Web bengali.cri.cn   
ফ্রান্সের বিমানবন্দরে ১৮ বছর আটকে থাকা ইরানি
  2013-07-19 18:20:00  cri


 

ওবামা সরকারকে চ্যালেঞ্জ করা সাবেক আমেরিকান গোয়োন্দা এডওয়ার্ড স্নোডেন এখন কোথায়? রুশ প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র দিমিট্রি পেস্কোভ জানিয়েছেন, স্নোডেন এখনও মস্কোর বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক ট্রানজিট এলাকায় অবস্থান করছেন। তিনি রাশিয়ায় প্রবেশ করেন নি।

সারাবিশ্ব স্নোডেন ইস্যুর ওপর যেমনি গুরুত্ব দিচ্ছে, তেমনি তিনি বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক ট্রানজিট এলাকায় আটকে থাকার কারণে এ বিশেষ জায়গাটির প্রতিও বিশ্ববাসীর কৌতূহল বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের 'ওয়াশিংটন পোস্ট' পত্রিকা লিখেছে স্নোডেনের বিমানবন্দরে আটকে থাকার সময় তাঁর অগ্রজদের তুলনায় একেবারে কিছুই না।

সবচেয়ে দীর্ঘ সময় বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক ট্রানজিট এলাকায় আটকে থাকার রেকর্ডটি ইরানি নাগরিক মারহান কারিমি নাসেরির। ইরান থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর তিনি ফ্রান্সের দা গোল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১৮ বছর আটকে ছিলেন। এ বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রও তৈরি হয়। চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ২০০৪ সালের বিখ্যাত তারকা টম হানক্সের তারকাচিহ্নিত 'দি টার্মিনাল'।

তিনি দা গোল বিমানবন্দরের টার্মিনাল-১-এর লাল বেঞ্চে বসে হিলারির আত্মজীবনী 'লিভিং হিস্ট্রি' পড়েন।

তিনি কোনো সাধারণ যাত্রী নন; তিনি মারহান কারিমি নাসেরি। তিনি ব্রিটেনগামী একটি ফ্লাইটে চড়ার জন্য অপেক্ষা করেন এবং সে অপেক্ষা ১৮ বছর ধরে।

এ কাহিনীর শুরু ১৯৭৭ সালে। ওই সময় নাসেরি সবে ব্রিটেন থেকে লেখাপড়া শেষ করে নিজ দেশে ফিরে যান। কিন্তু ইরানের শাহের বিরোধিতা করার শাস্তি হিসেবে তাঁকে নিজ দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কার হওয়ার কারণে তাঁর কোনো পাসপোর্ট ছিল না। তাঁর দীর্ঘকালীন যন্ত্রণা তখনই শুরু হয়।

নাসেরি ইউরোপীয় দেশগুলোর কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। কিন্তু একের পর এক প্রত্যাখ্যাত হন। ১৯৮১ সালে বেলজিয়াম নাসেরিকে শরণার্থীর মর্যাদা দেয় এবং তিনি নিজের শরণার্থীর পরিচয়পত্র নিয়ে একটি ইউরোপীয় দেশের নাগরিকে পরিণত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন।

ব্রিটেনে বেড়ে ওঠা একজন ইরানি হিসেবে নাসেরি ব্রিটেনে তাঁর আত্মীয়স্বজনকে খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তখন ছিলেন প্যারিসে। কিন্তু ১৯৮৮ সালে প্যারিসে তাঁর সুটকেস চুরি হয়ে যায় এবং তিনি তাঁর শরণার্থীর মর্যাদা-সংক্রান্ত কাগজপত্র হারান। তিনি নিজের ভাগ্য পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেন এবং ব্রিটেনে যাওয়ার লক্ষে একটি বিমানটিকিট কিনে ফেলেন। কিন্তু কোনো পরিচয়পত্র ছাড়া তিনি বিমানে চড়তে পারেন না এবং পরে তাকে ফ্রান্সের দা গোল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

শুরুতে ফরাসি পুলিশ 'অনুপ্রবেশের' দায়ে নাসেরিকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে কোনো কাগজপত্র ছিল না। তাই তাঁকে কোথায় পাঠানো হবে, সে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না তারা।

এ পরিস্থিতিতে নাসেরি দা গোল বিমানবন্দরে থেকে যান। একজন আইনজীবী স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে তাঁর পক্ষে মামলা করেন, যাতে তিনি ব্রিটেনে যেতে পারেন। ১৯৯২ সালে ফ্রান্সের একটি আদালত রায় দেন যে, নাসেরির ইমিগ্রেশন বৈধ। সুতরাং ফ্রান্স তাঁকে বহিষ্কার করতে পারে না।

কিন্তু নাসেরির জন্য এটা কোনো বিজয় ছিল না। কারণ আদালত তাঁর বহিষ্কারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও তাঁকে ফ্রান্সের শরণার্থীর মর্যাদা দেন না এবং তিনি ব্রিটেনে যাওয়ার ভিসা পান না। এক কথায়, নাসেরি তখন একজন 'মর্যাদাহীন' ব্যক্তি। বিমানবন্দর ছাড়া তিনি কোথাও যেতে পারেন না।

একই সময় বেলজিয়াম সরকার দায়িত্ব চাপিয়ে দেয় নাসিরের ওপর। তারা জানায়, নাসেরির শরণার্থীর মর্যাদা-সংক্রান্ত প্রমাণ তাদের কাছে আছে। তবে সেটি সংগ্রহের জন্য নাসেরিকেই বেলজিয়াম যেতে হবে। কিন্তু অন্য দিকে তারা নাসেরিকে বেলজিয়াম ফেরত নেয় না। কারণ দেশটির আইন অনুযায়ী, স্বেচ্ছায় বেলজিয়াম ত্যাগকারী কোনো শরণার্থী ফের দেশটিতে প্রবেশ করতে পারেন না।

ফলে বছরের পর বছর নাসেরি দা গোল বিমানবন্দরে আটকে থাকেন। তাঁকে দেখে মনে হয় না তিনি বিমানবন্দরের বেঞ্চে ঘুমানো শরণার্থী। তাঁর কাপড় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, দাড়িও পরিপাটি। তিনি তাঁর একমাত্র স্যুটটিকে বিমানবন্দরের ট্রলিতে রাখেন। সেটি প্লাস্টিক ব্যাগ দিয়ে সুন্দর করে মোড়ানো। দেখলে মনে হয় সবেমাত্র ড্রাই ক্লিনার্স থেকে আনা হয়েছে। তাঁর সব জিনিস তিনি পরিপাটি করে সুটকেস রাখেন।

নাসেরি বিমানবন্দরের কর্মীদের সঙ্গে ভাল বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। বিমানবন্দরের একটি রেস্তোরাঁর মালিক বলেন, তিনি কারোর কাজে বিঘ্ন ঘটান না। বিমানবন্দরের প্রতিটি লোক তাঁর দেখাশোনা করে।

বিমানবন্দরের যাজক প্রতি সপ্তাহে কয়েকবার তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। বিমানবন্দরের ডাক্তারও মাঝমধ্যে তাঁর শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করেন। মাঝেমাঝে পর্যটকরা তাকে কিছু কাপড়-চোপড় দেয়। কিন্তু তিনি তা নিতে অস্বীকৃতি জানান। তাঁর কারণ হলো তিনি নিজেকে ভিক্ষুক মনে করেন না। কয়েকবার নাসেরি পর্যটকদের হারানো বড় অঙ্কের অর্থ বিমানবন্দরের পুলিশের হাতে তুলে দেন।

তাঁর দৈনন্দিন জীবনযাপন খুব নিয়মতান্ত্রিক। প্রতি দিন ভোর সাড়ে ৫টা নাগাদ অর্থাত্ বিমানবন্দর ব্যস্ত হয়ে ওঠার আগে তিনি হাতমুখ ধোয়া, গোসল করা ও টয়লেট সেরে ফেলেন। তারপর পড়ে পড়ে দিনটি কাটান। তিনি পত্রিকা পড়েন, ম্যাগাজিন পড়েন। এছাড়া তিনি বিমানবন্দরের কর্মীদের সঙ্গে চলতি মাসের ভালো বই নিয়ে আলোচনা করতে পছন্দ করেন।

মাঝেমাঝে কোনো কোনো পর্যটক এসে তাঁর সঙ্গে কফি খেয়ে কথাবার্তা বলেন। সন্ধ্যায় যখন বিমানবন্দরের দোকান বন্ধ হয়ে যায়, তখন তিনি হাত-মুখ ধুয়ে ঘুমান। প্রতি সপ্তাহ তিনি একবার করে কাপড় পরিস্কার করেন এবং টয়লেটে সেগুলো ঝুলিয়ে রাখেন।

২০০৪ সালে টম হানক্সের তারকাচিহ্নিত 'দি টার্মিনাল' চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। এরপর নাসেরি এক বিশ্ববিখ্যাত জনে পরিণত হন। কারণ তিনি চলচ্চিত্রের কাহিনীর প্রধান চরিত্র।

'বিমানবন্দর হচ্ছে একটি স্বর্গ ও পৃথিবীর মধ্যে একটি উত্তম জায়গা।' দা গোল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তখনকার মুখপাত্র বলেছিলেন, 'নাসেরি এখানে পরিবার খুঁজে পেয়েছেন।'

বিমানবন্দরের জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা নাসেরি ওই জায়গাটি ত্যাগ করতে ভয় পান। বেলজিয়াম সরকার পরে তাঁকে দেশটিতে ফেরতে নিতে চায়, কিন্তু ব্রিটেনে যাওয়ার ইচ্ছায় তিনি সেটা প্রত্যাখ্যান করেন। ফ্রান্স সরকারও পরে তাঁকে দেশটিতে বসবাসের পারমিট দিতে চায়, যার ফলে তিনি অবাধে যেখানে খুশি যাওয়ার অধিকার পেতে পারেন। কিন্তু তিনি সেটাও প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ কাগজপত্রে তাঁর জাতীয়তা ছিল ইরান। কিন্তু তাঁর আশা হচ্ছে ব্রিটেনের নাগরিকত্ব।

নাসেরির কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাতা ইরানি পরিচালক এলেক্স কোলোথ মনে করেন, দীর্ঘকাল ধরে ছোট গণ্ডির মধ্যে থাকার কারণে নাসেরির বাইরের জীবনের প্রতি ভয় তৈরি হয়।

ভাগ্যের কারণে ২০০৬ সালে নাসেরি নতি স্বীকারে বাধ্য হন। রোগাক্রান্ত হওয়ার পর তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতাল থেকে বের হবার পর তাঁকে প্যারিসের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়।

 

***প্রশ্ন: নাসেরি ফ্রান্সের বিমানবন্দরে কত বছর ছিলেন?

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক