Web bengali.cri.cn   
"পরমাণু পর্যটন"
  2013-05-06 18:29:18  cri

আপনারা কি জানেন এ ভ্রমণে পর্যটক কোন কোন পর্যটন স্থানে ভ্রমন করতে যাবেন? কি মনে হয়, যদি ভয়াবহ পরমাণু দুর্ঘটনার পর পরিত্যাক্ত ঐ সকল পরমাণু ঘাটি বা স্থাপনাগুলোতে ভ্রমণ করার জন্য আপনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, যাবেন তো এমন জায়গায় ভ্রমন করতে? কিন্তু বিস্ময়কর সত্য হচ্ছে এই যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরমাণু অস্ত্র ও পরমাণু দুর্ঘটনা জনিত সংকট আর আতঙ্ক সারা বিশ্বজুড়ে বৃদ্ধি পেলেও "পরমাণু পর্যটন" নামের নতুন এক ধরনের ভ্রমন জনগণের মাঝে ক্রমশই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ভ্রমন পিপাসু পর্যটক ইউক্রেনের চেরনোবিল পরমাণু বিদ্যুত্ কেন্দ্র, জাপানের হিরোশিমা ও সাগাসাকিশি, যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটন পরমানু পরিকল্পনা ঘাটি প্রভৃতি সকল ভয়াবহ পারমানবিক ধ্বংসযজ্ঞ এবং ত্যাজক্রিয়তা সমৃদ্ধ স্থানে ভ্রমন করতে যাচ্ছেন। যুক্তি হচ্ছে এই যে, ইতিহাসকে মনে রাখা উচিত এবং পরমাণুর সর্বগ্রাসী আর বিধ্বংসী রূপ কতটা ভয়াবহ সেটাও জানা উচিত। শ্রোতা, চলুন তাহলে আজকের অনুষ্ঠানে আমরা আপনাদের নিয়ে ভয়াবহ দূর্ঘটনা কবলিত কোনো পরমানু কেন্দ্র বা স্থাপনা থেকে ঘুরে আসি। অন্তত আপনারা যাতে কল্পনায় হলেও "পরমাণু ভ্রমণ" বিষয়টি কি সেটি সম্পর্কে ধারণা পেতে পারেন।

পরমাণু ভ্রমণের বিষয় ভালোভাবে বোঝার জন্য প্রথমে আমরা বিশ্বের ভয়াবহ কয়েকটি পরমাণু দুর্ঘটনার ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট জেনে নিতে পারি।

১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল, স্থানীয় সময় দুপুর ১টা ২৩ মিনিটে সাবেক সভিয়েট ইউনিয়নের ইউক্রেনের চেরনোবিল পরমাণু বিদ্যুত্ কেন্দ্রের ৪ নং রিএক্টরে ভয়াবহ এক বিস্ফোরণ ঘটে। প্রায় ১৬৫০ বর্গমিটার এলাকা জুড়ে এর তেজক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে। এর তেজক্রিয়তার মাত্রা যে কত ভয়াবহ তা ঘটনার প্রায় বিশবছর পর ২০০৫ সালে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার একটি প্রতিবেদন থেকে সহজেই অনুভব করতে পারেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী দূর্ঘটনার এত বছর পরও ২০০৫ সাল নাগাদ তেজক্রিয়তা জনিত কেসার রোগে ৫৬ জন মারা যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। এদের মধ্যে বিদ্যুত্ কেন্দ্রের ৪৭ জন কর্মী এবং ৯ জন শিশু। অনুমান করা হচ্ছে প্রায় ৪ হাজার মানুষ এই কেসার রোগে আক্রান্ত হবে বা মারা যাবে। উল্লেখ্য যে, চেরনোবিল এই দূর্ঘটনার পর বেশ কিছু বেসরকারি সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা এক লাখেরও বেশি। শুধু ইউক্রেনে প্রায় ২৩ লাখ মানুষ এ দুর্ঘটনার কারণে কেসার রোগে আক্রান্ত হয়েছে।

এসব তথ্য শুনে আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি যে, পরমাণু দুর্ঘটনার পর কি ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল সেই এলাকায়। কিন্তু আজ ঘটনার প্রায় ২০ বছর পার হয়ে গেছে, তখনকার "মৃত্যু পুরী" আবারও যেন প্রাণচাঞ্চল্যতা ফিরে পেতে শুরু করেছে। বিশ্বের হাজার হাজার পর্যটন চেরনোবিলে পরিদর্শন বা ভ্রমণ করতে যাচ্ছেন। ২০০৯ সালে চেরনোবিল পরমাণু বিদ্যুত্ কেন্দ্র মোট ৭৫০০ জন পর্যটককে অভ্যর্থনা জানিয়ে ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ফর্বস ম্যাগজিন এ স্থানটিকে "বিশ্বের সবচেয়ে বিশিষ্ট পর্যটন স্থান" হিসেবে নির্বাচন করেছে। এই ভয়াবহ প্রেক্ষাপট তথ্য জানার পর আপনারা কি বিশেষ কোন কৌতুহর হচ্ছে যে, অন্যান্য পর্যটন স্থানের মতো এই চেরনোবিল পরমাণু বিদ্যুত্ কেন্দ্রে ভ্রমণ করতে কোনো বিশেষ প্রস্তুতি লাগে কিনা বা এর জন্য বিশেষ কোনো নিময় নীতি মেনে চলতে হয় কি না? চলুন তাহলে এখন আপনাদের সাথে নিয়েই ঘুরে আসি আর দেখে আসি এখানে ভ্রমনের জন্য আপনাদের কি কি বিষয় জানতে হবে বা প্রস্তুতি নিতে হবে।

চেরনোবিল পরমাণু বিদ্যুত্ কেন্দ্রে প্রবেশ করতে হলে প্রথমে আপনাকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে বিশেষ অনুমোদন কার্ড সংগ্রহ করতে হবে। কেবল নির্দিষ্ট কিছু মিনিবাস রয়েছে যার মাধ্যমে আপনি এ কেন্দ্রের কাছাকাছি এলাকায় পৌঁছাতে পারেন। নির্দিষ্ট এলাকা অর্থাত্ তেজস্ক্রীয় অধ্যুষিত বিষধর-পুরীতে প্রশেবের পূর্বে আপনাকে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে। এ চুক্তিতে থাকবে- যেমন পর্যটকের উচিত দূষণ প্রতিরোধ নিয়ম মেনে চলা, উন্মুক্ত জায়গায় খাবার খাওয়া ও সিগারেট খাওয়া একদম নিষিদ্ধ। নির্দিষ্ট চিহ্ন যুক্ত বস্তু বা জিনিস ছাড়া অন্য কোনো যে কোনো জিনিস স্পর্শ করতে পারবেন না এমন কি মাটিতেও বসতে পারবেন না। শুধু তাই নয় ব্যক্তিগত জিনিস-পত্র মাটিতে রাখতেও পারবেন না, ইত্যাদি অনেক স্পর্শকাতর পিলে চমকানো শর্ত, তবে আর একটি প্রধান শর্ত রয়েছে যেটির কারনে আপনি হয়তো ভ্রমন বাতিল করে ফিরে আসতে পারেন। শর্তটি হচ্ছে 'আপনি যদি পরবর্তীকালে তেজস্ক্রীয় জনিত কোনো রোগে আক্রান্ত হন তবে কর্তৃপক্ষ এর জন্য দায়ী থাকবে না। এ সকল আত্মা দুমড়ানো শর্ত মেনে ভ্রমন করা একজন পর্যটক সে এলাকা পরিদর্শনের পর তেজস্ক্রীয়তার ভয় তাকে এতটাই আক্রান্ত করেছিল যে এলাকা থেকে বের হয়েই পড়নের সব কাপড়, জুতা খুলে ফেলে দেয় ডাস্টবিনে।

হয়তো আপনি মনে করছেন, এত বেশি বছর পার হয়ে গেছে যে, নিশ্চয়ই তেজস্ক্রীয়তার মাত্রা আর নেই বা ক্ষতিকর অবস্থায় নেই আর সে কারনে অনেক সংখ্যক পর্যটক সেখানে যায় তাই না? কিন্তু এটি সম্পূর্ণ তা ভুল ধারনা। পর্যটন গাইড বলেছে, প্রতি বছর কমপক্ষে দু'তিন জন সেখানে তেজস্ক্রীয়তায় আক্রান্ত হবে। সে এলাকার তেজস্ক্রীয়তা স্বাভাবিক এলাকার চেয়ে অনেক বেশি। তাই এরকম কোনো স্থানে ভ্রমণ করতে চাইলে আপনার বুকে সাহসের পাটাটিকে বেশ শক্ত-মজুবত করা চাই ই চাই। এখানে পর্যটকরা কাছে থেকে ধ্বংস হওয়া পরমাণু রিএক্টর দেখতে পারেন, ছবি তুলতে পারেন, তারপর তারা পরমাণু বিদ্যুত্ কেন্দ্রের ৩ কিলোমিটার দূরের ছোট শহর প্রিপিয়াত-এ যাবেন, যেখানে দূর্ঘটনার সময়ে পরমানু কেন্দ্রের ৫০ হাজারেরও বেশি কর্মী ও তাদের পরিবারের বাসস্থান ছিল। বিস্ফোরণের পর সেখান থেকে সব মানুষদের নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা হয়েছে। বর্তমানে এ শহরটি একটি "মানবশূণ্য মৃতশহরে" পরিণত হয়েছে।

সত্যি ঐ শহরে শিওরে ওঠার মতোই এক দৃশ্য অপেক্ষা করছে আপনার জন্য। কেননা 'সময়' ঐ শহরে যেন থেমে গেছে চিরতরে, ঘড়ির কাটা নড়ছে না এতটুকু। আপনি সেখানে ঢুকেই দেখবেন প্রাক্তন সোভিয়েট ইউনিয়নের সময়ের সব স্লোগান, দেয়াল লিখন আর দেয়াল চিত্র সর্বত্র। বাড়ি ঘর রাস্তা মার্কেট মানবশূণ্য ঠিকই তবে ঘরে আসবাব, বিছানাপত্র, বই সবকিছু সাজানো রয়েছে ঠিক যেন সেই দিনটির মতোই, যেন এখুনি গৃহকর্তা এসে আপনাকে অভ্যর্থনা জানাবেন। আসলে কেউ আর কখনো এসে বলবে না যে আপনাকে সাদর সম্ভাষণ। মার্কেটে সাজানো রয়েছে প্রয়োজনীয় সব সামগ্রী, চাইলে কিনে নিতে পারেন- কিন্তু মালিক আর ক্রেতা কেউই নেই সেখানে। স্কুলের ক্লাসরুমে ঢুকে আপনি দেখতে পাবেন আগামী সপ্তাহের সময়সূচী। তখন সত্যি আপনার কি মনে হবে না যে সময় থমকে গেছে মানবশূণ্য ঐ শহরে? আপনার ভিতরে কি সেই অনুভূতি হবে না যে, কোনো একটি টাইম মেশিনে চড়ে আপনি ঠিক ২০, ৩০ বছর আগে ফিরে গেছেন? কোনো চলচিত্রের পর্দায় নয় বাস্তবেই আপনি যেন হরোর বা থ্রিলার মুভির কোনো লোকেশানে চরিত্র হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

আসলে এ রকম রোমাঞ্চকর অনুভূতির অভিজ্ঞতায় সিক্ত হতেই অনেক পর্যটকের চোখে এই স্থানটি অত্যন্ত এ্যাডভেঞ্চারাস এবং বিশেষ দর্শনীয় একটি স্থান। আবার কোনো কোনো পর্যটক যেমন একজন অস্ট্রেলিয়ান পযর্টক বলেছেন, এ জায়গাটি খুব সুন্দর যেন কবিতার মত। তবে সেখানে এত ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে আমার খুব দুঃখ লাগে। আবার কেউ কেউ মনে করে এমন স্থানে ভ্রমণ করা যেন আত্মহত্যার মত। তবুও অনেক পর্যটক মনে করে এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার এবং গ্রহণযোগ্য। তারা মনে করে এটা ইতিহাসের একটি প্রমাণ আর এর সাক্ষী হতে কে না চায়। তাই বিস্ফোরণের পর অনেকেই এ স্থানে ভ্রমনে গিয়েছে কারণ তারা মনে করে এটি মানবজাতির খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ।

এখন আমরা জাপানের দিকে একটু দৃষ্টি ফেরাবো। হয়তো অনেকেই জানেন ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট, স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে জাপানের একটি যুদ্ধবিমান জাপানের হিরোশিমা শহরকে লক্ষ্য করে "ছেলে" নামে একটি আণবিক বোমা নিক্ষেপ করেছে। বোমাটা আকাশে বিস্ফোরিত হয় এবং বিপুল শক্তিতে হিরোশিমা শহরের সব নির্মাণ অবকাঠামো ধ্বংস করে দেয়। শহরের ২ লাখ ৪৫ হাজার মানুষের মধ্যে ৭৮১৫০ জন তাত্ক্ষণিক ভাবে মারা যায় আর বেঁচে থাকা প্রায় সকলেই কম বেশি আহত হয়। এখানেই শেষ নয়, তিনদিন পর অর্থাত্ আগস্ট ৯, মার্কিন বাহিনী আবারও "মোটা মানুষ" নামে আরেকটি বোমা জাপানের নাগাসাকি শহরে নিক্ষেপ করেছে। এবার হতাহতের সংখ্যা ৮৬ হাজার, তা শহরের মোট জনসংখ্যার ৩৭ শতাংশ। শহরের ৬০ শতাংশেরও বেশি নির্মাণ-অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে ১৫ আগস্ট জাপান আত্মসমর্পনের চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের শেষ বাঁশি তখন থেকেই বেজে ওঠে।

পৃথিবীর ইতিহাসে হিরোশিমা ও নাকাসাকি শহর দুটিই দূর্ভাগ্যক্রমে প্রথম দুটি শহর যেখানে পরমাণু হামলা চলানো হলো। এরপর থেকে প্রতি বছর শহরের বাসিন্দারা হিরোশিমা শান্তি পার্ক ও নাকাসাকি বোমা বিস্ফোরণ স্মরণ কেন্দ্রে গিয়ে নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যেমে এই দিনটিকে স্মরণ করে থাকে । এ সময়ে সকল মানুষ বিশ্ব থেকে পরমাণু অস্ত্র বিলোপ করা এবং বিশ্বের শান্তি বাস্তবায়ন করার আহ্বানও জানায়। অন্যদিকে এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী পরমানু গবেষণা কেন্দ্রের "ম্যানহাটন পরিকল্পনা" ঘাটির সৃষ্ট "ছেলে" ও "মোটা মানুষ" নামে আণবিক বোমার জন্মস্থাটি—পর্যটকের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।

ক: অবশ্য, এই ধরনের পর্যটন ভ্রমণ স্থানীয় সরকারের জন্য খুব ভালো মুনাফা এনে দিয়েছে। একজন বিদেশি পর্যটকের চেরনোবিল পরমাণু বিদ্যুত্ কেন্দ্র পরিদর্শন করতে ১৫০ মার্কিন ডলার লাগবে। আরো বেশি জায়গা দেখতে চাইলে আরো বেশি টাকা লাগবে। ইউক্রেন সরকার বিশ্বাস করে, মানুষ পরমাণুর বিষয় সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। এটি এখন একটি শিল্প যা সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও সহায়তা করছে।

কিন্তু মুনাফাই সব কথা নয়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের উচিত পর্যটকদের নিরাপত্তা সু-নিশ্চিত করা, এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অবশ্য, এমন জায়গা ভ্রমণ করার মাধ্যমে লোকজন পরমাণু অস্ত্রের ভয়াবহতা বা পরমাণু এ বিষয় সম্বন্ধে আরো বেশি জানতে পারবে, তা জনগণের মাঝে বিশ্বের শান্তি বাস্তবায়নে পরমাণু অস্ত্র মুক্তকরণের চেতনাকেও জোরদার করে তুলবে। এটি পরমানু পর্যটনের একটি ভালোর দিক। তবে চেতনার চেয়ে নিশ্চয়ই সুস্থ্য জীবনটাই সর্বাগ্রে তাই না? তাই যদি আপনি সেখানে ভ্রমন করতে যান সব কিছুর আগে নিজের নিরাপত্তাকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিন।

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক