Web bengali.cri.cn   
চীনের আধুনিক কালের মহান সাহিত্যিক ও চিন্তানায়ক লু স্যুনের ওপর ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্ব
  2013-12-31 20:01:04  cri
লু স্যুনের মামার বাড়ি ছিল শাওসিং-এর নিকটবর্তী আনছিয়াও নামে একটি গ্রামে। সেই গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতো একটি ছোট খাল। গ্রামবাসীদের অধিকাংশের পদবী ছিল লু; তারা প্রায় সকলেই ছিল একে অপরের আত্মীয়। কৃষিই ছিল তাঁদের প্রধান পেশা। কয়েক ঘর চাষী ও জেলেও বাস করত সেই গ্রামে। তত্কালীন চীনের গ্রাম্য আচার অনুযায়ী, বিবাহিত মেয়েরা যারা শ্বশুরালয়ের সাংসারিক কাজের দায়িত্ব পায়নি, তারা প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে একবার পিত্রালয়ে গিয়ে কিছুদিন বাস করতে পারত। কিন্তু লু স্যুনের পরিবারের নিয়ম এর ব্যতিক্রম ছিল। চৌ পরিবারের রীতি অনুযায়ী, সাংসারিক কাজ লু স্যুনের ঠাকুরমার করার কথা। কিন্তু তিনি শক্তপোক্ত থাকা সত্ত্বেও, কিছু গৃহস্থালীর কাজ লু স্যুনের মার ওপর ন্যস্ত করেছিলেন। কাজেই, তিনি বাপের বাড়ি যাবার সুযোগ পেতেন খুব কমই। কিন্তু যখনই তার বাপের বাড়ি যাওয়ার সুযোগ হতো, তখন সবচেয়ে বেশি খুশী হতেন লু স্যুন।

মামাবাড়ি এলে পড়াশুনার কোন বালাই থাকত না। সারাদিন চাষী ও জেলে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে খেলাধুলা করে তিনি সময় কাটাতেন। গ্রামে এসে লু স্যুন নিজের মতো করে সমবয়স্কদের সঙ্গে মিশতে পেরে খুশি হতেন। চাষী ও জেলে পরিবারের ছেলেরাই হয়ে উঠতো তার অন্তরঙ্গ বন্ধু। প্রতিদিন নতুন সাথীদের সঙ্গে কেঁচো যোগাড় করে তা বড়শিতে লাগিয়ে চিংড়ি ধরার জন্য নদীর তীরে শুয়ে সময় কাটাতেন। কখনোবা তাদের সঙ্গে যেতেন ক্ষেতে মোষ চড়াতে। তবে গ্রামে এলে তাঁকে যা সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করত তা হল- গ্রাম্য অপেরা।

১৮৮০ সালে লু স্যুনের পরিবারে এক বড় ধরনের দুর্যোগ নেমে এল। এ দুর্যোগ লু স্যুনের জীবনকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। সে বছর শরত্কালে লু স্যুনের দাদা চৌ চিয়েফু রাজকীয় পরীক্ষা পরিচালনার সময় অসদুপায় অবলম্বনের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন এবং কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, তিনি ঘুষ গ্রহণ করে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দিয়েছেন। তিনি যাতে এই অভিযোগ থেকে নিস্কৃতি পান তার জন্য ঘটনার তদন্তকারী সরকারি বিভাগ একটি রিপোর্ট তৈরি করে এই অভিমত প্রকাশ করে যে, তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ এবং একারণেই তিনি এই কাজ করেছেন। কিন্তু চৌ চিয়েফু ছিলেন একজন জেদী লোক। তিনি মানসিক রোগের কথা অস্বীকার করেন। ফলে তার অপরাধ আরও গুরুতর বলে গণ্য হল এবং তাকে হাংচৌ শহরের জেলে আটকে রাখা হল। তখনকার রাজতন্ত্রের নিষ্ঠুর শাসনাধীনে কোন এক ব্যক্তি অপরাধ করলে শুধু তাকেই শাস্তি পেতে হত না; তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও রাজরোষের শিকার হতে হত। তাই, চৌ পরিবারের ভয় হল গৃহকর্তার অপরাধে শিশুদেরও অত্যাচার ভোগ করতে হতে পারে। সুতরাং, সাময়িকভাবে লু স্যুন ও তার ছোট দুই ভাইকে শাওসিং থেকে দশ মাইল দূরে হুয়াংফুচুয়াং গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হল। সেখানে বাস করতেন লু স্যুনের বড় মামা। কিন্তু দাদার সরকারি পদ থেকে অপসারণ এবং জেলের খরচ ও অন্যান্য সরকারি কর্মচারীদের ঘুষের অর্থ জোগাতে চৌ পরিবারকে প্রায় সমস্ত জমি বিক্রি করতে হয়। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে লু স্যুনের দাদার মা ৮০ বছর বয়সে মারা যান।

হুয়াংফুচুয়াং ছিল একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। প্রায় পাঁচ শত পরিবার সেখানে বাস করত। প্রামটিকে ঘিরে প্রবাহিত হতো একটি নদী। এই নদীর জল আবার কয়েকটি শাখায় বিভক্ত হয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে গিয়েছিল গ্রামের মধ্য দিয়ে। গ্রামের পুবদিকে কয়েক মাইল জুড়ে ছিল একটি বিশাল জলাশয়। কথিত আছে, থাইফিং বিদ্রোহীরা এই জলাশয়ে নৌযুদ্ধের মহড়া দিত। নিংপোর দিক থেকে আসা সাম্রাজ্যবাদী বাহিনীর সঙ্গে এই স্থানেই বিদ্রোহীদের সশস্ত্র সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছিল। স্থানাভাবের কারণে লু স্যুনের মামা ও তার পরিবারের অন্য সদস্যরা হুয়াফুচুয়াং-এর নিকটবর্তী সিয়াওকাও গ্রামের একটি বাড়িতে বসবাস করতে এলেন। তখন লু স্যুনও তাদের সঙ্গে সে গ্রামে এলেন। গ্রামে বাস করে তিনি গ্রাম্যজীবনের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হন এবং জানতে পারেন চাষীদের জীবনযাপন, আচার-ব্যবহার আর তাদের দু:খ-দুর্দাশার কথা।

মামার পরিবারে আশ্রয় নেবার সময় লু স্যুন আদরের অভাব বোধ করেন। কিন্তু কিশোর লু স্যুন তা গ্রাহ্য না-করে, গ্রামের কৃষক পরিবারের ছেলেদের সঙ্গে আনন্দে দিন কাটাতে থাকেন। এই সব সমবয়স্ক ছেলে লু স্যুনকে একজন অতিথি হিসেবে গ্রহণ করেছিল। লু স্যুনের প্রতি তাদের আন্তরিকতার অভাব ছিল না। কৃষকরা ক্ষেতে কাজ করতে গেলে ছেলেরা আসত লু স্যুনকে সঙ্গ দিতে ও তাকে নিয়ে নদীর ধারে খেলা করতো বা নদী থেকে চিংড়ি ধরতো।

প্রায় ছ'মাস হুয়াংফুচুয়াং এবং সিয়াওকাওতে বাস করার পর লু স্যুন তার দু'ভাইকে সঙ্গে নিয়ে শাওসিং-এ নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন। সরকারি আমলাদের অত্যাচারের ভয় তখন অনেকটা প্রশমিত হয়েছে। তবে লু স্যুন গ্রাম থেকে খালি হাতে ফিরে এলেন না। নতুন অভিজ্ঞতা ছাড়া, তিনি তার মামার শ্বশুরের পাঠাগারে বিখ্যাত উপন্যাস 'হোংলোমং' অথার্ত 'লাল মহাপুরীর স্বপ্ন' এবং চীনের ধ্রুপদী সাহিত্য পড়বার সুযোগ পান, যা তখনকার দিনের লু স্যুনের সমবয়স্করা খুব কমই পেত। তা ছাড়া, তার সববয়স্করা এ সব গ্রন্থ পড়তে লু স্যুনের মত আগ্রহীও ছিল না।

নিজের বাড়িতে ফিরে এসে লু স্যুন আগের মত পাঠশালায় পড়তে যেতে শুরু করেন। কিন্তু কিছুকাল পরই তার পরিবারে আরেকটি দুর্যোগ দেখা দিল। তার বাবা মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হলেন। দাদা জেলে যাওয়ার পর পরিবারের খরচ যোগাড় করতে চৌ পরিবার প্রায় দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। চিন্তায় তার বাবার স্বাস্থ্য খারাপ হতে থাকে। তখন তিনি অতিরিক্ত মদ পান করতেও শুরু করেছিলেন। তিনি ছিলেন চীনের পাশ্চাত্যকরণের সমর্থক। দেশকে অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী করে তোলার পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। ১৮৯৮ সালের চীন-জাপান যুদ্ধে চীনের পরাজয়ের খবর পেয়ে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হন। তিনি পরিবারের অন্য সবাইকে বলেন: "ভবিষ্যতে ছেলেরা বড় হলে তাদের জাপান অথবা ইউরোপে পাঠাতে হবে, যাতে সেখান থেকে তারা দেশকে শক্তিশালী করে তোলার জন্য জ্ঞান অর্জন করে দেশে ফিরে আসতে পারে।" এই ঘটনার কিছুদিন পরেই লু স্যুনের বাবা অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হন।

চৌ পোয়ির অসুখ ও চিকিত্সা চৌ পরিবারকে কষ্টের ওপর কষ্টে ফেলল। পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে লু স্যুনকে তখন কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। এই দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে লু স্যুন যে তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন, পরবর্তী কালে তা তিনি 'বাবার অসুখ' শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন।

সুপ্রিয় শ্রোতা, এতক্ষণ শুনলেন চীনের আধুনিক কালের মহান সাহিত্যিক ও চিন্তানায়ক লু স্যুনের ওপর ধারাবাহিক প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্ব। আমাদের এই অনুষ্ঠান সম্পর্কে কোনো মতামত বা পরামর্শ থাকলে চিঠি লিখে জানাবেন। আমাদের ইমেলের ঠিকানা হল: ben@cri.com.cn

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক