

তখন জাপানের স্কুল-কলেজে একমাত্র জাপানি ভাষার মাধ্যমেই শিক্ষাদানের পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। তাই লু স্যুন প্রথমেই জাপানি ভাষা শিখবার জন্য টোকিওর কোবুন কলেজে ভর্তি হলেন। সে সময় জাপানে অধ্যয়নরত চীনা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় তিন হাজার। শিক্ষার্থীদের মধ্যে কারো কারো মাথায় বড় বেণী ঝুলত বা পাকানো থাকত; আর তার ওপর থাকত ছাত্রদের টুপি। দেখে মনে হত, লু স্যুনের ভাষায়, "ফুজিয়ামা পবর্তের চূড়া"। আবার অনেকে বেণী কেটে মাথায় চুল পাট করে আঁচড়ে রাখতেন। মাঞ্চু জাতি চীনের শাসনভার গ্রহণ করার পর হান জাতিভুক্ত পুরুষদের চুল না-কেটে বেণী রাখতে বাধ্য করত। টোকিও পৌঁছবার কয়েকদিনের মধ্যে লু স্যুন পরাধীনতার গ্লানি বহনকারী মাথার বেণী কেটে ফেললেন। তার সতীর্থদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম এই 'বিপ্লবী' কাজ করেন। মাঞ্চু রাজসরকারের আইন অনুযায়ী হান জাতিভূক্ত লোকেরা তাদের মাথার বেণী কেটে ফেললে তা মহা অপরাধ বলে গণ্য হত। সে যুগে মাঞ্চুবিরোধী বিপ্লবীরা মাঞ্চু সাম্রাজ্য উত্খাত করার সঙ্কল্প গ্রহণ করার সময়ে সর্বাগ্রে যে কাজটি করতেন তা হল নিজেদের বেণী কেটে ফেলা।
টোকিওতে চীনা শিক্ষার্থীদের জন্য একটি হোস্টেল ছিল। লু স্যুন লিখেছেন: "হোস্টেলের সদর দরজার পাশের একটি ঘরে বিক্রী করার জন্য সব সময়েই কিছু-না-কিছু বই থাকত। তাই মাঝে মাঝে ওখানে যাওয়া নিরর্থক হত না। সকালবেলায় এই পাশ্চাত্য ধরণের ঘরের মধ্যে বসে বিশ্রাম করা সম্ভব হত। কিন্তু সন্ধ্যা হলে ঘরের মেঝে কাঁপানো আওয়াজ শোনা যেত। কারণ জিজ্ঞেস করলে উত্তর পেতাম, 'ওরা বলরুম নাচ শিখছে'।"
জাপান এসে অপরিচিত মানুষ ও অপরিচিত জায়গা দেখে লু স্যুন প্রথম নি:সঙ্গ বোধ করতে থাকেন। কিন্তু দেশকে বাঁচাবার ও সংস্কারসাধনের উপায়-সন্ধানী লু স্যুনের উদ্দীপিত মন নতুন জ্ঞান লাভের পিছনে ধাবিত হত। এই সময় তার প্রিয় পাঠ্যবই ছিল থান সিথোং রচিত 'মানবধর্ম'। তা ছাড়া, তিনি পড়তেন দর্শন ও সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে অনূদিত আরও কিছু বই, যা তিনি হাতের কাছে পেতেন। বাস্তব সামাজিক সমস্যাগুলি সম্পর্কেও তার ছিল গভীর আগ্রহ। এরই মধ্যে তার পরিচয় হয় স্বদেশি স্যু শৌশাং-এর সঙ্গে, যিনি টোকিওতে পড়াশোনা করছিলেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাদের মধ্যে নিবিড় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
এই দুই বন্ধু মিলিত হলে তাদের মধ্যে আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু হত দেশোদ্ধারের কথা। স্যু শৌশাং তার 'আমার চেনা লু স্যুন' নামক গ্রন্থে লিখেছেন: "সে প্রথম আমার সঙ্গে দেখা করতে আসতো। আমরা দু'জন একসঙ্গে বসে কথা বলতে বলতে সময়ের কথা ভুলে যেতাম।....একদিন, আলোচনা করছিলাম চীনাদের দু:খজনক ইতিহাস নিয়ে। বিশেষ করে, ভিন্ন জাতির দাসে পরিণত হবার ইতিহাস নিয়ে কথা বলবার সময় আমরা দু:খে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তারপর থেকে আমাদের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে.... আমরা প্রায়ই তিনটি প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করতাম: এক. আদর্শ মানবচরিত্র কী? দুই. চীনের জাতীয় চরিত্রে ত্রুটি কোথায়? এবং, তিন. চীনের মূল সমস্যা কী?"
তবে এই দু'বন্ধুর মধ্যে প্রায়ই 'জাতীয় চরিত্র' নিয়ে গভীর আলোচনা হত। একথা স্বাভাবিক যে, তখন লু স্যুনের পক্ষে শ্রেণী-বিশ্লেষণের দৃষ্টিতে তথাকথিত 'জাতীয় চরিত্র'র মূলগত বৈশিষ্ট্য জানা এবং 'জাতীয় চরিত্র' পরিবর্তনের জন্য যে সামাজিক বিপ্লব ঘটাতে হবে তা জানা সম্ভব ছিল না। অর্থাত কিনা সর্বপ্রথম চাই বিশ্বগ্রাসী ঔপরিবেশিকবাদীদের নিপীড়ন ও দেশে সামন্তান্ত্রিক শাসনের উত্খাত। তবেই চীনা জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো যেতে পারে, তবেই তাদের মানসিকতার পরির্বতন ঘটানো সম্ভব হতে পারে। কিন্তু সহজেই মীমাংসার নয় এমন প্রশ্নটি নিয়ে লু স্যুন পরে অনেক চিন্তা করেন। কারণ, তা শুধু একটি মনোজগতের দার্শনিক প্রশ্ন ছিল না, তার সঙ্গে জড়িত ছিল সমাজ সংস্কারের প্রশ্নও।
কোবুন কলেজে ভর্তি হওয়ার পর কলেজ কর্তৃপক্ষের কনফুসিয়াসের প্রতি ভক্তি দেখে লু স্যুনের মনে যে ভাবনার উদয় হয় তা তিনি ১৯৩৫ সালে লিখিত 'আধুনিক চীনে কনফুসিয়াস' নামে একটি প্রবন্ধে এভাবে ব্যক্ত করেন: "একদিন ডীন ওকুর আমাদের সবাইকে ডেকে আদেশ দিলেন, 'তোমরা সকলেই কনফুসিয়াসের শিষ্য, তাই আজ ওছানোমিজু রাস্তার ওপর কনফুসিয়াসের মন্দিরে গিয়ে তাকে প্রণাম করে এসো।' আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। আমার মনে আছে, আমি তখন ভাবলাম 'কনফুসিয়াস এবং তার শিষ্যদের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি বলেই তো আমি জাপানে এসেছি! এখানেও কি কনফুসিয়াসকে পূজা করতে হবে?' আমি নিশ্চিতরূপে জানি, তখন অনুরূপ প্রতিক্রিয়া অন্য অনেকেরই মনেও হয়েছিল।"
সেই বছরের শেষের দিকে চীনের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব এক নতুন পর্যায়ে গড়ালো। চীনের মাঞ্চু সরকারবিরোধী নেতাদের অনেকে জাপানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। টোকিও শহরে তারা জনসভা করতেন। তাতে দেশপ্রেমিক চীনা শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করতেন। ২৬শে অক্টোবর, বিপ্লবী চাং থাইইয়ান এমন একটি সভার আয়োজন করেছিলেন এবং ঐ সভাতে চীনের বিখ্যাত বিপ্লবী সু চোংশানও যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু এক উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে ঐ সভা অনুষ্ঠান জাপান সরকার শেষ মুহূর্তে নিষিদ্ধ করলে, সভার উদ্যোক্তরা ঐ সভাকে একটি ভোজসভার রূপ দেন। ঐ সভাতে মাঞ্চু সরকারকে উত্খাত করার জন্য আহ্বান জানানো হয়। তারপর, প্রবাসী শিক্ষার্থীরা একের পর এক পত্র-পত্রিকা যেমন 'জাতীয়তাবাদী', 'চিয়াংসু' ইত্যাদি প্রকাশ করে মাঞ্চু সরকারবিরোধী মনোভাব প্রচার করতে শুরু করেন। লু স্যুনও এই বিপ্লবের ঢেউয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে সক্রিয়ভাবে এতে অংশগ্রহণ করেন। জাপানি ভাষা শিক্ষা ছাড়া তিনি সংস্কারপন্থীদের এবং বিপ্লবীদের লিখিত বই ও প্রবন্ধ মনোযোগের সঙ্গে পড়তেন। এসময় তিনি জুডোও শিখতে শুরু করেন।
১৯০৩ সালের মার্চ মাসে কোবুন কলেজের কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের স্বার্থবিরোধী বারো দফা ব্যবস্থা অবলম্বন করলে ছাত্রদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ছাত্রদের সঙ্গে কলেজ কর্তৃপক্ষের আলোচনা ব্যর্থ হলে, ছাত্ররা এক সভার আয়োজন করে এবং কলেজ বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন, কর্তৃপক্ষ ছাত্র-আন্দোলনের ভয়ে ছাত্রদের দাবী মেনে নিলে কলেজের পড়াশুনা আবার শুরু হয়। এই আন্দোলনে লু স্যুন প্রথম থেকে শেষ পযর্ন্ত সক্রিয় ছিলেন। সে বছরের এপ্রিল মাসে কয়েকজন প্রবাসী চীনা শিক্ষার্থী জাপানের সমর্থনে জারের রাশিয়াবিরোধী ১৮০ সদস্যবিশিষ্ট একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করে। এই বাহিনীতে লু স্যুনের কয়েকজন সতীর্থ যোগদান করলেন। কিন্তু লু স্যুন তাতে যোগ দিলেন না। তার বক্তব্য ছিল: চীনে ও রাশিয়ার মধ্যে সমস্যায় প্রকৃতপক্ষে প্রতিফলিত হয়েছে জাপান ও রাশিয়ার দ্বন্দ্ব। এই বাহিনীতে যোগ দিয়ে পরের হাতের পুতুল হওয়া বাঞ্জনীয় নয়। পরে, জাপান ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে লু স্যুনের বক্তব্য যে সঠিক ছিল তা প্রমাণিত হয়।
দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক অগ্রগতির দিকেও লু স্যুন লক্ষ্য রাখতেন। আলোচ্য বছরের জুন মাসে সংঘটিত হয় 'চিয়াংসু সংবাদপত্র ঘটনা'। বিপ্লবী নেতা চাং থাইইয়ান মাঞ্চু সরকারকে আক্রমণ করে ঐ সংবাদপত্রে প্রবন্ধ লিখলে তাকে শাংহাইয়ের লীজ-এলাকার কর্তৃপক্ষ গ্রেপ্তার করে। এর প্রতিবাদে জাপানেও আন্দোলনের ঢেউ ওঠে। লু স্যুন হয়ে উঠেন চাংথাইইয়ানের একজন ভক্ত। তার কথা স্মরণ করে লু স্যুন 'মি: চাংথাইইয়ান সম্পর্কে কটি কথা' প্রবন্ধে লিখেছেন: "আমি চীনের চাং থাইয়ানের কথা জেনেছিলাম তার কনফুসিয়াস সম্পর্কে রচনা বা প্রাচীন ভাষাবিদ্যা সম্বন্ধে জ্ঞানের জন্য নয়। তিনি খাং ইয়ৌওয়েইকে আক্রমণ করেছিলেন, এবং জৌ বৌং-এর 'বিপ্লবী বাহিনী' নামক কবিতার একটি ভূমিকা লিখেছিলেন ও শাংহাইতে লীজ-এলাকার কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন বলেই তাকে জানি। ঐ সময়ে জাপানে অধ্যয়নরত চেচিয়াং প্রদেশের কিছু ছাত্র 'চেচিয়াং-এর ঢেউ' নামে একটি সাময়িক পত্রিকা প্রকাশ করত আর তাতে জেলে লেখা চাং থাইইয়ান-এর কয়েকটি কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাগুলো বুঝতে আমার কোনো অসুবিধা হতো না। কবিতাগুলি আমাকে এমনভাবে আলোড়িত করেছিল যে আমি আজও সেগুলো মনে রেখেছি।"
তখন থেকেই লু স্যুন গোপনে তার নিজের প্রদেশ চেচিয়াং-এ স্থাপিত বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে শুরু করেন। তিনি তখনই এই বলে মত প্রকাশ করেন: "সংস্কারের ব্যর্থতা অবশ্যম্ভাবী, বিপ্লবের সাহসী যোদ্ধা হওয়ার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করো।''
লু স্যুনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু স্যু শৌশাং 'চেচিয়াং-এর ঢেউ' পত্রিকার সম্পাদকমন্ডলীর একজন সদস্য ছিলেন। তিনি একদিন লু স্যুনকে এই পত্রিকার জন্য কিছু লিখতে বললেন। আশ্চর্যের বিষয়, ঠিক তার পরের দিনই লু স্যুন স্যু শৌশাং-এর হাতে একটি লেখা দিলেন। এটি ছিল ঐতিহাসিক উপন্যাস 'স্পার্টাবাসীদের আত্মা'র সংক্ষিপ্ত অনুবাদ। ১৯০৩ সালের জুন মাস থেকে অক্টোবর মাস পযর্ন্ত 'চেচিয়াং-এর ঢেউ' পত্রিকায় এই উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম করে প্রাণদানের জন্য লু স্যুন স্পার্টাবাসীদের প্রশংসা করেন এই রচনায়। সেই বীর গ্রীক রমণীর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'যুবকদের অনুপ্রাণিত করাই আমার এই কাহিনীর উদ্দেশ্য। হায়, পৃথিবীতে কি এমন আর বীর পুরুষ নেই যাদের বীরত্ব মহিলাদের বীরত্বকে ছাড়িয়ে যাবে। যদি থাকে তাহলে তারা কলম ছুঁড়ে ফেলে তলোয়ার তুলে নিয়ে এগিয়ে আসুন। এই কাহিনীর অনুবাদকের কোনো প্রতিভা নেই, বা কাহিনীতে ব্যক্ত বীরত্বের দশ হাজার ভাগের একভাগেরও অধিকারী নয়। হায়, পাঠকগণ! আমি আপনাদের কাছে দোষী, দোষী স্পার্টাবাসীদের আত্মার কাছে।'' এখানে লু স্যুনের মাঞ্চুবিরোধী এবং সাম্রাজবাদবিরোধী দেশাত্ববোধক মনোভাব পুরোপুরি প্রকাশ পেয়েছে। লু স্যুন গ্রীক বীরদের আদর্শ অনুসরণ করে পররাজ্য আক্রমণকারী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য চীনা যুবক-যুবতীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।




