Web bengali.cri.cn   
'হাস্যকর নোবেল' পুরস্কার
  2013-09-23 15:29:36  cri



আমরা সবাই নোবেল পুরস্কার সম্পর্কে জানি এবং এটা বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারের অন্যতম। প্রতি বছর নোবেল পুরস্কার ঘোষণার সময় সারা বিশ্ব এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে যে, কে সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি এবারের নোবেল বিজয়ী হবে! কিন্তু যদি আপনাকে বলি, বিশ্বে আরও একটি নোবেল পুরস্কার আছে, যে পুরস্কারটি গবেষণা কর্মের ওপরেই প্রদান করা হয়? আপনি কি বিশ্বাস করবেন? হ্যাঁ, আপনাকে বিশ্বাস করতেই হবে, বিজ্ঞানের জগতে অতি হাস্যকর সব বিষয় নিয়ে গবেষণার জন্য পুরস্কার স্বরূপ প্রদান করা হয়ে এই নোবেল। আর তাই এই পুরস্কারটি 'হাস্যকর নোবেল' নামেই খ্যাতি লাভ করেছে। আপনি আরো আশ্চর্য হবেন যে, এই পুরস্কারটি সত্যিকার নোবেল পুরস্কারের দু এক সপ্তাহ আগে এবং সত্যিকার নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্বরাই এই পদক প্রদান অনুষ্ঠানের বিচারক এমনকি আয়োজক পর্যায়েও যুক্ত থাকেন।

প্রথমেই জেনে নিন, এ হাস্যকর নোবেল পুরস্কারের নাম কি আর এর অর্থই বা কি? এ পুরস্কারটির পুরো নাম হল the ignoble prizes"। ডিকশনারীতে "ignoble" এর যতগুলি প্রতিশব্দ পাওয়া যায়, তার সবগুলোরই অর্থ দাঁড়াচ্ছে এরকম যে, 'লজ্জাজনক' অসন্মান জনক' 'অনৈতিক' 'হাস্যকর' এ জাতীয় শব্দ। কিন্তু "ignoble" নামটি "nobel prize" থেকেই জন্ম হয়েছে। বলা হয়ে থাকে যে, এ পুরস্কারটি মূলত সত্যি নোবেল পুরস্কারের একটি মজার অনুকরণ। বিজ্ঞানের জগতের উদ্ভুদ আর হাস্যকর সব গবেষণাকর্ম নিয়ে প্রকাশিত একটি ম্যাগাজিন এই পুরস্কারের আয়োজক। এ পুরস্কারের বিচারকের মধ্যে অনেক নোবেল পুরস্কার বিজয়ীরাও আছেন। হাস্যকর নোবেল পুরস্কারের প্রধান লক্ষ্যই হল: যে সকল গবেষণা আপাতভাবে দেখলে অত্যন্ত হাস্যকর মনে হবে, কিন্তু এর গভীরে রয়েছে বিশেষ তাত্পর্য আর সুদূরপ্রসারী প্রভাব, এমন সব গবেষণা কর্মকে পুরস্কৃত করা। প্রতি বছরের অক্টোবর মাসে অর্থাত্ আসল নোবেল পুরস্কার প্রদানের দু'এক সপ্তাহের আগে এ নকল নোবেল পুরস্কারের আয়োজন করা হয়। ১৯৯১ সালে প্রথম এই পুরস্কার প্রদানের প্রচলন শুরু হয়। হাস্যকর নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনিত এবং নির্বাচিত বৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলো নিঃসন্দেহে অসাধারণ এবং হাস্যকর হতেই হবে, তাই না? আর নিশ্চয়ই এই সকল হাস্যকর গবেষণা বিজ্ঞান, চিকিত্সা ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রের মানুষদের মধ্যে প্রভূত আগ্রহ উদ্দীপনা তৈরী করে থাকে। কিন্তু আসল নোবেলের সাথে এই নকল নোবেল পুরস্কারের বেশকিছু হাস্যকর পার্থক্য রয়েছে, বিজয়ী বীর এ পুরস্কারের জন্য কোনো অর্থমূল্য পাবে না, এমন কি নেই কোনো হইচই করা শুভেচ্ছা আর প্রশংসার পুষ্পবর্ষণ। কেবল নকল বিজয়ী বীর তাঁর গবেষণা পত্রটিকে আয়োজক ম্যাগজিন কোম্পানির পত্রিকায় বিনা খরচে ছাপাতে পারবে।

এ পুরস্কার প্রদানের অনুষ্ঠানটিও কিন্তু বেশ হাস্যকর রকমের মজার। ঐতিহ্য অনুযায়ী, পুরস্কার প্রদানের সময় দর্শকরা মঞ্চে কাগজের তৈরী প্লেন ছুঁড়ে থাকে। ভেবে দেখুন, দর্শক সারিতে থাকা হাজারো দর্শক যদি এক সাথে কাগুজে বিমান ছুঁড়তে থাকে কেমন মজার দৃশটাই না হবে, তাই না? এখানে একজন ব্যক্তির নাম উল্লেখ না করলেই নয়, যিনি 'নকল নোবেলের শুরুর দিক থেকে প্রায় ১২ বছর যাবত খুব খুব মহান একটি কাজ করে যাচ্ছেন, তিনিই প্রতি বছর নকল নোবেল পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান শেষে মঞ্চ এবং পুরো থিয়েটারঅঙ্গন জুড়ে ছড়িয়ে থাকা কাগুজে প্লেন কুড়ানোর কাজটি করে চলেছেন, তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্ধবিজ্ঞানী রোই গ্লাউবার। তিনি ২০০৫ সালে পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে নোবেল বিজয়ী হয়েছেন। তবুও তিনি এখন পর্যন্ত হাস্যকর নোবেল পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করার কাজটি করে চলেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে। হাস্যকর বিষয়টি হচ্ছে এই যে, নকল নোবেল পুরস্কারটি আসল নোবেলের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায়। এরা মনে করে নকল নোবেলের গুরুত্ব অনেক বেশি। তাই, বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিতে, আসল নোবেল পুরস্কার প্রদানের এক সপ্তাহ আগে নকল নোবেলের হাস্যকর পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এটা সত্যিই হাস্যকর এই জন্য যে, যারা পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন, তাদেরকে নিজ খরচেই থিয়েটারে এসে পুরস্কার গ্রহণ করতে হয়। এবং পুরস্কারস্বরূপ তাদের যে পুরস্কার প্রদান করা হয়, তা খুব সস্তা কাচামাল দিয়ে তৈরি একধরণের হস্ত-শিল্পকর্ম। এমন দৃষ্টান্তও আছে যে, এই 'বিখ্যাত নোবেল পুরস্কার' নিয়ে বাড়ি পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই তা ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেছে। এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কেন এটাকে হাস্যকর নকল নোবেল বলা হয়?

কি সব হাস্যকর গবেষণার জন্য এই পরস্কার দেয়া হয়? হ্যাঁ, তাহলে এখন ২০১৩ সালের নকল নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কিছু হাস্যকর গবেষণার কথা বলছি। এ বছরের পুরস্কারের মধ্যে মনস্তত্ত্ব বিষয়ে গবেষণার জন্য একটি পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। আর গবেষণাটি হল: মানুষ যখন মাতাল হয়, তখন সে নিজকে আরো সুন্দর ও স্মার্ট মনে করে থাকে। ফ্রান্সের মনস্তবিদ Laurent begue গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে, অধিকাংশ মানুষ মদ খেয়ে মাতাল হওয়ার পর নিজেকে মনে করে যে, তাকে আরো বেশি আকর্ষণীয় এবং সুন্দর লাগে। মজার না? বিষয়টি অত্যন্ত হাস্যকর হলেও গবেষণাকর্মটি কিন্তু মোটেই হাস্যকর ছিল না। তিনি অত্যন্ত সিরিয়াসলি এবং নিষ্ঠার সাথে গবেষণা করে এই ফলাফল আবিষ্কার করেছেন। তিনি প্রথমে ফ্রান্সের একটি পানশালায় ১৯ জন মানুষের সাক্ষাতকার গ্রহণ করেন, যারা নিজেদেরকে অত্যন্ত আকর্ষণীয়, শক্তিমান হিসেবেই মনে করে থাকেন। এদের সঙ্গে বেশ কিছু সময় থাকেন এবং তাদের ক্রমাগত মদপান করা পর্যবেক্ষণ করেন। এ সময় তিনি লক্ষ্য করেন যে, বেশি মদ খেয়ে মাতাল হয়ে তারা নিজেদেরকে আরো বেশি আকর্ষণীয় তরুণ হিসেবে ভাবতে থাকে। এরপর তার এই বিশেষ পর্যবেক্ষণকে প্রমাণ করার জন্য তিনি এবং তার সহকর্মী ৮৬ জন ফরাসী পুরুষ নিয়ে আরো এক সার্বিক গবেষণার কাজ শুরু করেন। হাস্যকর হলেও সত্যি যে, এ গবেষণার ফল সত্যি প্রমাণিত হয়েছে যে, মদ খাওয়ার পর মানুষের সাহস আরো বেড়ে যায়, এবং মনে মনে নিজেকে খুব সুন্দর এবং আকর্ষণীয় পুরুষ হিসেবে ভাবতে শুরুকরে। তাছাড়া এ সময়ে তার নিজের ওপর আস্থাও অনেকাংশে বেড়ে যায়।

এখন চলতি বছরের হাস্যকর নোবেল বিজয়ী মেডিকেল বিষয়ক গবেষণাকর্ম সম্পর্কে কিছু বলছি । জাপানের বেশ কিছু চিকিত্সক ইঁদুরের শরীরে হৃদয় প্রতিস্থাপন করে, সে সব ইুদরকে নিয়ে অপেরা শুনিয়েছে। ফলে যে সব ইঁদুর হৃদয় প্রতিস্থাপন অস্ত্রোপচার করিয়েছে এবং অপেরা শুনেছে, সে সব ইঁদুরের অস্ত্রোপচারের পর দ্রুতই তাদের শরীর সুস্থ হয়েছে। জাপানের টেইকিউ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল বিভাগের গবেষক এ পুরস্কার পেয়েছেন। গবেষক ইঁদুরকে হৃদয় প্রতিস্থাপন অস্ত্রোপচার করেছেন, সাধারণত এমন অস্ত্রোপচারের পর যে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয়, তা দেহের বহির্ভূত প্রতিক্রিয়ার কারণে ব্যর্থ হবে, এটাই স্বাভাবিক। যদি অস্ত্রোপচারের পর কোনো ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে প্রতিস্থাপন হৃদয় শুধুমাত্র ৭,৮ দিন বেচে থাকবে। কিন্তু যদি হৃদয় প্রতিস্থাপন ইঁদুরকে এক সপ্তাহ ধরে মোজার্টের অপেরা শুনানো হয়ে থাকে, তাহলে বহির্ভূত প্রতিক্রিয়া কমে যাবে। আর ইঁদুর বেঁচে থাকার সময়ও বৃদ্ধি পাবে।

এখানে আরকেটি খুব মজার পুরস্কার আছে, এটা হচ্ছে চলতি বছরের হাস্যকর নোবেল শান্তি পুরস্কার। আর এই হাস্যকর নোবেলের শান্তি পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাসেনকো'কে। তার পুরস্কার পাওয়ার কারণ হল, তিনি একটি আইন প্রণয়ন করেছেন যে, প্রকাশ্য স্থানে হাততালি দেয়া একদম নিষিদ্ধ। বন্ধু, আপনি মনে করছেন যে, প্রেসিডেন্ট এই পুরস্কার গ্রহণ করতে গিয়েছিলেন? অবশ্যই না। জানা গেছে, ২০১০ সালের ডিসেম্বরে কয়েশ শ' বিক্ষোভকারী বেলারুশে বড় আকারের মিছিল আয়োজন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দুর্নীতির প্রতিবাদ করে। এরপর লুকাশেনকো সরকার কঠিন হস্তে এ বিক্ষোভ দমন করার পর, সে দেশে হতাতালির মাধ্যমে প্রতিবাদ জানানোর পদ্ধতি আস্তে আস্তে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। প্রতি সপ্তাহের বুধবার কয়েশ শ মানুষ দেশের রাস্তায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে যায় এবং এক নাগারে হাততালি দেয়া শুরু করে। যদিও তারা মুখে কিছুই বলে না, একদম নিশ্চুপ থাকে, তবুও প্রত্যেকেই বুঝতে পারে যে তারা আসলে কি বলতে চায়। এরপর পরের বছরই মানে ২০১১ সালের ৩ জুলাই বেলারুশের স্বাধীনতা উদযাপন অনুষ্ঠানে পুলিশ ঘোষণা করেছে যে, প্রকাশ্য স্থানে যে কোনো ধরনের হাততালি দেয়া অবৈধ এবং নিষিদ্ধ।

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক