

অধ্যাপক ফুজিনো কৈশোরে চীনা ভাষা শিখেছিলেন। চীনের প্রাচীন ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতি তার ছিল অসীম শ্রদ্ধা। তাই তিনি তার ক্লাসের চীনা ছাত্রটির প্রতি খুবই দরদী ছিলেন। ক্লাস শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ পর এক শনিবারে, অধ্যাপক ফুজিনো তার সহকারীকে পাঠিয়ে লু স্যুনকে তার গবেষণাককে ডেকে আনালেন।
" আমার লেকচার তুমি টুকে নিতে পারো?" তিনি জিজ্ঞেস করলেন। লু স্যুন উত্তর দিলেন, " একটু একটু পারি।"
" নিয়ে এসো , আমি দেখবো। "
লু স্যুন তার খাতা এনে অধ্যাপককে দিলেন। দু'তিন দিন পর , তিনি তা লু স্যুনকে ফেরত দিলেন। অধ্যাপক ফুজিনোর ভাবনা হয়েছিল যে এই চীনা ছাত্র হয়ত প্রথম প্রথম জাপানী ভাষায় লেকচার ঠিকমত অনুসরণ করতে পারে না। তিনি লু স্যুনের লেখা শুদ্ধ করে দিলেন এবং কয়েকটি স্থানে আরও কিছু যোগ করলেন। শুধু তাই নয় লু স্যুনের লেখায় যে ব্যাকরণের ভূল ছিল তাও তিনি শুদ্ধ করে দেন। এরপর থেকে প্রতি সপ্তাহে একবার করে খাতা শুদ্ধ করিয়ে নেওয়ার জন্য তিনি লু স্যুনকে আদেশ দিলেন। অধ্যাপক ফুজিনোর প্রতি লু স্যুনের মন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল। লেকচারের শেষ দিন পযর্ন্ত তিনি এই ব্যবস্থা অব্যাহত রাখেন।
একবার , অধ্যাপক ফুজিনো লু স্যুনকে তার গবেষণাকক্ষে ডেকে পাঠালেন এবং লু স্যুনের নোটবুকে রক্তচলাচল সম্পর্কে তার আঁকা চিত্রটির ওপর আঙ্গুল রেখে বললেন: " দেখ, তমি এই শিরাটির সংস্থান কিছুটা সরিয়ে দেখিয়েছ। অবশ্য এইভাবে স্থানচ্যুত করলে হয়ত ভালো দেখায়; তবে শারীরসংস্থান বিজ্ঞানের অনুচিত্র তো আর কলাশিল্প নয়, বাস্তব জিনিসের কোনো পরিবর্তন করার উপায় নেই , এবারে তোমার আঁকা অনুচিত্র আমি ঠিক করে দিলাম। এরপর থেকে ব্ল্যাকবোর্ডে যেমন আঁকা হবে ঠিক তেমনি আঁকবে।"
অধ্যাপক ফুজিনোর প্রতি লু স্যুনের মন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল। তার কথা স্মরণ করে লু স্যুন লিখেছেন: " কিন্তু কেন জানি না মাঝে মাঝে তার কথা আমার স্মরণে আসে, আমি যাদের আমার শিক্ষক বলে গণ্য করি তাদের মধ্যে তার কাছে আমার সবচেয়ে বেশী কৃতজ্ঞতা,তিনিই আমাকে সবচেয়ে বেশী উত্সাহ দিয়েছেন। আমি প্রায়ই ভাবি যে আমার প্রতি তার গ্রগাঢ় আস্থা ও সাহায্য সীমিত অর্থে তা ছিল চীনের প্রতি তার আস্থা ও সমর্থন---কারণ তিনি চাইতেন চীন আধুনিক চিকিত্সা বিজ্ঞানের অধিকারী হোক; কিন্তু ব্যাপক অর্থে তা ছিল বিজ্ঞানের প্রতি অনুরাগ---কারণ তিনি চাইতেন আধুনিক চিকিত্সা বিজ্ঞান চীনদেশে বিস্তারলাভ করুক। অনেকে তার নাম জানে না, কিন্তু আমার চোখে তিনি একজন মহান ব্যক্তি, আমার অন্তরেও সেই ভাবনা"।
অধ্যাপক ফুজিনোর সংশোধন করে দেয়া খাতাগুলো লু স্যুন তিনটি খন্ডে বাঁধাই করে ' অমর স্মৃতিচিহৃ ' হিসেবে বহু বছর নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন।
এই জাপানী অধ্যাপক যুবক লু স্যুনকে এমন গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন যে তিনি সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করার পরও ফুজিনোর ছবি দেখে অনুপ্রাণিত হতেন। ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে লেখা ' অধ্যাপক ফুজিনো' শীর্ষক প্রবন্ধের শেষে তিনি আরো লিখেছেন: " রাতে যদি কখনও ক্লান্ত বোধ করে একটু আরাম পেতে চাই , আর বাতির আলোতে তার শীর্ণদেহ ও কৃষ্ণবর্ণ মুখের দিকে যখন তাকাই তখন মনে হয় তিনি যেন একটানা সুরে কিছু বলতে চাইছেন। তাতে আমার সু-স্বভাব প্রকট হয়ে ওঠে আর আমার সাহস ফিরে আসে। তারপর আমি একটি সিগারেটে আগুন ধরিয়ে লিখতে শুরু করি "।
১৯০৫ সালে , লু স্যুন টোকিও শহরে বেড়াতে গেলেন। যাবার পথে তিনি মিতো নামক স্থানে মাঞ্চুবিরোধী বীর ও সাহিত্যিক চু শুনশুই-এর স্মৃতিস্তম্ভ পরিদর্শন করলেন। এই বীর মিং রাজবংশের পতনের পর সারাজীবন মাঞ্চুবিরোধী সংগ্রাম করে জাপানে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। এই সময়ে জাপানে অধ্যয়নরত ছাত্ররা বিপ্লবের সমর্থনে প্রকাশিত পত্রপত্রিকায় তার স্মরণে বহ প্রবন্ধ প্রকাশিত করছিলেন। এই বীরের রচনাসংগ্রন্থ পুস্তক আকারেও জাপানে প্রকাশিত হয়েছিল। তার প্রতি লু স্যুনের প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ছিল। তাই তার প্রতি সম্মান জানাতে লু স্যুন টোকিও যাওয়ার পথে এক রাত্রের জন্যে সেখানে এলেন। রাত্রিবাসের জন্য তিনি একটি হোটেল খুঁজে বের করলেন। নিময় অনুযায়ী হোটেলের মালিক লু স্যুনকে তার নাম লিখার জন্য একটি খাতা দিলেন। লু স্যুন লিখলেন: ' চৌ শুরেন.. শিনা '। সে যুগে জাপানীরা চীনাবাসীদের ' মাঞ্চুদেশীয়' বলে অভিহিত করতেন। কিন্তু তিনি নিজেকে মাঞ্চদেশীয় বলে পরিচয় দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না। কিন্তু ' চোংকুও' অর্থাত ' মধ্যদেশ' কথাটিও লিখলেন না। তিনি লিখলেন ' শিনা' অর্থাত ' চীনা'। সঙ্গে সঙ্গে এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটল। হোটেলের মালিক ও তার স্ত্রী এই কথাটি দেখে ব্যস্তসমস্ত হয়ে উঠলেন। তারা খুব সম্মানের সঙ্গে লু স্যুনের রাত্রিবাসের জন্য একটি বড় ধরের ব্যবস্থা করলেন। তাদের বারবার অনুরোধ ও সৌজন্যমূলক আচরণ দেখে লু স্যুন তা প্রত্যাখ্যান করতে পালেন না। কিন্তু বিছানায় শুয়ে তার চিন্তা হল হাতে তো বেশী টাকা নেই। কী করে এত বড় ঘরের ভাড়া মেটাবেন। চিন্তায় তার বুক দুরুদুরু করতে থাকল। অবশেষে ভেবে ঠিক করলেন যে পরের দিন সকাল হলে মিত্র স্যু শৌশাংকে একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়ে তার কাছ থেকে টাকা আনাবেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। কিন্তু তার ঘুম গভীর হতে না হতেই হঠাত বাইরে থেকে ' আগুন, আগুন' বলে লোকজনের চীত্কারে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল এবং হোটেল মালিক এসে নিরাপত্তার জন্য তাকে অন্য একটি হোটেলে যাওয়ার কথা বললেন। রাত অরেক গভীর, তিনি শুতে যাবেন এমন সময় আবার ' আগুন লেগেছে, আগুন লেগেছে' বলে চীত্কার শুনতে পেলেন। কিন্তু জানালা দিয়ে দেখলেন বহু দূরের এক জায়গায় আগুণ জ্বলছে। ঘটনাস্থল অনেক দূর দেখে তিনি সস্ততির নিশ্বাস পেলেন। পরের দিন তার কর্তব্য পালন করে তিনি টোকিও অভিমুখে রওয়ানা হলেন।
টোকিও শহরে তখন মাঞ্চুবিরোধী চীনা বিপ্লবীদের ক্রিয়াকলাপ জোরদার হচ্ছে। সুন চোংশান জাপানে উপস্থিত। আগ্যস্ট মাসের ৮ তারিখে তেরশোরও বেশী প্রবাসী চীনা ছাত্র সুন চোংশানকে সম্বর্ধনা জানাবার জন্য একটি সভা করেন। তিনি এই সভায় ' চীনের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের শুরুত্ব' সম্পর্কে একটি ভাষণ দেন। মাঞ্চুবিরোধী বিপ্লব সুষ্ঠূভাবে পরিচারনার জন্য ' কুয়াংফুহুই', ' সিংচোংছই' নামে তত্কালীন বিপ্লবী সংগঠনগুলিকে একজোট করে এই মাসের ২০ তারিকে এক জনসভায় ' খোংমেংহুই' নামে বিপ্লবী সংগঠন প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষিত হল। সুন চোংশান হলেন এই সংগঠনের সভাপতি। এই জনসভায় গৃতীত হল নতুন সংগঠনের গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র।
গ্রীষ্মকালীন ছুটি টোকিও শহরে শেষ করে লু স্যুন সেনদাইতে ফিরে এলেন। প্রথম দিনে কলেজে গিয়ে তিনি দেখলেন যে, বাত্সরিক পরীক্ষার ফল টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং একশো শিক্ষার্থীর আমের তালিকায় তার নাম রয়েছে মাঝামাঝি। অর্থাত ফল খুব খারাপ হয় নি।
কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যাপক ফুজিনো ফলিত শারীর-গঠন বিদ্যা এবং অন্থি-সংস্থান পড়বার দায়িত্ব নিলেন। এক সপ্তাহ ব্যবহারিক শারীর-গঠন বিদ্যা ক্লাসে যোগদান করার পর একদিন মধ্যাপক ফুজিনোলু স্যুনকে ডেকে বললেন: " চীনবাসীরা মৃতব্যক্তির আত্মার প্রতি যে সম্মান দেখায় তা জেনে আমি একটু উদ্বিগ্ন ছিলাম, ভেবেছিলাম তুমি হয়ত মৃতব্যক্তির অঙ্গব্যবচ্ছেদ করতে রাজী হবে না। কিন্তু তুমি তা করেছো দেখে আমি নিশ্চিত হলাম"।
দশ বছরেরও বেশী হয়ে গেল চীন-জাপান যুদ্ধ শেষ হয়েছে। তবু যুদ্ধবাজদের শিক্ষার ফলে সেনদাই-এর এই কলেজে সঙ্কীর্ণ মনোভাবাপন্ন জাপানী ছাত্রদের অভাব ছিল না। তারা চীনবাসীদের হীন দৃষ্টিতে দেখত। তাদের মধ্যে অনেকে আবার প্রবাসী চীনা ছাত্রদের ' মাঞ্চুদের দাস' বলে ডাকত। সুতরাং একজন জাপানী অধ্যাপক লু স্যুনকে পড়াশোনায় সাহায্য করছেন দেখে কয়েকজন জাপানী ছাত্র লু স্যুনকে হেয় জ্ঞান করত এবং একদিন তার সঙ্গে অবমানসূচক আচরণও করল। ঘটনাটি লু স্যুন তার একটি প্রবন্ধে এভাবে লিলেন: " একদিন আমাদের ক্লাসের ছাত্র-সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির প্রতিনিধিরা আমার হোস্টেলে এসে আমার লেকচার টুকবার নোটবুকগুলো ধার নিতে চাইল।আমি সেগুলো খুঁজে এনে তাদের হাতে দিলাম। কিন্তু তারা ওগুলি না নিয়ে শুধু একবার উল্টে-পাল্টে দেখল। তাদের ফিরে যাবার কিছুক্ষণ পরই একজন ডাকপিয়ন একটি ভারী খাম আমাকে দিয়ে গেল। আমি তা খুলে দেখলাম চিঠির প্রথম সারিতে লেখা ' অনুতাপ করো'।
লু স্যুন এই চিঠি পড়ে হতবাক হয়ে গেলেন। লু স্যুন প্রথমে বুঝতে পারলেন না তার উদ্দেশে এই কথা লেখা হয়েছে কেন। কিন্তু চিঠি সম্পূর্ণ পড়বার পর বুঝলেন তাকে কেন অনুতপ্ত হবার কথা বলা হয়েছে। তার দোষ কি? এই বেনামী চিঠিতে তার বিরুদ্ধে দোষারোপ করা হয় যে, আগের বছরে অঙ্গব্যবচ্ছেদ বিষয়ে পরীক্ষার প্রশ্ন সর্ম্পকে অধ্যাপক ফুজিনো তার নোটবুকে আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, এবং যেহেতু লু স্যুন আগেই প্রশ্নগুলো জানতে পারেন সেহেতু পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে। এই চিঠি পড়ে লু স্যুনের মনে পড়ল , কিছুদিন আগে তাদের ক্লাসের এক সভা আহ্বান করে ছাত্র-সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটি ব্ল্যাকর্বোডে যে বিজ্ঞপ্তি লিখেছিল তার শেষের বাক্যটি ছিল: " অনুগ্রহ করে অবশ্যই যোগদান করবে তবে কিছু ফাঁস করবে না।" ফাঁস কথাটির নীচে লাইন দিয়ে চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছিল। লু স্যুন প্রথমে গ্রাহ্য করেন নি ফাঁস কথাটির নীচে লাইন টেনে দিয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই বেনামী চিঠিটি পড়ে বুঝলেন যে ' ফাঁস' কখাটি তার উদ্দেশে প্রয়োগ করা হয়েছে এবং তাতে ছিল অধ্যাপক ফুজিনো কর্তৃক তাকে প্রশ্নপত্র ' ফাঁস' করে দেবার ইঙ্গিত।




