Web bengali.cri.cn   
ভারতে নারীদের জন্য প্রথম বিশেষ ব্যাংক
  2014-01-07 18:54:49  cri



ভারতে সম্পূর্ণ নারীদের দ্বারা পরিচালিত একটি রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়েছে। এটির নাম দেওয়া হয়েছে 'ভারতীয় মহিলা ব্যাংক'। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জন্মদিনে গত ১৯ নভেম্বর মঙ্গলবার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ব্যাংকটির মুম্বাই শাখার উদ্বোধন করেন। ভারতে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি যৌন অপরাধ সংঘটিত হবার প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং নারীদের আর্থিক নিরাপত্তা জোরদার এবং তাদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে তাদের জন্য দেশের প্রথম রাষ্ট্রীয়-মালিকানাধীন ব্যাংকের উদ্বোধন করেন। দিল্লিতে গণধর্ষণের শিকার এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পুরো ভারত জুড়ে যখন তোলপার চলছিল, সেই ফেব্রূয়ারি মাসে এই ব্যাংকের ঘোষণা দেয়া হয়। এই ব্যাংক নারীদেরকে ঋনদান এবং প্রধানত নারীদেরকে নিয়োগের ব্যাপারে মনোনিবেশ করবে, তবে পুরুষরাও এই ব্যাংকে হিসাব খুলতে পারবে।

মহিলা ব্যাংক প্রয়োজন কেন? একটি উদাহরণ দিচ্ছি। কুমার দেবী ভারতের নয়াদিল্লীর একজন পরিচ্ছন্নতা-কর্মী। তিনি একটি তিন তলা বিল্ডিং-এর ময়লা পরিস্কার করেন। তার মাসিক আয় প্রায় ৬ হাজার রুপি। তিনি প্রতিমাসে সঞ্চয় করেন প্রায় ২ হাজার রুপি। সমস্যা হচ্ছে কষ্ট করে জমানো এই টাকা তিনি কোথায় রাখবেন? তিনি ব্যাংকে একটি হিসাব খোলার চেষ্টা করেছেন অনেকবার। কিন্তু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে পারেননি বলে, হিসাব আর খোলা হয়নি তার। এদিকে তার ভয়, কষ্টে অর্জিত টাকাগুলো ঘরে রাখলে তার স্বামী খরচ করে ফেলবে। খরচ তার স্বামী করেও বটে। এখন তিনি ভাবছেন, নিজের টাকা নিজে কেনাকাটা করে খরচ করে ফেলবেন। অথচ ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট থাকলে তিনি সেখানে টাকাগুলো জমা রাখতে পারতেন। আসলে ভারতে দেবীর মতো অসংখ্য নারী আছে। মহিলা ব্যাংক এ ক্ষেত্রে তাদের সাহায্য করতে পারে। এ ব্যাংকে পুরুষরাও হিসাব খুলতে পারবে, তবে তারা ঋণ পাবে না।

ভারতের সমাজও পুরুষশাসিত। এখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষ পুরোপুরিভাবে পরিবারের আর্থিক উত্স নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। প্রায় চার ভাগের তিন ভাগ ভারতীয় নারীর নিজের ব্যাংক হিসাব নেই। তা ছাড়া, ব্যাংকের ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রেও নারীদের সুযোগ পুরুষের চেয়ে অনেক অনেক কম। তাই ভারতীয় নারীদের জন্য বিশেষ আর্থিক সেবার সুযোগ থাকা সত্যি অনেক অনেক প্রয়োজনীয়।

তাই ব্যাংকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছেন, "'যুগের পর যুগ ধরে বিজ্ঞান, খেলাধুলা, ব্যবসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে হাতেগোনা কয়েকজন নারী উল্লেখযোগ্য অবস্থান গড়ে নিতে পেরেছেন। তবে এটা অধিকাংশ নারীর অবস্থা থেকে ভিন্ন। আজো নারীরা তাদের অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। নারীদের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন হয়নি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। আর আমাদের দেশের নারীদের এই দিকগুলোতে স্বাবলম্বী করে তোলার জন্যই আমাদের এই উদ্যোগ।' দু:খজনক হলেও সত্য যে ভারতীয় নারীরা বাড়িতে, স্কুলে, কর্মক্ষেত্রে এবং জনসমাগম স্থলেও বৈষম্য ও কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হচ্ছে। তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এখনো স্বপ্নই রয়ে গেছে"। "ভারতীয় মহিলা ব্যাংক স্থাপন নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে একটি ক্ষুদ্র পদক্ষেপ"।

ব্যাংকের সভাপতি উষা আনান্থ সুব্রামানিয়ান জানান, ব্যাংকটি নারীকর্মীদের দ্বারা পরিচালিত হবে এবং মূলত নারীদের আমানত গ্রহণ করবে ও নারীদের ঋণ দেবে। সরকার ২০১৭ সালের মধ্যে ভারতজুড়ে ব্যাংকটির ৫০০ শাখা খোলার পরিকল্পনা করেছে। যেসব স্থানে ব্যাংক একাউন্ট খুলতে গেলে নারীদের বেশি সমস্যায় পড়তে হয়, সেসব স্থানে ব্যাংকের শাখা খোলা হবে।

এ পরিকল্পনা অনেক বিশাল। ভারতীয় সরকার নারীদের আর্থসামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করতে এ উদ্যোগ নেওয়ায় আমরা সন্তোষ প্রকাশ করছি। আমরা খুব খুশি যে সরকার সত্যি নারীদের মর্যাদা উন্নয়নে গুরুত্ব দেয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে: এত বিশাল পরিকল্পনা কি সত্যিই বাস্তবায়ন করা যাবে? মনে রাখতে হবে, গোটা বিশ্বে কোনো ব্যাংক, বিশেষ করে নারীদের জন্য খোলা কোনো ব্যাংক নিয়ে এমন বিশাল পরিকল্পনা এর আগে গ্রহণ করা হয়নি। এর আগে বিশ্বে শুধু দুটি দেশ বিশেষ করে নারীদের জন্য ব্যাংক খুলেছে। একটি হল পাকিস্তান, আরেকটি দেশ হল তাঞ্জানিয়া। এই দুটি দেশের মহিলা ব্যাংক আবার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি।

১৯৮৯ সালে পাকিস্তান বিশ্বের প্রথম মহিলা ব্যাংক খুলেছিল। এর প্রধান লক্ষ্য ছিল নারী শিল্পপতিদের ঋণের চাহিদা মেটানো। এ ব্যাংক শুধু সেসব কোম্পানিকে ঋণ দেয়, যেসব কোম্পানির ৫০ শতাংশেরও বেশি শেয়ারের মালিক নারীরা অথবা যে কোম্পানিতে নারী কর্মীর সংখ্যা ৪০ শতাংশেরও বেশি, অথবা যে কোম্পানির সিইও একজন নারী। পাকিস্তানের ২৪টি প্রধান প্রধান অঞ্চলে ৪১টি শাখা আছে এ ব্যাংকের। করাচিতেই এ ব্যাংকের সবচে বেশি শাখা অবস্থিত। নারী অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের সংখ্যা ৬০ হাজারেরও বেশি। তবে ব্যাংকটি চালু হবার পর এর কুঋণ ক্রমাগতভাবে বাড়তে শুরু করেছিল। শুধু ২০১৩ সালের প্রথম নয় মাসে ব্যাংকটি লোকসান দাঁড়ায় ১৫.৮ কোটি রুপি। সরকার বাধ্য হয়ে এ ব্যাংককে ১৬.৬ কোটি রুপি ভর্তুকি দিয়েছে।

দ্বিতীয় উদারহণ হল তাঞ্জানিয়া। তাঞ্জানিয়ার মহিলা ব্যাংক ২০০৯ সালে খোলা হয়। এ ব্যাংকে সরকারের শেয়ার ছিল ৯৭ শতাংশ। এ ব্যাংক প্রধানত নিম্ন আয়ের মানুষ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও মাঝারি আকারের শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সেবা দিয়ে থাকে। এ ব্যাংকটি অবস্থাও একই রকম। অর্থাত এর কুঋণের পরিমাণ বেশি।

তাই বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারতের মহিলা ব্যাংকের সাফল্য সহজে আসবে না। যদি কুঋণ নিয়ন্ত্রণ করা না যায় এবং বিশাল গ্রামীণ বাজার উন্নয়ন করা না যায়, তাহলে ব্যাংকের আকার বড় করা মুশকিল। লোকসানের ঝুঁকিও থাকবে।

ব্যাংকের উন্নয়ন চাইলে এ ধরনের আশঙ্কার কথা মাথায় রেখেই সামনে এগুতে হবে। পুরোপুরিভাবে ভবিষ্যতের ঝুঁকি বিবেচনা করলেই কেবল উন্নয়নের সঠিক পথ খুঁজে পাওয়া যাবে। আমরা বিশ্বাস করি, এ ব্যাংক নিশ্চয়ই নারী, এবং বিশেষ করে গ্রামের নারীদের মর্যাদা উন্নয়ন এবং শিক্ষিত হওয়ার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখবে। আমরা আরও আশা করি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, নিশ্চয়ই যে দেশে নারীদের সামাজিক মর্যাদা ততটা ভালো না, এমন দেশ ভালো এবং মন্দ সব অভিজ্ঞতা শিখে এ ক্ষেত্রে কিছু কাজ করতে পারবে।

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক