পারেন অথবা মাতা উচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বার্চের সাথে ছবি তুলতে পারেন। আর জলাভূমি ও তৃণভূমির দৃশ্যও দারুণ উপভোগ্য, যেন ছবির মতো সুন্দর, রাতে তৃণভূমির তাঁবুতে বসে মঙ্গলীয় জাতি-সংস্কৃতির গান আর মাতাল সুরের মূর্ছনায় আকাশের তারা দেখার সুখ আর কোথাও পাবেন না আপনি তা হলফ করে বলতে পারি। এখানে বেড়াতে আসলে শহরের যান্ত্রিক জীবনের গতি যেন হঠাত থমকে যায়, জীবনটা মূহুর্তেই যেন প্রকৃতির ন্যায় শান্ত, সৌম্য আর গভীর হয়ে ওঠে।