তুরস্কের চীনা ভাষার শিক্ষার্থী ও তাদের চীনা শিক্ষক
বসন্ত উত্সবের পর তুরস্কের ছাত্রছাত্রীদের নতুন সেমিস্টার শুরু হয়েছে। ইস্তাম্বুলের উপকণ্ঠ এলাকার ওকান বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনা ভাষা বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা তাদের প্রিয় শিক্ষক সুং ছুন জুয়ের কাছে চীনা ভাষা শেখেন। ম্যাডাম সুং ছুন জু বেইজিং ভাষা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি ওকান বিশ্ববিদ্যালয়ের কনফুসিয়াস ইনস্টিডিউটে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৪ বছর ধরে তিনি সেখানে শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি তুর্কি ছাত্রছাত্রীদের সাথে গভীর মৈত্রী তৈরি করেছেন।
ওকান বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা অনুবাদ বিভাগের ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের হাসির কণ্ঠ শোনা যায়, শিক্ষক সুং চীনা ক্লাসের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তুর্কি ও ইংরেজি ভাষা ভালোভাবে না জানা সত্ত্বেও তুরস্কে ১৪ বছর ধরে কাজ করছেন তিনি। এ সম্পর্কে তিনি বলেন,
'আমরা আলাদা শব্দ থেকে শুরু করি, তারপর এর মধ্য দিয়ে চীনা ভাষার অক্ষর বোঝানোর চেষ্টা করি ও বিভিন্ন টন তুলে ধরি। যেমন 'বি' আর 'এ' একসাথে মিলে 'বা' উচ্চারণ করি, তারপর চারটি টনের উচ্চারণ পড়ি। ছাত্রছাত্রীদের নতুন শব্দ শেখা যেন ছোট ছোট তুষার সংগ্রহের মতো, খণ্ড খণ্ড তুষার মিলে তুষারের বল তৈরি হয়। এভাবে আলাদা আলাদা শব্দ মিলে ছোট ও লম্বা বাক্য শেখানো হয়। এই প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে তাদের চীনা ভাষার মান উন্নত হয়ে ওঠে।'
ম্যাডাম সুংয়ের কাছে চার বছরের মতো চীনা ভাষা শিখেছেন মিস ওজলেম গুভেন। তিনি বলেন, যদিও শিক্ষক সুং তুর্কি ভাষা জানেন না, তবে ছাত্রছাত্রীদেরকে চীনা ভাষা শেখানোর ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হয় না। মিস ওজলেম গুভেন বলেন,
'তিনি তুর্কি ও ইংরেজি ভাষা বলতে পারেন না, শুধু চীনা ভাষা বলেন। আমিও জানতাম না তিনি কিভাবে চীনা ভাষা শেখাবেন, তবে আমরা ধীরে ধীরে তাঁর সব কথা বুঝতে পারি।'
চীনা ভাষার নতুন ছাত্রী কানসু অকুমুস বলেন, শিক্ষক সুং তাঁর জন্য চীনা ভাষা শেখার নতুন দরজা খুলে দিয়েছেন। অকুমুস বলেন,
'এশিয়ার সংস্কৃতির প্রতি আমি অনেক আগ্রহী। আমি কোরিয়ান ও জাপানি ভাষাও শিখেছি এবং অবশেষে চীনা ভাষা শিখি। যখন চীনা ভাষা শেখার প্রস্তুতি নেই, তখন সুং আমাকে অনেক সাহায্য করেন। যদিও তিনি তুর্কি ও ইংরেজি বলতে পারেন না, তবে মনোযোগ দিয়ে চীনা ভাষা শেখান। তিনি শিক্ষকতা পেশা দারুণ ভালোবাসেন। শারীরিক ভাষাসহ নানান পদ্ধতিতে তিনি আমাদের জ্ঞান শিখিয়েছেন। আমরা তাঁর ক্লাস ভীষণ পছন্দ করি।'
ম্যাডাম সুং বলেন,
'আমি শিক্ষকতা পেশা ও শিক্ষার্থীদের অনেক পছন্দ করি। তাদের ভালোভাবে চীনা ভাষা বলা দেখে আমি অনেক খুশি। শুরুর দিকে তারা চীনা ভাষার কোনো শব্দও বলতে পারতো না, ধীরে ধীরে তারা আমার সাথে চীনা ভাষায় কথা বলা শুরু করে। যে-কোনো সমস্যায় তারা আমাকে সাহায্য করে, তখন আমি অনেক গৌরব বোধ করি। আমার পরিবার, স্বামী ও বাচ্চা আমার পেশাকে সমর্থন করে। এতো দীর্ঘ সময় এখানে চাকরি করার মূল কারণ পরিবারের সবার সমঝোতা ও সমর্থন।'
সুং মনে করেন, বর্তমানে তুরস্কের আরো বেশি লোকজন চীনা ভাষা শিখতে আগ্রহী। তাছাড়া, সেখানে চীনা ভাষা শেখার পরিবেশও অনেক ভালো হয়েছে। তিনি বলেন,
'আমি যখন তুরস্কে আসি, তখন এখানে চীনা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিলো খুবই কম। তখন ছাত্রছাত্রীরা আমাকে বলে, তারা চীনে যেতে চায় ও চীনা অক্ষর শিখতে চায়। এমন কথা শুনে বেশ আনন্দ পাই, তবে তখন তাদের বিস্তারিত কোনো লক্ষ্য ছিলো না। পরে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের সাথে সাথে চীনা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পায়। ফলে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা স্নাতক হওয়ার পর চীনা কোম্পানিতে ভালো বেতনে চাকরি পাওয়া শুরু করে। তাই আরো বেশি ছাত্রছাত্রী চীনা ভাষা শিখতে চায়।'
মিস ওজলেম গুভেন আরো বলেন, বর্তমানে দেশে চীনা ভাষা শেখার ছাত্রছাত্রী স্নাতক হওয়ার পর চীনা কোম্পানিতে চাকরি করতে চায়। কারণ এটি একটি ভালো সুযোগ। তিনি বলেন,
'আমাদের ক্লাসে আগে ছাত্রছাত্রী ছিলো মাত্র ১০ জন, তবে এখন ২০ জন। তাদের মধ্যে অনেকেরই চীনের সাথে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। হুয়াওয়েসহ চীনের অনেক কোম্পানিতে তারা চাকরি করতে সক্ষম। আমি মনে করি চীনে চাকরি করা খুব চমত্কার।'
তুরস্কে ম্যাডাম সুং অনেক ব্যস্ত সময় কাটান। প্রতিদিন চীনা ভাষা শেখানো ও কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটে নানা অনুষ্ঠান করার পাশাপাশি তিনি এইচএসকে পরীক্ষার কাজের দায়িত্ব পালন করেন। প্রতি বছর সেখানে প্রায় দুই শতাধিক পরীক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশ নেন। তাছাড়া, ইস্তাম্বুল ছাড়াও অন্যান্য শহরের শিক্ষার্থী এবং ইরান ও গ্রিসের শিক্ষার্থীরাও এখানে পরীক্ষায় অংশ নেন।
ছুটির দিনে তিনি নিজে চীনা খাবার রান্না করেন এবং বন্ধুরা মিলে খান। তিনি বলেন,
'ছুটির দিনে আমি বন্ধুদের সাথে ডাম্পলিং তৈরি করতে পছন্দ করি। সবাই একসাথে ডাম্পলিং তৈরি করতে মজা লাগে, আর চীনের ঐতিহ্যিক সংস্কৃতিও তুলে ধরতে পারি। যদিও মাঝে মাঝে ক্লান্তি বোধ করি, তবে ছাত্রছাত্রীদের হাসিমুখ দেখে অনেক খুশি লাগে।'
(সুবর্ণা/টুটুল)