চীনের আনহুই প্রদেশের হুয়াংশান পাহাড় দর্শনীয় স্থান বিশ্ব সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, বিশ্ব প্রাকৃতিক উত্তরাধিকার এবং বিশ্ব ভূতাত্ত্বিক পার্কের স্বীকৃত পেয়েছে। হুয়াংশান পাহাড় দর্শনীয় স্থানের পদদেশে অবস্থিত একটি রহস্যময় প্রাচীন গ্রাম যা বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের আকর্ষণ করে। তা হলো একমাত্র বিশ্ব সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত প্রাচীন বসতবাড়ির—সিতি গ্রাম।
সিতি গ্রাম দক্ষিণ আনহুই প্রদেশের হুয়াংশান শহরের ই জেলায় অবস্থিত। এর ইতিহাস ৯৬০ বছরেরও বেশি। এখানকার গ্রামবাসীদের মর্যাদা অস্বাভাবিক। তারা মধ্য চীন থেকে এখানে আশ্রয় নেয়া থাং রাজবংশের সম্রাট লি শি মিনের বংশধর। মিং ও ছিং সময়পর্ব পর্যন্ত এখানকার মানুষেরা চীনের প্রাচীনকালের সবচেয়ে বিখ্যাত ৪টি ব্যবসায়ী গ্রুপের মধ্যে অন্যতম—হুইচৌ ব্যবসায়ী গ্রুপ গড়ে তুলেন। তারা বাইরে থেকে পাওয়া অর্থে নিজেদের থাকার এক একটি সুন্দর সুসজ্জিত বাড়িঘর নির্মাণ করেন। পাহাড়ের অভ্যন্তরে এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে দূরে থাকার কারণে এখানকার লোকজন রীতিনীতি সরলমনা। গ্রামবাসীদের বংশ পরম্পরায় থাকা পুরানো বাড়িঘরও এখন পর্যন্ত পুরোপুরিভাবে টিকে আছে।
সিতি গ্রামে সবচেয়ে সাধারণ বাড়িঘরের ইতিহাসও ৩শ' থেকে ৪শ' বছরের। কোন কোন বিদেশী পর্যটক বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন যে, এখানকার বাড়িঘর তাদের দেশ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের চেয়েও বেশি পুরানো। ই জেলার হুইচৌ সাংস্কৃতিক গবেষণালয়ের পরিচালক ইয়ু জি হুয়াই বলেছেন, প্রাচীনকালে হুইচৌ-এর মানুষ বাড়িঘর নির্মাণ করার সময় বিশেষ করে রঙের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতেন। তারা মনে করতেন সাদা দেয়াল ও কালো টালি সবুজ পাহাড় ও পানির সঙ্গে খাপ খায়। এ রকম পরিবেশে এক ধরনের শান্তি ও স্থিরতা দেখা যায়। হুইচৌর বাড়িঘরের আরেকটি বৈশিষ্ট্য আছে। তা হলো একটি সম্পূর্ণ ঘরের ছাদে একটি থিয়ান চিং অর্থাত আকাশ কুয়া তৈরি। ইয়ু জি হুয়াই বলেন,
এ ঘরে থাকলে দিনে নীল আকাশ ও সাদা মেঘ দেখা যায়। রাতে তারা ও চাঁদ দেখা যায়। এর সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যময় বিষয় হলো, বৃষ্টি বা বরফ পড়লে তা ঘরের মাঝখানে পড়বে। প্রাচীনকালের হুইচৌ'র মানুষ মনে করতেন, বৃষ্টি পড়া মানে সোনা পড়া। বরফ পড়া মানে রূপা পড়া। তারা আশা করেন, আকাশের এসব ধনসম্পদ সবই তাদের নিজেদের ঘরে আসবে এবং বাইরে যাবে না। পাশাপাশি সাধারণ মানুষ থিয়ান চিং-এ একটি বড় জলাধার রাখা হতো। শুকনো মৌসুমে এ জলাধারের মাধ্যমে আগুণ প্রতিরোধের ভূমিকা পালন করার পাশাপাশি ঘরের আবহাওয়া সুবিন্যস্ত করা যায়। শুকনো মৌসুমে আর্দ্রতা বাড়ানোর পাশাপাশি গরমের দিনে অল্প কিছু ঠাণ্ডা বাড়ানো যায়।
১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ইউনেস্কো সিতি গ্রামকে প্রাচীন গ্রামের প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্ব সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করার সময় মনে করে, ঐতিহ্যবাহী এই প্রাচীন গ্রামটিতে গত শতাব্দীতে বিলুপ্ত বা পরিবর্তিত গ্রামের চেহারা বজায় রয়েছে। এখানকার সড়কের ধরন, প্রাচীন স্থাপত্য ও সাজসজ্জা এবং পানি সরবরাহ ব্যবস্থা সম্পন্ন বসতবাড়ী খুবই বৈশিষ্ট্যময় সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। অনেক পর্যটকের চোখে সিতি আধুনিক সমাজের ভুলে যাওয়া একটি পুরানো স্বপ্নের মতো। এখানে নগরের হৈচৈ থেকে দূরে থাকা এক ধরনের পরিষ্কার ও সরল জীবন দেখা যায়।
হুপেই প্রদেশের রাজধানী উহানের পর্যটক চোং ইয়োং সবেমাত্র স্থানীয় 'পাও সিউ ছিউ' লোক সংস্কৃতির পরিবেশনা উপভোগ করেছেন। তিনি বলেন,
মনে হলো আমি আগে দিনে ফিরে গেলাম। খুব প্রাচীনকালের ও সরলমনা। এছাড়া এখানকার দৃশ্যও খুবই সুন্দর। আমি এ রকম বসতবাড়ী দেখতে পছন্দ করি।
চিয়াংসু প্রদেশের পর্যটক উ সু পিং গত বছরের শীত্কালে প্রথমবারের মত সিতি গ্রাম ভ্রমণ করার সময় গভীরভাবে এই জায়গাটি পছন্দ করেন। চলতি বছরের বসন্ত উত্সবের শেষে তিনি চাকরি ছেড়ে সিতি গ্রামের স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে 'সিয়াং লিন ইউয়ান' নামের একটি গ্রাম হোটেল খুলেছেন। তিনি এখানে চিরস্থায়ী জীবনযাপনের প্রস্তুতি নিয়েছেন। তিনি বলেন,
এখানকার হুইচৌ স্থাপত্য সম্পূর্ণভাবে সংরক্ষিত। লোকদের রীতিনীতি সরল ও শান্তিপূর্ণ। চিরস্থায়ীভাবে থাকার জন্য উপযুক্ত। তাদের আগের জীবনযাপনের পদ্ধতিতে মৌলিকভাবে কোনো পরিবর্তন হয়নি। অনেক পর্যটক আসলেও মৌলিকভাবে আগের জীবনযাপনের অবস্থা বজায় রয়েছে। ব্যবসায়িক আমেজ খুব কম।
1 2 |