Web bengali.cri.cn   
রুপকথার মত দেশ-ব্রুনাই
  2013-07-05 19:40:10  cri


ব্রুনাই, এ দেশের সম্পূর্ণ নাম হল Negara Brunei Darussalam। এ নামের অর্থ হল সতর্ক এবং শান্তি। এটি একটি ইসলামী রাষ্ট্র। দেশের আয়তন শুধু মাত্র চীনের শাংহাই শহরের সমান। তবে এ দেশের মহান রাজপ্রাসাদ, বিশ্ববিখ্যাত নদীগ্রাম, বিশেষ কারুকার্যময় এবং স্থাপত্যশৈলীর মসজিদ, সারা বিশ্বকে অবাক করেছে। ২০১৩ সালে দেশটি আবার আসিয়ানের চেয়ারম্যান দেশ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। এবং এ অর্জন বিশ্বভূবনে আরো বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। বলা যায় প্রায় সমগ্র বিশ্বই ছোট্ট অথচ বিশেষ এই দেশটিকে জানতে অনেক আগ্রহী। বর্তমান ইন্টারনেটের দুনিয়ায় বিশ্ব যেন সত্যিই একটি গ্রামের মত ছোট হয়ে গেছে। হাত বাড়ালেই পেয়ে যাচ্ছেন সব তথ্য, পা বাড়ালেই পৌঁছে যাচ্ছেন দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। তা সত্ত্বেও ছোট্ট এই দেশ ব্রুনাই-এর অনেক কিছুই এখনো রয়েছে অজানা। আবার দেশটি নিয়ে কল্পনায় সোনার জাল বোনা মানুষের সংখ্যাও কিন্তু নেহাত কম নয়।

ব্রুনাই সম্পর্কে একটি বড়ধরনে ভুল ধারণা হচ্ছে "ব্রুনাই-এ সব জায়গায় সোনা পাওয়া যায়। কেউ কেউ এমনও বলেন যে, এ দেশে ১.৩ বিলিয়ন ব্রুনাই ডলার দিয়ে একটি ক্রিস্টল বাগান তৈরি করেছে, আর রাজপ্রাসাদটি পুরোপুরিভাবে সোনা দিয়ে তৈরি। শ্রোতা বন্ধু এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। এমনটি বোধকরি কেবল রূপকথায় সম্ভব হতে পারে। বাস্তব সত্য হলো এই যে, সে দেশের রাজপ্রাসাদ এবং ইসলাম ধর্মীয় স্থাপত্য নিদর্শন সমূহ ব্যপক কারুকার্যময় আর দৃষ্টি নন্দন এবং দেখতে সত্যিকার অর্থেই চোখ ধাঁধানো স্বর্ণসন্দুর, যেন প্রতিটি রাজপ্রাসাদ আর মসজিদ স্বর্ণখোচিত- কিন্তু তা আসল স্বর্ণ নয়। আর এই সব বাহারী অট্টালিকার পাশেই আপনি পেয়ে যাবেন হতদরিদ্র সেই সব মানুষদের যাদের থাকার জন্য সামান্য কুটিরগুলি দেখতে ঠিক যেন বিপরীত অর্থাত্ বিবর্ণ আর মলিন। অনেক নাগরিকের বাড়ি কেনার সামর্থ নেই তাইজন্যে তারা নদীগ্রাম বানিয়ে নদীতে বসবাস করে। এমন দৃশ্য খোদ ব্রুনাই-এর রাজধানী বন্দর সেরি বেগাওয়ানের ব্রুনাই নদীতেই দেখতে পাবেন আপনি। তবে বর্তমানে এটি বিশ্বের বৃহত্তম ঐতিহ্যবাহী নদীগ্রামে পরিণত হয়েছে, কেননা এটিই এখন বিশেষ দর্শনীয় একটি স্থানের মর্যাদা অর্জন করেছে। বর্তমানে এখানে বসবাসকারী নাগরিকেরা তাদের ছোট ছোট বাড়িগুলোক উজ্জ্বল রং দিয়ে বেশ সুন্দর নক্সাখোচিত আলপনা এঁকে সাজিয়ে রাখেন, যাতে পর্যটক আকর্ষণ করতে পারে। বর্তমানে এই নদী গ্রামে ৩০ হাজারেরও বেশি লোক বাস করে। শ্রোতা এবারে আপনি কল্পনা করতে পারেন এমন যে, গৃহহীন একদল মানুষ থাকার আশ্রয় খুঁজতে বেছে নিচ্ছে একটি নদীকে যেখানে নদীর ওপরেই ঘর তৈরী করে বসবাস করছে। কালক্রমে সেই নদীগ্রামটির প্রতি সরকারের বিশেষ নজর পড়তে থাকে। সরকার নদী গ্রামে থাকা লোকজনের জীবনযাপনের মান উন্নয়ন করার জন্য বিশেষ করে নদী স্কুল, ক্লিনিক, ডাক আফিস, দোকান,দমকল বিভাগ নির্মাণ করেছে। এ ছাড়া সেখানে একটি মসজিদ আছে, যে মসজিদটির একটি অংশ নদীতে, আর বাকি অর্ধাংশ স্থলে নির্মিত। বলতে পারেন দারিদ্রই তাদের মহান করেছে। কেননা এটি বর্তমানে বিশেষ পর্যটন আকর্ষনীয় এবং বৈশিষ্টময় একটি স্থান।

ব্রুনাই সম্পর্কে আরও একটি বড় ধরনের ভুল ধারণা রয়েছে যে, ব্রুনাই-এর প্রত্যেক মানুষ দামী ও বিলাশবহুল ভিলায় বসবাস করে থাকে এবং প্রত্যেকের বিখ্যাত ও দামি ব্রান্ডের গাড়ি আছে। আসল অবস্থা কিন্তু তা নয়, ব্রুনাইয়ের অধিকাংশ মানুষের বাড়ি সাধারণত দু'তলার। প্রথম তলা হল living room, এবং দোতলা হল bedroom আর এ সব বাড়িঘর খুব স্বল্প ব্যায়ে নির্মিত এবং সাধারণের সাধ্যের নাগালের মধ্যেই তৈরী করা হয়। এগুলোকে কোনো ভাবেই বিলাশবহুল ভিলার সাথে তুলনা করা যাবে না। পৃথিবীর আর দশটা দেশের মতোই ব্রুনাইতেও মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক মানুষ অট্টালিকা সদৃশ ভিলাতে বসবাস করে থাকে। অন্যদিকে ব্রুনাই-এর পাবলিক যানবাহন ব্যবস্থা খুবই অনুন্নত, পাবলিক যানবাহনে চলাচল রীতিমত একটি ঝামেলা আর দূর্ভগের কারণ হয়ে ওঠে। তাই লোকজন বাধ্য হয়ে গাড়ি কিনে নিজেই চালায়। সরকারি পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, বর্তমানে ব্রুনাই পরিবারের গড়ে ৩টি গাড়ি আছে। তবে মজার বিষয় হচ্ছে তাদের গাড়ির দাম বেশি নয়, সাধারণত ১ লাখ থেকে ৫ লাখ ইউয়ানেরও বেশি মূল্যের গাড়ি নেই বললেই চলে। ব্রুনাইয়ের রাস্তায় আপনি বিশেষ বিলাশবহুল গাড়ি খুব একটা দেখতে পাবেন না।

আবার কারো করো কল্পনার ব্রুনাই এতটাই রূপকথার মতো যে, কেউ কেউ মনে করে থাকেন যে, ব্রুনাইয়ের মানুষ এত ধনি যে, খাবার টেবিলে সোনার বাটি ব্যবহার করা তাদের জন্য অতি সাধারণ একটি ব্যাপার। এই ধারণাটি আদৌ সত্য নয়। আমাদের সংবাদদাতার সে দেশের জীবন উপভোগ করার পর আবিস্কার করেছে যে, সাধারণ লোকজনের জীবনযাত্রার মান খুব একটা উচু নয়। এমনকি সে দেশের ধনি মানুষের জীবনযাত্রার পদ্ধতিও খুব একটা বিলাশী নয়। ব্রুনাই-এ একটি বৃহতাকারের আধুনিক এবং ব্যায়বহুল শপিং মল আছে, যার নাম ইয়াইয়াসান। এই শপিং মলেও খুব একটা বিলাশি পণ্য সমাগ্রীর বিক্রি বাট্টা হয় না। যদিও এ শপিং মলকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম এবং সবচেয়ে বিলাশি শপিং মল হিসেবে বলা হয়, কিন্তু এই মার্কেটের বেশকিছু দোকান মালিক ইতমধ্যেই তাদের দোকান বন্ধ করে দিয়েছে। কেননা, বিক্রির পরিমান কম বলে তাদের পক্ষে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। সে তুলনায় ব্রুনাইয়ে, নিম্ন আয়ের লোকজনের জন্য সাধারণ সুপারমার্কেট এবং বাজারের ব্যবসা অনেক ভালো। লোকজন সেখানে জিনিস কিনতে পছন্দ করে, এসব বাজারে প্রতিদিনের ক্রেতার সংখ্যা থাকে অনেক বেশি। বিশেষ করে সস্তা দামের পণ্যসামগ্রী লোকজনের খুব প্রিয়।

ব্রুনাই সম্পর্কে আরেকটি ভুল ধারণা হচ্ছে এমন যে, সে দেশের সামাজিক পরিবেশে এতটাই উন্নত যেন স্বর্গের মত, মানুষের সামাজিক জীবনের চলাচলে কোথাও যেন কোনো ভেদাভেদ নেই, কোনো কিছু নিয়েও যেন চিন্তা করার কিছু নেই। তবে আসল অবস্থা কিন্তু সে রকম নয়। সেখানে নাগরিকের ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক মর্যাদা আছে। বিনা খরচে লেখাপড়া এবং চিকিত্সা সেবা, কম সুদে ঋণ পেয়ে বাড়িঘর কেনা, ভর্তুকি সুবিধা এবং বার্ধক্যবিমা, এসব সামাজিক কল্যাণকর সুবিধা কিন্তু প্রত্যেক ব্রুনাই নাগরিক ভোগ করে না। এ সব সুবিধা কেবল ব্রুনাই-এর তিন ভাগের এক ভাগ নাগরিকেরাই ভোগ করে থাকে। অবশ্য, প্রতিটি কাজেরই দুটি দিক থাকে ভাল আর মন্দ। ব্রুনাইয়ের সামাজিক কল্যাণ ব্যবস্থা যথেষ্ট উন্নত সন্দেহ নাই, কিন্তু এ ব্যবস্থার একটি নেতিবাচক দিক হচ্ছে অনেকেই সরকারের কাছ থেকে সামাজিক কল্যাণমূলক ঋণগ্রহণ করে তা আর ফেরত দেয় না। ফলে ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্রুনাই-এ ঋণ বিষয়ক মামলার সংখ্যা ৪৩৫৬টি, এবং এই সংখ্যা ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসের তুলনায় ৪২ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে সরকারের কাছে ব্রুনাই নাগরিকের ঋণ ৪৮ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি। পানি ও বিদ্যুত-এর বকেয়া ফি প্রায় ১৯ কোটি মার্কিন ডলার।

এ পর্যন্ত আমরা ব্রুনাইয়ের যে বাস্তব পরিচয় পেলাম, তা থেকে একটি কথা বেশ জোরের সাথেই বলা যায় যে, ধ্বনী, গরীব, উচু, নিচু এই সব বিভেদ বিভাজনকে সাথে নিয়েই ব্রুনাই তার নামের মতোই সত্যিই একটি শান্ত আর শান্তিপ্রিয় দেশ। এটিই হচ্ছে মূলত দেশটির প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আর্কষণের মূলকারণ। সে কারনেই হয়তো বিশ্বের অনেক লোক ব্রুনাইয়ের নাগরিক হতে চান এবং সেখান থাকতে চান, কারণ দেশটির সামাজিক কল্যাণ ব্যবস্থা বেশ উন্নত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ব্রুনাই ভিন্ন ভাষা সংস্কৃতির মানুষদের স্থায়ীকরণে নিরুত্সাহিত করে। কেননা এ দেশের নাগরিক হওয়া বেশ কঠিন। এখানের নাগরিক হওয়ার প্রথম শর্ত হল ব্রুনাই-এ একটানা ২০ বছর থাকতে হবে এবং বেশ জটিল ও কঠিন ব্যবস্থাপনায় মালয়েশিয়া ভাষার পরীক্ষায় পাস করতে হবে আপনাকে। এই পরিক্ষা ব্যবস্থা সত্যিই জটিল কেননা, এ পরীক্ষার ফলাফল পুরোপুরিভাবে নির্ভর করে পরীক্ষকের মেজাজ মর্জি আর খেয়াল খুশির ওপর। যদি সেদিন মানে পরিক্ষার দিন পরীক্ষকের মন কোন কারনে বিগড়ানো থাকে, তাহলে আপনি নিশ্চত থাকুন যে, খুব ভালোভাবে পরীক্ষা দিলেও আপানার এ পরীক্ষায় পাস হবেন না।

এ ব্যবস্থা সত্যি খুব জটিল, মূলত এই ব্যবস্থা এটা নিশ্চিত করতে চায় যে, শ্রেষ্ঠ মানুষেরাই কেবল ব্রুনাইয়ের নাগরিক হতে পারে। তবে এর একটি বড় নেতিবাচক দিক হলো অনেক আবেদনকারীরা এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার ধৈর্য হারিয়ে দেশ ত্যাগ করে চলে যায়। এর ফলে ব্রুনাই অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন মানব সম্পদকে দেশের উন্নয়নে নাগরিক সুবিধা প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছে। এটা ব্রুনাই-এর মতো ছোট দেশের জন্য খুব একটা সু-সংবাদ নয়।

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক