এখন রেশম পথ সম্পর্কে কিছু মজার তথ্য আপনাদের সাথে ভাগাভাগি করতে চাই।
রেশম পথের পূর্ব সুচনাস্থল চীনের সি আন শহর। চীনের সান সি, কান সু, নিং সিয়া, ছিং হাই ও সিনচিয়াং প্রদেশ হয়ে পামির মালভূমি অতিক্রম করে, মধ্য এশিয়া, আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক, সিরিয়া হয়ে শেষে ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তীরে পৌঁছেছে রেশম পথ। ৭ হাজার কিলোমিটারের এ পথে ঘটেছে অসংখ্য চিরস্মরণীয় ঘটনা। এ পথের সাথে জড়িয়ে আছে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির গল্প। এখন আমরা তাদের সঙ্গে পরিচিত হব।
হান রাজবংশের রাজা লিউ ছে। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫৯ সালে লিউ ছে চীনের রাজা হন। তখন দেশে শান্তি ও সমৃদ্ধি ছিল। তাই লিউ ছে কূটনীতির ওপর আরও গুরুত্ব প্রদান করেন। পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে যোগাযোগের জন্য তিনি দুই বার দূত ছাং ছিয়ানকে পাঠান। এভাবেই চীন প্রথমবারের মতো বাইরে দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ করে। ছাং ছিয়ানও ছিলেন চীনের একজন শ্রেষ্ঠ কূটনীতিবিদ। খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৮ সালে ছাং ছিয়ান প্রায় এক'শ জন প্রতিনিধি নিয়ে সি আন থেকে পশ্চিমে যান। অবশ্য পথে হুন (hun) জাতির লোকেরা তাকে আটক করে এবং সেখানে তিনি ১১ বছর কাটাতে বাধ্য হন। পরে তিনি পালিয়ে পশ্চিমদিকে যেতে থাকেন। সেখানে তার দেখা হয় তা ইউয়ু চি জাতির মানুষের সংঙ্গে। পরে তিনি একা একা সি আনে ফিরে আসেন। পশ্চিম অঞ্চলে তিনি যা দেখেছেন ও শুনেছেন তা রাজা লিউ ছেকে জানান ছাং ছিয়ান। খ্রিষ্টপূর্ব ১১৯ সালে ছাং ছিয়ান দূত হিসেবে আবার শুরু করেন তার পশ্চিমমুখী যাত্রা। এবার তিনি দশ বারো হাজার গরু ও ছাগল এবং রেশম নিয়ে পশ্চিমের অনেক দেশ সফর করেন। ওই দেশগুলোও সি আনে সফরের জন্য নিজেদের দূত পাঠায় এবং এভাবে হান রাজবংশ ও পশ্চিমাঞ্চলের দেশগুলোর যোগাযোগ দিন দিন ঘনিষ্ঠ হয়।
বান ছাও আরেকজন বিখ্যাত কূটনীতিক। ৭৩ সালে বান ছাও বিশেষ দূত হিসেবে পশ্চিম সফর করেন। তার সাহায্যে পশ্চিমের বিভিন্ন দেশ হুন মানুষের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি পেয়েছে। তিনি পশ্চিমাঞ্চলে ৩০ বছরের মতো বসবাস করেন এবং কাজ করেন। বান ছাওর আদেশে কান ইং নামে এক ব্যক্তি মহান ছিন দেশে সফর করেন। কান ইং সবচেয়ে দূরে পারস্য উপসাগরে যান। ১৬৬ সালে মহান ছিনও নিজের দূত লুও ইয়াং শহরে পাঠিয়েছেন। এটা ইউরোপ ও চীনের মধ্যে প্রথম সরাসরি যোগাযোগ।
রাজকুমারী চে ইউয়ো খ্রিষ্টপূর্ব ১২০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ১০১ সালে শুধু ১৯ বছর বয়সী চে ইউয়ো তখনকার উ সুন দেশের রাজা কুন মোর সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। উ সুনে চে ইউয়ো সবসময় বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও দরিদ্র পরিবার পরিদর্শন করতেন। যখন উ সুন দেশে ভূমিকম্প বা পাহাড়ি ঢলসহ প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা ঘটতো তখন চে ইউয়োও দুর্গত মানুষের সেবায় এগিয়ে যেতেন। তার উদ্যোগে উ সুন দেশে কৃষিশিল্প অনেক উন্নত হয়। চে ইউয়োর পরামর্শে উ সুন, তা ওয়ান, কাং চুসহ বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাণিজ্যবন্দর উন্মুক্ত করা হয়। এ দেশগুলো বর্তমান মধ্যএশিয়ায় অবস্থিত ছিল।
চে ইউয়ো সি হান রাজবংশের একজন রাজকুমারী। এখন আমরা আলোচনা করবো চীনের থাং রাজবংশের বিখ্যাত নারী ওয়েন ছেং সম্পর্কে।
রাজকুমারী ওয়েন ছেং আসলে রাজার মেয়ে নন । তার বাবা ছিলেন রাজার ভাতিজা। ৬৪১ সালে রাজকুমারী ওয়েন ছেং তিব্বতের রাজা সুং চান কান পুর সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। সি আন থেকে রওনা হন রাজকুমারী ওয়েন ছেং। বর্তমান ছিং হাই প্রদেশ অতিক্রম করে শেষে লাসা শহরে পৌঁছান তিনি। জানা গেছে, তিব্বতে যাওয়ার পথে কিছুসময় ছিং হাই প্রদেশের ইউয়ু সু জেলার পে নাই কোতে বসবাস করেন রাজকুমারী ওয়েন ছেং। ওখানে তিব্বত জাতির সর্দার ও মানুষ তাদের জন্য অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান আয়োজন করে। এ দেখে রাজকুমারী ওয়েন ছেং অনেক মুগ্ধ হন এবং তাদের কৃষি ও টেক্সটাইলের প্রযুক্তি শিখিয়ে দেন।
থাং রাজবংশে চীন ছিল বিশ্বে সবচেয়ে উন্নত ও শক্তিশালী এক দেশ। রাজকুমারী ওয়েন ছেং অনেক উন্নত প্রযুক্তি ও সংস্কৃতি তিব্বত অঞ্চলে নিয়ে আসেন এবং নানা ক্ষেত্রে তিব্বতের ওপর প্রভাব ফেলেন। বিশেষ করে রাজকুমারীর ওয়েন ছেং-এর জন্য সুং চেন কান পু নির্মাণ করা পোতালা ভবন এখনও তিব্বতের সবচেয়ে বিখ্যাত একটি পর্যটনদৃশ্য।
দু'জন রাজকুমারীর কথা বলার পর এখন বলব প্রাচীনকালে রেশম পথে গিয়েছিলেন এমন দুজন বিখ্যাত পরিব্রাজকের কথা। চীনা বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ সংগ্রহের জন্য ৩৩৯ সালে প্রায় ৬০ বছর বয়সী পরিব্রাজক ফা সিয়ান ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি কয়েকজন পরিব্রাজকের সঙ্গে সি আন থেকে তুন হুয়াং মরুভূমি অতিক্রম করে শেষে ভারতে পৌঁছান। পথিমধ্যে তারা অনেক কষ্ট স্বীকার করেন এবং পথে কয়েকজন সঙ্গী পথে মারা যান। পরিব্রাজক ফা সিয়ান ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের গ্রন্থ সহজে খুঁজে পাননি। ভারতে তিনি নানা জায়গায় ঘুরেছেন এবং বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলোর নকল করেন। ৪১২ সালে তিনি সমুদ্রপথে চীনে ফিরে আসেন এবং নকল করা সব বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ অনুবাদ করেন। তিনি এ যাত্রার অভিজ্ঞতা নিয়ে 'ফো কুও চি' শীর্ষক একটি বই রচনা করেন। তার লেখা রেশম পথ এবং চীন ও ভারতের সম্পর্কের বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ একটি দলিল।
ফা সিয়ান ছাড়া, চীনে আরেকজন বিখ্যাত পরিব্রাজক ছিলেন হিউয়েন সাং। তিনিও বিখ্যাত কূটনীতিক,অনুবাদক ও চিন্তাবিদ। ১৭ বছর ধরে তিনি পশ্চিমমুখী ২৫ হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেন। তিনি গোটা ভারত ঘুরে বেড়ান এবং সারা জীবনে অনেক বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ অনুবাদ করেন। তার চিন্তাধারণা জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া এমনকি সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে উঠে এবং আমাদের অভিন্ন সম্পদে পরিণত হয়।