Web bengali.cri.cn   
চাঙ্গা পুঁজিবাজার, সতর্কতার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
  2014-02-03 19:45:10  cri

জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা খানিকটা ফিরে আসা এবং বিদেশি বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়ায় এ ধারা সূচিত হয়েছে। তবে পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকার এবং পেশাদার আচরণ করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা; বলেছেন সতর্ক না হলে আবারও ধসের মুখে পড়তে পারে শেয়ারবাজার।

বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন-পূর্ববর্তী সহিংসতা আপাতত বন্ধ হওয়ার কারণে বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরতে শুরু করেছে। অন্যদিকে লেনদেন ও সূচক ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধির ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও আস্থা ফিরতে শুরু করেছে।

সেন্ট্রাল ডিপোজটরি বাংলাদেশ সূত্রে জানা গেছে, কেবল জানুয়ারি মাসে বিও অ্যাকাউন্টধারীর সংখ্যা বেড়েছে ৬১ হাজার ৫২৪টি। বর্তমানে দুই বাজারে সক্রিয় বিও অ্যাকাউন্ট রয়েছে মোট ২৮ লাখ ৫৬ হাজার ৪৫১টি।

জানুয়ারিতে ২০ কার্যদিবসে প্রধান বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)-এ ১২ হাজার ৬১৫ কোটি টাকার শেয়ার হাতবদল হয়। ওই সময় গড় লেনদেন হয় ৬৩০ কোটি টাকা, যা ডিসেম্বর মাসের একই সময়ে লেনদেন হওয়া ৯ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকার চেয়ে দুই হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা বেশি। এক মাসের ব্যবধানে ডিএসইতে লেনদেন বৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ২৭ শতাংশে। অন্যদিকে, জানুয়ারি মাসের ২০ কার্যদিবসে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) মোট লেনদেন হয় এক হাজার ১৬৫ কোটি টাকা।

ওই সময়ে ডিএসইতে বাজার মূলধন ২২ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা বেড়ে দুই লাখ ৮৭ হাজার ৫৭১ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও বাজার মূলধন বৃদ্ধি পায় ২২ হাজার ৬১২ কোটি টাকা। ওই সময়ে ডিএসই ও সিএসইতে সূচক বাড়ে যথাক্রমে ৪৮৭ এবং এক হাজার ৫৮৪ পয়েন্ট।

পুজিঁবাজার বিশ্লেষক ড. মোহাম্মদ আকতার বলেন, নতুন সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসার কারণে বাজারে চাঙ্গাভাব দেখা দিয়েছে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। এ ছাড়া ব্যাংকে জামানতের ওপর সুদের হার কমিয়েছে সরকার। এ কারণে কিছু অর্থ শেয়ারবাজারে আসছে।

পাঁচ জানুয়ারি নির্বাচনের পরে প্রথম কার্যদিবসে ডিএসই প্রধান সূচক প্রায় ৩০০ পয়েন্ট বেড়ে যায়। ওই সময়ে বাজারে দৈনিক গড় লেনদেন হয় ৭০০ কোটি টাকা।

চিটাগং ইনভেস্টরস ফোরামের আহ্বায়ক আছলাম মোরশেদ বলেন, দুই মাস ধরে বাজার বেশ ধারাবাহিক আচরণ করছে, যেটা খুব ইতিবাচক। তিনি বলেন, নতুন সরকার গঠনের কারণে হানাহানি ও রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসান হওয়ায় তার প্রভাব পড়েছে বাজারে। এ কারণে বিনিয়োগকারীরাও তাঁদের ক্ষয়ক্ষতি ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠছেন। তাঁর ধারণা, মন্দ সময় পেরিয়ে একটা ভালো অবস্থানের দিকে যাচ্ছে পুঁজিবাজার।

তবে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগমনও ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসতে পুজিঁবাজারকে ব্যাপক সহায়তা করেছে বলেও মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক। তারা বলছেন, টাকার বিপরীতে ডলার শক্তিশালী হওয়ায় এবং এর আগে শেয়ারের দর ব্যাপকভাবে নেমে যাওয়ায় মুনাফার আশায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে অর্থাত্ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে আড়াই হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ৩১ কোটি ডলারের পোর্টফোলিও বিনিয়োগ এসেছে বাংলাদেশে। এই অঙ্ক আগের অর্থবছরের পুরো সময়ের চেয়েও প্রায় ২০০ কোটি টাকা বেশি এবং জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ১১ কোটি ৬০ লাখ ডলার বা এক হাজার ১৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে ২০১২-১৩ অর্থবছরের পুরো সময়ে এসেছিল ২৮ কোটি ৭০ ডলার, যেখানে ২০১১-১২ অর্থবছরে পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২৪ কোটি ডলার।

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ সহায়তা প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের একজন কর্মকর্তা জানান, প্রতিদিনই কিছু নতুন বিদেশি বিনিয়োগকারী দেখতে পাচ্ছেন তারা। এর ফলে আস্থা ফিরে পেয়ে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরাও বাজারমুখী হচ্ছেন এবং তার প্রভাবেই লেনদেনে সাম্প্রতিক চাঙাভাব দেখা যাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।

বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ার কারণ সম্পর্কে ওই কর্মকর্তা জানান, ব্যাংক খাতের শেয়ারসহ মৌলভিত্তিক শেয়ারের দর অনেক কমে গিয়েছিল। ওই সব শেয়ারে বিনিয়োগকে লাভজনক ভেবে তারা এগিয়ে আসছে। তাছাড়া বেশ কিছু দিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল রয়েছে বাংলাদেশে, যেটি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে আসার ক্ষেত্রে অবদান রাখছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে গত প্রায় ১০ মাস ধরে ডলারের দর রয়েছে ৭৭ দশমিক ৭৫ টাকার কাছাকাছি, অথচ গত ছয় মাসে ডলারের বিপরীতে প্রতিবেশি দেশ ভারতের মুদ্রা রুপি প্রায় ৪ শতাংশ দর হারিয়েছে।

বিদেশি বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়াকে পুঁজিবাজারের জন্য সার্বিক অর্থে ইতিবাচক বলে মনে করছেন স্টক এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, যে কোনো পুঁজিবাজারে ৪ থেকে ৫ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগ থাকা ভালো।

তিনি বলেন, ২০০৯-১০ সালে বাজারে বড় ধসের পর বিদেশি বিনিয়োগ ছিলই না প্রায়। কিন্তু গত বছরের প্রথম দিক থেকে কিছু বিনিয়োগকারী আসতে শুরু করে।

মির্জ্জা আজিজও মনে করেন, টাকার বিপরীতে ডলারের শক্তিশালী অবস্থান বিদেশিদেরকে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে আকৃষ্ট করছে। তবে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, কোনো কারণে তারা চলে গেলে তা বাজারকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে।

তিনি উল্লেখ করেন, ১৯৯৭-৯৮-এর দিকে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া ও থাইল্যান্ডের পুঁজি বাজারে যে ধস নেমেছিল, তার প্রধান কারণ ছিল এমন অল্প সময়ের বিদেশি বিনিয়োগ।

কোনো কারণে বিদেশি বিনিয়োগের একটি অংশ চলে গেলেও যাতে বাজার তার ধকল সইতে পারে সেদিকে নজর রাখতে সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, স্টক এক্সচেঞ্জ ও বিনিয়োগকারীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে পরামর্শ দেন তিনি।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের হিসাবে দেখা যায়, গত বছরে এ বাজারে প্রায় ৩ হাজার ৩৬১ কোটি টাকার বৈদেশিক লেনদেন হয়। এর মধ্যে বিদেশিরা দুই হাজার ৬৫২ কোটি টাকার শেয়ার কেনে এবং বিক্রি করে ৭০৯ কোটি টাকার শেয়ার। ফলে বছর শেষে প্রকৃত বিদেশি বিনিয়োগ দাঁড়ায় ১ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা; যা ২০১২ সালে ছিল ৭৯৩ কোটি টাকা।

বিশ্লেষকদের ভাষ্য, যখন কোনো কোম্পানির শেয়ারের বাজারমূল্য মৌলভিত্তির নিচে নেমে যায় এবং অধিকাংশ বিনিয়োগকারী হতাশ হয়ে পড়ে, তখনি বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কেনে। আবার যখন বাজারের প্রতি অধিকাংশ বিনিয়োগকারীর আগ্রহ বাড়ে, তখন বিদেশিরা বিক্রি করে।

মির্জ্জা আজিজ বলেন, অতীতের অভিজ্ঞতা হলো, কোনো দেশে সরকার বদলকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিলে, শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ে। কারণ, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে পুঁজিবাজারে। এই সুযোগটি কাজে লাগায় বিদেশিরা।

বিগত ১৯৮০ সালে প্রণীত ফরেন প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট (প্রমোশন অ্যান্ড প্রোটেকশন) আইনের আওতায় বিদেশিরা সহজ শর্তে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে বিদেশিরা কোনো কোম্পানির প্রাথমিক শেয়ার কিনলে, সেগুলো বিক্রিতে কিছু বিধি-নিষেধ ছাড়া বাজার থেকে কেনা শেয়ার বিক্রি বা মুনাফা তুলে নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বিধি-নিষেধ নেই। প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে শেয়ার কিনলে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিদেশিরা ওইসব শেয়ার বিক্রি করতে পারে না।

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের একটি বড় নেতিবাচক দিক হলো এখানে সত্যিকারের বিনিয়োগকারীর সংখ্যা কম। যারা সক্রিয় থাকেন, তাদের বড় অংশই আসলে ট্রেডার, যাদের দ্রুত লাভ করার প্রবণতা থাকে। পুঁজিবাজারকে স্বাভাবিক রাখতে এমন অবস্থার অবসান ঘটিয়ে সংশ্লিষ্ট সবার পেশাদারি আচরণ প্রয়োজন। তাহলেও বড় ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকবে বাজার। (এসআর)

মন্তব্য
Play
Stop
ওয়েবরেডিও
বিশেষ আয়োজন
অনলাইন জরিপ
লিঙ্ক
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040