অনেক অনেক আগের কথা। তখন চাঁদের দেশ থেকে ছোট ছোট পরী নেমে এসে পৃথিবীতে খেলা করতো, ছুটে বেড়াত এদিক সেদিক। বনের মধ্যে চাঁদের আলোয় কেউ কেউ তাদের দেখতে পেতো— মৌমাছির মতো স্বচ্ছ পাতলা ডানা মেলে তারা বনের অন্ধকারে লুকিয়ে পড়ত আর তাদের দেখা যেত না।
আর ঐ বনের মধ্যে খেলা করতে আসতো সেই বনের কাছের একটি ছোটো ছেলে। ছেলেটির বাড়ি ছিল ঐ বনেরই ধারে, ছোট্ট একটি কুটিরে বাস করতো তার বাবা আর মায়ের সাথে। ছেলেটির নাম মঞ্জু। মঞ্জুর বয়স মাত্র আট বছর। তার মনে ভারি দুঃখ কারন তার কোনো খেলার সাথি নেই। বাবা মা আছে তবে তারাতো সবসময়ে তার খেলার সাধ মেটাতে পারে না। মঞ্জু একা একা ঘুরে বেড়ায় আর সুযেগ পেলেই একা একা বনের মধ্যে চলে যায়। বনের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে তার খুব ভাল লাগে। সেখানে ছোট ছোট বেশ কিছু পশু পাখি আর পতঙ্গ মঞ্জুকে খুব ভালবাসে। মঞ্জুকে দেখলেই তারা ছুটে আসে, খেলতে থাকে নানান খেলা। খরগোশেরা মঞ্জুকে দেখে লাফালাফি করে তাকে ঘিরে নাচতে থাকে। কাকাতুয়া গাছের ডালে বসে গলা বাড়িয়ে গান গায়— বলে কতশত কথা। কাঠবেড়ালি পাকা ফল পেড়ে তার পায়ের কাছে ফেলে দেয় আর ফড়িংতো রীতিমত লাফিয়ে লাফিয়ে তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় কত অজানা সুন্দর সুন্দর জায়গায়। এভাবেই বনের মধ্যে সবার সাথে তার সম্পর্ক আর খেলাধুলায় সময় কেটে যায়।
তবে সেই বনে ছিল একটি রূপী-বানর। সেই ছিল মঞ্জুর একমাত্র শত্রু। বানরটি কোনোভাবেই মঞ্জুকে দেখতে পারে না। মঞ্জুর সাথে দেখা হলেই সে উপর থেকে মুখ ভ্যাংচায়, কিচির মিচির করে ঝগড়া করে। মঞ্জুও তাকে ঢেলা ছুড়ে মারে— আর তখন বানরটি এডাল ওডাল করে লাফাতে লাফাতে দূর বনে চলে যায়। আবার বানরটিও মঞ্জুকে শায়েস্তা করার জন্য বনের পথে পথে গর্ত করে লতাপাতা দিয়ে ঢেকে দিয়ে ফাঁদ তৈরী করে রাখে যাতে সে গর্তের মধ্যে পড়ে যায়। কিন্তু মঞ্জু কখনোই সে- সব গর্তে পড়ে না। কারণ ফড়িং তাকে সাবধান করে দয়ে বলে— " মঞ্জু ভাইয়া ওদিকে যেও না, ওখানে দুস্ট রূপীটা তোমার জন্য ফাঁদ পেতে রেখেছে। রূপীটা ভারী বজ্জাত তুমি সব সময় ওকে এড়িয়ে চলবে"
এদিকে দুষ্ট রূপী আবার ফড়িং এর এই কথা শুনতে পায়, সেও ওমনি ফড়িংকে বলে- "এই পুচকে ফড়িং, তুই আমার ফাঁদের কথা বলে দিয়েছিস। দাড়া এর মজা আমি তোকে ঠিক পাইয়ে দেবো"। এই বলে সে ভেংচি কেটে গালাগালি করত থাকে।
একদিন মঞ্জু বনের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সেদিন ফড়িংসহ কোনো প্রাণীর দেখা পাচ্ছিল না। সেদিন খরগোশ আর কাঠবিড়ালির সাথেও দেখা হলো না। অনেক খুঁজেও তাদের কারোই দেখা পাওয়া গেল না।
আসলে সেদিন রাতে খরগোশ অনেক খেলাধুলা করায় তাদের কারো কারো শরীর ব্যথা হয় আবার কারো বা গলা ব্যথা হয় তাই তারা আর বের হয় না। পাথরের নিচে গর্তের ভিতর একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে বিশ্রাম করতে থাকে। কাকাতুয়াদের ছিল একটি জরুরী সভা তাই তারা সবাই সেখান চলে যায়। ফড়িং-এর বাচ্চা হবে তো তাই সব ফড়িং সেখানে মা ফড়িংটির কাছে অপেক্ষা করছে। আর প্রতিদিন একই খাবার খেতে খেতে কাঠবিড়ালির ছোট্ট ছেলেটির মুখে অরুচি তৈরী হয়েছে, তাই সে ভিন্ন স্বাদের কিছু খাবার খুঁজে নিয়ে আসতে গেলো দূর বনে।
এদিকে একলা বনে ঘুরতে ঘুরতে মঞ্জুর মন উদাস হয়ে যায়। সে ভাবতে থাকে আহ আমার যদি একজন খেলা সাথী থাকতো তাহলে দুজনে মিলে কতই না খেলা খেলতে পারতাম।
এই কথা ভাবতে ভাবতে মঞ্জু চলছিল বনের পথে, হঠাত্ সে একটি গর্তের মধ্যে পড়ে যায়। দুষ্ট বানর রূপীটা গর্তের মুখ এমনভাবে লতাপাতা দিয়ে ঢেকে রেখেছিল যে, কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। গর্তের মধ্যে পড়ে গিয়ে মঞ্জু আবার উঠে আসার চেষ্টা করে কিছুতেই উঠে আসতে পারে না। উল্টো গর্তের খাড়া পাড় আর ভিতরের ধারালো ডাল-পালায় পায়ের বিভিন্ন জায়গায় কেটে যায়। এদিকে মঞ্জুর এই দুদর্শা দেখে দুষ্ট বানর রূপী খিলখিল করে হাসতে থাকে আর কিচিরমিচির স্বরে বলত লাগলো— 'কেমন মজা! এবার বাড়ি যাবি কেমন করে? বেশ হয়েছে, এখন সারাদিন এই গর্তের মধ্যে পড়ে থাক, আর আসবি বনে মধ্যে?"
| ||||