পয়লা অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ৭০তম বার্ষিকী। গত ৭০ বছরে চীনের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা কয়েকজন বিদেশির চোখে চীনের এই বিশাল পরিবর্তনের গল্প আপনাদের সাথে শেয়ার করবো, সাথে সাথে চীন সম্পর্কে তাঁদের ধারণাও তুলে ধরবো।
বেইজিং ভাষা ও সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশি শিক্ষক জেওন সুজুংয়ের চোখে চীন
১৯৯৩ সালের শরত্কালে জেওন সুজুং সিউল থেকে বেইজিংয়ে এসে ভাষা ও সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএলসিইউ) একজন ছাত্রী হিসেবে চীনা ভাষা শিখতে শুরু করেন এবং অবশেষে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। লেখাপড়ার সময়ের চীন সম্পর্কে স্মৃতি নিয়ে জেওন বলেন, তখন বেইজিংয়ে রাস্তায় গাড়ি দেখা যেতো না, তবে বহু সাইকেল দেখা যেতো। চলতি বছর গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ৭০তম বার্ষিকী। চীনের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে, বিশেষ করে গত কয়েক বছরে মোবাইল পেমেন্ট ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়েছে, তা মানুষের জীবনযাপনে অনেক সুবিধা বয়ে এনেছে। তিনি বলেন,
'দক্ষিণ কোরিয়ায় অনেকে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন, তবে চীনে তা ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। চীনে সবাই আলিপেই ও উইচ্যাট ব্যবহার করেন এবং এর মাধ্যমে প্রায় সব ধরনের কেনাকাটায় পে করা যায়। এ পরিবর্তন অনেক দ্রুত। আমি যখন বেইজিংয়ে আসি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে ইমেইল দিয়ে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়, তবে বর্তমানে সবাই উইচ্যাট ব্যবহার করেন, অর্থাত্ এখন একটি মোবাইল ফোন দিয়েই সব কাজ করা যায়, সেটি আধুনিক উন্নয়নের প্রতীক।'
বেইজিং ভাষা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করার পর স্বদেশে ফিরে যান জেওন। তবে তিনি কোনো না কোনোভাবে চীনের সাথে যুক্ত থাকেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, তখন তার শিক্ষক তাকে চীনা উপন্যাস অনুবাদ করতে উত্সাহ দেন। এরপর তার মধ্যে চীনা উপন্যাস অনুবাদ করার ইচ্ছা তৈরি হয়। একবার চীনা লেখক ছাও ওয়েন স্যুয়ানের উপন্যাস 'লাল টাইল' পড়ে মুগ্ধ হয়ে এ বইয়ের অনুবাদ কাজ শুরু করেন। প্রায় দুই বছর ধরে ৪ লাখেরও বেশি অক্ষরের অনুবাদ দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রকাশিত হয়। তিনি বলেন,
'ওই বই প্রকাশিত হবার পর আমি বইটি নিয়ে আমার শিক্ষকের সাথে দেখা করি। তখন তিনি অবাক হয়ে বলেন যে, তুমি সত্যিই এ অনুবাদ শেষ করেছ! তখন আমি উত্তর দেই, 'আপনি মনে করেন আমি করতে পারি!' তখন তিনি হেসে বলেন, 'আমি প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে এমন কথা বলি, তবে শুধু তুমি তা বিশ্বাস করেছো এবং এ কাজ সম্পন্ন করেছ!' এভাবে আমি সাহিত্য অনুবাদের কাজ শুরু করি। নিজের অনুবাদকৃত বই প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হওয়ার স্মৃতি কখনো ভুলতে পারবো না!'
তারপর থেকে জেওন অনুবাদ কাজ শুরু করেন, এ পর্যন্ত ৪০টিরও বেশি চীনা বইয়ের অনুবাদ সম্পন্ন করেছেন তিনি। চলতি বছরের গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে তিনি নিজের অনুবাদকৃত বই নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন এলাকায় বক্তব্য রাখেন এবং চীনা সংস্কৃতির প্রচার করেন।
জেওন বলেন, চীনা ভাষা শেখার প্রক্রিয়ায় তিনি ধাপে ধাপে চীনকে জানেন, চীনের জীবনযাপনে অভ্যস্ত হন এবং চীনকে পছন্দ করেন। অনুবাদের কঠিন বিষয় ভালোভাবে বোঝার জন্য ২০১২ সালে তিনি আবার বিএলসিইউতে ফিরে এসে শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন এবং এখানে কোরিয়ান ভাষা, সাহিত্য ও থিসিস লেখাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ক্লাস নেন তিনি। গত ৭ বছরে বিএলসিইউতে অনেক শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেন তিনি। সম্প্রতি তাঁর একজন শিক্ষার্থী দেশব্যাপী কোরিয়া ভাষার বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়, যা তার জন্য খুবই আনন্দের।
শিক্ষক জেওনের দৃষ্টিতে বর্তমানে চীনের শিক্ষাদান পরিবেশের অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তন শুধু অবকাঠামো নির্মাণের উন্নতি নয়, বরং আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী বিনিময় এবং চীনের ঐতিহ্যিক সংস্কৃতির অবস্থানের উন্নতি তাঁর মনে গভীর ছাপ ফেলেছে। তিনি বলেন,
'আমি লক্ষ্য করেছি, চীনাদের মধ্যে বাবা মাকে সম্মানের চিন্তাভাবনা অনেক প্রচলিত। আমি কয়েকজন শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করেছি, সুযোগ পেলে কি বিদেশে চাকরি করবে? তখন অনেকে বলে যে, তারা বাবা মায়ের কাছে থাকতে চায়। তা দক্ষিণ কোরীয় বাচ্চাদের সাথে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। তাদের কথা শুনে আমি অনেক মুগ্ধ। চীনের এমন শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্য দৃঢ় ও গভীর।'
শিক্ষক জেওন আরো বলেন, শিক্ষক হিসেবে কাজ করার প্রথম দিন থেকে এ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের দিন দিন অগ্রগতি দেখা যেন অতীতকালের নিজেকে দেখার মতো। ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসে পড়ানোর সময় তিনিও তাঁর শিক্ষকের মতো আন্তরিক ও মনোযোগ দিয়ে কাজ করেন। এটি তাঁর কাঁধের একটি দায়িত্ব।