Web bengali.cri.cn   
চীনের আধুনিক কালের মহান সাহিত্যিক ও চিন্তানায়ক লু স্যুনের জীবনী সম্পর্কে একাধিক পর্ব।
  2013-12-18 16:40:40  cri
লু স্যুন শুধু একজন মহান সাহিত্যিকই ছিলেন না, এক মহান চিন্তানায়ক ও বিপ্লবী, দেশপ্রেমিক ও আন্তর্জাতিকতাবাদীও ছিলেন। চীনা জনগণের বিপ্লবের অগ্রগতির সঙ্গে তাঁর সাহিত্যিক ও মতাদর্শগত অগ্রগতিও নিবিড়ভাবে জড়িত ছিল। বিংশ শতাব্দীর বিশ্বসাহিত্যের একজন বাস্তববাদী কান্ডারীরূপে তিনি তাঁর রচনায় সমকালীন রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থা ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি তাঁর সাহিত্যে চীনা জনগণের আদর্শ, আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং গুণাবলীর সঙ্গে তাঁর গভীর বিপ্লবী আদর্শ এবং আপোসহীন সংগ্রামী মনোভাবের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। চীনা জনগণের প্রগতি, বিপ্লব এবং চূড়ান্ত মুক্তির দাবির সঙ্গে গভীরভাবে এক হয়ে যাওয়ায় লু স্যুনের চিন্তাধারা অন্তর্ভেদী ও সংগ্রামশীল হয়ে ওঠে। তাই তাঁর সাহিত্য অমর। অন্য কথায়: তার পথ চীনা জাতির নতুন সংস্কৃতির পথ।

শাওসিং চীনের চেচিয়ান প্রদেশের একটি প্রাচীন শহর, এক সময় ইয়ুয়ে রাজ্যের রাজধানী। পূর্ব-চেচিয়াং-এর 'দুর্ভ্যেদ্য নগর' নামে অভিহিত হত এই শাওসি। আধুনিক ইতিহাসেও সাম্রাজবাদী শক্তি চীনকে পদানত করার অপপ্রয়াসে যে প্রথম আক্রমণ চালিয়েছিল তারও লক্ষ্যস্থল ছিল শাওসিং অঞ্চল। সেখানকার সাহসী জনতা সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। তাদের বীরত্ব কাহিনী আজও গোটা চীন দেশে আলোচিত একটি বিষয়।

এই শহরের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত তুছাংফাংখৌতে বাস করতেন চৌ পদবীধারী একটি পরিবার। এই পরিবারেই ১৮৮১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের পঁচিশ তারিখ মধ্যরাতে লু স্যুন জন্মগ্রহণ করেন। লু স্যুনের বাবা চৌ পোয়ি ছিলেন একজন শিক্ষিত ব্যক্তি। তিনি জেলাস্তরের রাজকীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও, কোন সরকারি পদ গ্রহণ করেননি। লু স্যুনের মা ছিলেন গ্রামের মেয়ে। তিনি নিজের চেষ্টায় চীনা অক্ষর-জ্ঞান লাভ করে বই পড়ার এবং চিঠিপত্র লেখার যোগ্যতা অর্জন করেন। লু স্যুনের দাদা তত্কালীন রাজকীয় একাডেমি থেকে স্নাতক হবার পর সরকারি কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ পান। তার দাদী ছিলেন একজন সহৃদয়া মহিলা। তিনি গল্প-কাহিনী বলায় খুব পটু ছিলেন।

লু স্যুন যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন চৌ পরিবারের আর্থিক অবস্থা বেশ স্বচ্ছল ছিল। চৌ পরিবারের অধীনে ছিল ১৫ বিঘা ধানের জমি। তাই লু স্যুনের বাবা চৌ পোয়ি সরকারি পদ না-নিলেও, সংসারের ব্যয় মিটে যেত ভালোভাবেই।

লু স্যুন---এই নাম শুনলে হয়তো মনে হবে যে এই ব্যক্তির জন্ম চীন দেশের লু পদবীধারী এক পরিবারে, আর তাঁর নাম স্যুন। কিন্তু তার আসল নাম হল চৌ শুরেন। কী করে লু স্যুন নামের উত্পত্তি হয় সে প্রসঙ্গে তিনি তার 'আত্মজীবনী'তে এভাবে লিখেছেন: 'বিদেশে অধ্যয়ন করার সময় আমি কয়েকটি নিকৃষ্ট ধরণের প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলাম। তখনই 'লু স্যুন' এই কলমী-নাম ব্যবহার করি।' তার জীবনে লু স্যুন প্রায় ৭০টি কলমী নাম ব্যবহার করেছেন। এই সব নাম ছাড়া লু স্যুনের একটি বৌদ্ধ নামও ছিল। 'আমার প্রথম গুরু' শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন: "চৌ পরিবারে আমি ছিলাম প্রথম পুত্রসন্তান। যেহেতু 'দুলর্ভ জিনিস মাত্রই মহার্ঘ', সেহেতু বাবার ভয় হল আমি হয়ে উঠব একজন অসাধারণ ব্যক্তি নয়তো অল্প বয়সেই আমার মৃত্যু হবে। সুতরাং আমার বয়স এক বছর পূর্ণ হতে-না-হতেই আমাকে ছাংছিং মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হল এবং একজন ভিক্ষুকে আমার গুরু হিসেবে গ্রহণ করা হল। এইভাবেই আমি পেলাম আমার বৌদ্ধ নাম 'ছাংকাং' যা আমি পরে কখনও কখনও আমার কলমী নাম হিসেবে ব্যবহার করেছি।"

শিশু লু স্যুনের মনে যিনি সবচেয়ে বেশি দাগ কাটেন বা প্রভাব বিস্তার করেন তিনি ছিলেন লু স্যুনের ধাইমা 'আছাং'। 'আছাং' ছিলেন একজন গ্রাম্য মহিলা। অল্প বয়সে বিধবা হয়ে এবং জমিজমা হারিয়ে তিনি শহরে এসেছিলেন জীবিকার সন্ধানে। তার আসল নাম কী ছিল তা জানা যায় না। তবে লু স্যুনের নানী তাকে 'আছাং' বলে ডাকতেন। তাই অন্যরাও তাকে এ নামেই ডাকত। আর শিশুরা তাকে ডাকত 'ছাং-মা'। অনেক দুর্বোধ্য যুক্তি ও আদব-কায়দা সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল অসীম। তিনি সেসব শিশু স্যুনকে শেখাতেন। শিশু স্যুনকে তিনি শেখাতেন: কোনো মানুষের মৃত্যুর কথা বলতে গেলে বলা উচিত নয় যে 'সে মরে গেছে', বরং বলতে হয় তার 'তিরোধান' হয়েছে; যে ঘরে মানুষের মৃতদেহ রাখা হয় সেই ঘরে শিশুদের যাওয়া উচিত নয়; ভাত মাটিতে পড়ে গেলে তা তুলে নিতে হয় এবং সবচেয়ে ভাল হয় তা খেয়ে ফেললে; যে বাঁশের কঞ্চিতে পায়জামা শুকোতে দেওয়া হয় তার তলা দিয়ে কখনও যাতায়াত করা উচিত নয়, ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনি সাধারণত শিশুদের নিজেদের ইচ্ছামতো ছুটাছুটি করতে দিতেন না। তারা মাটি থেকে একটি ঘাস তুললে বা একখণ্ড পাথর সরালে তিনি তাদের 'দুষ্টুছেলে' বলে বকা দিতেন এবং মায়ের কাছে নালিশ করবার ভয় দেখাতেন। শুরুতে, শিশু লু স্যুন আছাংয়ের প্রতি বিশেষ প্রসন্ন ছিলেন না। বিশেষ করে তিনি লু স্যুনের একটি প্রিয় ইঁদুরকে পায়ের তলায় পিষে মেরে ফেললে তিনি আছাংয়ের প্রতি আরও রুষ্ট হন। কিন্তু শিশু লু স্যুনের এই বিরূপ মনোভাব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। একদিন এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটল, যার ফলে তিনি আছাংকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করলেন। আছাং প্রায়ই তাকে 'লম্বা চুলওয়ালা' থাইফিং বিদ্রোহীদের লোমহর্যক কাহিনী শোনাতেন। তিনি একদিন শিশু লু স্যুনকে 'পাহাড়-সাগরের পুঁথি' নামক একটি বই এনে দিলেন। বইটি পেয়ে লু স্যুন অনেক খুশি হলেন। তিনি ভাবলেন একটি অসাধ্য কাজ আছাং সম্পন্ন করেছেন। তার দৃষ্টিতে আছাং হিরো হয়ে গেলেন। কিশোর বয়সে লু স্যুন অনেক বই পড়েছিলেন। কিন্তু এই বইটি তাকে সবচে বেশি আকৃষ্ট করেছিল। এক প্রবন্ধে তিনি ধাইমা আছাংয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেছেন এর জন্য।

লু স্যুন ছিলেন নানীর সবচেয়ে আদুরে নাতি। গ্রীষ্মকালে গরম থেকে বাঁচতে লু স্যুন যখন গাছের নীচে এসে বসতেন, তখন নানী তাঁর পাশে বসে তালপাখা দিয়ে হাওয়া করতেন এবং তাকে গল্প শোনাতেন। নানীর ঝুলিতে ছিল অফুরন্ত লোককাহিনী। কৈশোরে নানীর মুখে শোনা এসব কাহিনী পরবর্তী কালে লু স্যুনকে সাহিত্য রচনায় অনেক সাহায্য করেছে। একবার নানী তাঁকে এক বেড়ালের কাহিনী শুনিয়েছিলেন। বেড়াল ছিল বাঘের গুরুমশাই। বাঘ আগে কিছুই করতে জানত না বলে সে বেড়ালের শিষ্যত্ব গ্রহণ করল। বেড়াল বাঘকে শেখাল ইঁদুর ধরতে কেমন করে লাফ দিতে হয় এবং অন্য জন্তু শিকার করতে হয়। এই সব কৌশল শিখার পর বাঘ ভাবল: সব কৌশলইতো শিখেছি, এখন আমার সমকক্ষ আর কেহ নেই, একমাত্র গুরুমশাই আমার চেয়ে শক্তিশালী। যদি তাকে খেয়ে ফেলতে পারি তাহলে আমার চেয়ে শক্তিশালী আর কেউ থাকবে না এই পৃথিবীতে। একথা ভেবে সে বেড়ালের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বাঘের মনোভাব বেড়াল আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিল। কাজেই বাঘ তাকে ধরে ফেলার আগেই সে লাফ দিয়ে গাছের ওপর গিয়ে বসল। বাঘ গাছের নীচে দাঁড়িয়ে তর্জন-গর্জন করতে লাগল। কারণ বেড়াল সব বিদ্যাই তাকে শিখিয়েছিল, শুধু শেখায়নি গাছে চড়ার বিদ্যা।

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক