Web bengali.cri.cn   
রাশিয়ায় দুর্নীতির অবস্থা এবং পুতিন ও তার সরকার দুর্নীতি দমনের ব্যবস্থা
  2013-04-22 16:52:15  cri

সম্প্রতি বিশ্বের বেসরকারি দুর্নীতি দমন সংস্থা 'ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল' ২০১২ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দূর্নীতির অবস্থান বিষয়ক একটি সূচক প্রকাশ করেছে। এই সূচকে ১৮২টি দেশের মধ্যে রাশিয়ার অবস্থান ১৪৩তে। যার অর্থ হচ্ছে আফ্রিকার অনুন্নত দেশের চেয়েও রাশিয়ার দূর্নীতির অবস্থা খারাপ। রাশিয়া শুধু লিবিয়া, ইরাক, সোমালির চেয়ে কিছুটা ভাল অবস্থানে আছে।

এ বিষয়ে রুশ জনগণও এই বিষয়টি নিয়ে বেশ হাসি-ঠাড্ডা করে থাকে- একটি বেশ মজার কৌতুক আছে এরমকম যে, প্রতি বছর দুর্নীতির সূচকে রাশিয়ার অবস্থান নিচের দিকে অবস্থান করে, কিন্তু এ বছর দূর্নীতিমূক্ত প্রথম দশটি দেশের তালিকায় রাশিয়ার নাম। বলো তো এর কারণ কি? শ্রোতারা, আপনারা জানেন এর কারণ? এর কারণ, রুশ কর্মকর্তারা খোদ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালকেই ঘুষ প্রদান করার কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছে।

আর এ থেকে বোঝা যায় সাধারণ জনগণও সেদেশের দুর্নীতির অবস্থা যে ভয়াবহ তা অনুধাবন করতে পারছে। তাহলে প্রথমই আমরা্ রাশিয়ার দুর্নীতির অবস্থা যে কতটা ভয়াবহ, সে বিষয়ে কিছুটা ধারণা পেতে পারি। রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মেদভেদেভ ধারণা পোষণ করেন যে, দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সহযোগিতা করে প্রতি বছর দেশের প্রায় ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সম্পদ চুরি করে থাকে। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, বিশ্লেষকদের মতে, প্রতি বছর রাশিয়া দুর্নীতি দমনের জন্য প্রায় ৩৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করে থাকে। এর মানে হচ্ছে রাশিয়ার সরকারি কর্মকর্তারা প্রতিদিন জনগণের পকেট থেকে প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার চুরি করে।

২০১১ সালে রাশিয়ার স্বারাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও দুর্নীতি দমন ব্যুরোর প্রকাশিত এক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, রাশিয়ার সরকারি কর্মকর্তাদের গ্রহণ করা ঘুষের গড় হার প্রায় ৩ লাখ রুবল । এ সংখ্যা ২০১০ সালে কত ছিল? ৬১ হাজার রুবল। সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে, সেদেশে বিগত দুই/তিন বছরের মধ্যে দুর্নীতির অবস্থা কতটা অবনতি হয়েছে। তুমি জানো কি, কোন কোন পদের কর্মকর্তারা সবচেয়ে বেশি এবং সহজেই ঘুষ নিয়ে থাকে? সবচেয়ে বেশি দূর্নীতিগ্রস্থ হচ্ছে সরকারি ক্রয় বিষয়ক কর্মকর্তারা। জানা যায় তারা এই ঘুষের অর্থ বিদেশের ব্যাংকে আমানত করে থাকে।

উপরক্ত পরিসংখ্যান শুনে আপনার অবাক হয়েছেন নিশ্চয়ই? কিন্তু আরো আতংকিত হবার মতো পরিসংখ্যান রয়েছে। রাশিয়ার তথ্য মাধ্যমের খবরে প্রকাশ, দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারা প্রতিবার গড়ে প্রায় ২৭ হাজার রুবল ঘুষ নিয়ে থাকে। এটা গত তিন বছরের তুলনায় ৩ গুণ বেশি। বর্তমানে প্রতিবছর দুর্নীতি সম্পর্কিত মামলা প্রায় ৪৯ হাজারে দাঁড়িয়েছে। প্রিয় শ্রোতা, সহজেই অনুমান করতে পারেন যে, যদি দূর্নীতির দায়ে মামলার সংখ্যা ৪৯ হাজারেরও বেশি হয়ে থাকে, তবে সেদেশের সরকারী কর্মকর্তার সংখ্যাই বা কত হতে পরে? কি ভয়ংকর ব্যপার, তাই না? আরও ভয়ংকর হচ্ছে এই সংখ্যা গত তিন বছরের তুলনায় ২৬ শতাংশ বেড়েছে। এসব মামলার মধ্যে ৩৫ হাজার ফৌজদারি আইন লঙ্খন করেছে। বোঝাই যাচ্ছে দূর্নীতি পরিস্থিতি কতটা গুরুতর অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে। রাশিয়ার আইন বিভাগের কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দেশের ৮০ শতাংশেরও বেশি কর্মকর্তা দুর্নীতিগ্রস্ত। বুঝতে পরো দূর্নীতি হার কত উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। দুর্নীতির কারনে শুধু জনগণের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা নয়, বরং তা দেশের ক্ষমতাসীন দলের সুনামও নষ্ট করেছে। ২০১১ সাল থেকে বিরোধী দল জনসমাবেশের মাধ্যমে বার বার "ক্ষমতাসীন দলের দুর্নীতির ভয়াল চিত্র" তুলে ধরেছে।

এ কারণেই তৃতীয় বারের মত প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে পুতিন অবশেষে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে দুর্নীতি দমনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

রাশিয়ার এক ধরনের গাড়িতে বিশেষ নম্বর প্লেট আর লাগায়, গাড়ির সামনে জাতীয় পতাকা লাগানো হয়। আবার কিছু কিছু গাড়ির উপরে সংকেত বাতি বা এ্যলার্ম ল্যাম্পও আছে। এধরনের গাড়িকে "বিশেষ গাড়ি" হিসেবে বলা যায়। কেননা এধরনের গাড়ি সড়ক যোগাযোগের কোনো নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য নয়, ইচ্ছে করে যে কোনোভাবে চালাতে পারে। এগুলো সাধারণত রাশিয়ার উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের গাড়ি। মাঝে মাঝে ব্যবসায়ীরাও অনেক টাকা ঘুষ দিয়ে এ ধরনের গাড়ি ভাড়া করে ব্যবহার করে থাকে। কারণ গাড়ির উপরে আলার্ম ল্যাম্প থাকায় সড়ক যোগাযোগের সকল নিয়ম লঙ্খন করতে পারে এবং এ জন্য কোনো শাস্তিরও বিধান নেই।

এমন বিশেষ অধিকারের গাড়ির খবর শুনে আপনাদের কেমন অনুভূতি হচ্ছে? ইচ্ছে হয় এমন কোনো গাড়ির মালিক হতে? সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ সকল গাড়ির অনিয়ন্ত্রিত চলাচলের কারনে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক বেড়ে গেছে। স্বাভাবিক ভাবেই রুশ জনগণ এর প্রতিবাদে ক্ষোভ প্রকাশ করে চলছে প্রতিনিয়ত। ফলে পুতিনের দুর্নীতি দমনের ব্যবস্থার অন্যতম একটি হচ্ছে এই সকল "বিশেষ গাড়ির" সংখ্যা কমানো। যাতে জনগণের প্রতিবাদের প্রতি ইতিবাচক সাড়া দেয়া যায়। ২০১২ সালে পুতিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ব্যাপকভাবে বিশেষ গাড়ির সংখ্যা কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ১৯ মে প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষরিত নির্দেশের মাধ্যমে তিনি 'বিশেষ গাড়ির' সংখ্যা অর্ধেক করার ঘোষণা দিয়েছেন। এ নির্দেশ ১ জুলাই থেকে কার্যকর হয়। ফলে বর্তমানে মোট ৫৬৯টি গাড়ি রয়েছে যাতে আলার্ম ল্যাম্প ব্যবহার করতে পারে। এরআগে এ সংখ্যা ছিল ১০০০টি। প্রেসিডেন্টের নির্দেশে বলা হয়েছে: শুধু দেশের নিরাপত্তা ব্যুরোর নিরাপত্তা বিষয়ক কর্মকর্তা এবং দেশের নিরাপত্তা রক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণকারীদের গাড়িতে‌ই আলার্ম ল্যাম্প লাগানো যাবে।

পুতিন সরকারের নেয়া আরেকটি কঠোর পদ্ধতি হল দুর্নীতি দমন ব্যবস্থাকে আরো কঠোর করা। ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর রাশিয়ার আইন প্রণয়ন সংস্থা—রাষ্ট্রীয় দুমায় একটি আইন পাশ করা হয়েছে। এ আইনের প্রধান বিষয় হল: সরকারি কর্মকর্তা এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকে নির্দিষ্ট একটি সময়ের মধ্যে বিদেশে কোথাও কোনো সম্পদ অর্জন বা আমান করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ সম্পদ বলতে মূলত রিয়েল এস্টেট এবং ব্যাংকের আমানতকৃত অর্থকে বোঝানো হয়েছে। নির্ধারিত সময় অর্থাত্ তিনি যতদিন সরকারি কর্মকর্তা দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবেন এবং পদত্যাগ বা অবসরের পরের তিন বছর সময়কাল হচ্ছে এই আইনের জন্য প্রোযোজ্য। এ সময়ে আইন লঙ্খন করলে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি রুবল জরিমানা দিতে হবে। অথবা সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদন্ড ভোগ করতে হবে এবং কারাবাসের পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে সরকারী কোনো কাজ বা দায়িত্ব গ্রহণে অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।

২০১৩ সাল থেকে রাশিয়ার সরকারি কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারের সদস্য যদি রিয়েল এস্টেট, ভূমি, গাড়ি, শেয়ার কিনতে চায়, এবং যদি এর মূল্য পরিবারের গত তিন বছরের মোট আয় ছাড়িয়ে যায়, সেক্ষেত্রে সরকারের কাছে জানাতে হবে এবং এই অতিরিক্ত অর্থের উত্স সম্পর্কে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে। এই বিষয়ক যাবতীয় তথ্য সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগের ওয়েবসাইটে সবা'র জন্য উন্মুক্তভাবে প্রকাশিত হবে। আসলে ২০০৮ সালে রাশিয়ায় "দুর্নীতি দমন আইন" জারি করা হয়। আশা করা হচ্ছে এ দু'টি আইন মিলে দেশের দুর্নীতির পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরতে বড় ভূমিকা পালন করতে পারবে। আর এই "দুর্নীতি দমন আইনের" খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হচ্ছে ২০১০ সাল থেকে সরকারি কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের বেতন, রিয়েল এস্টেট অবস্থা এবং ব্যাংকের আমানতকৃত টাকা নিয়মিতভাবে সরকারের কাছে জানাতে হয় এবং এ তথ্য সবার জন্য উন্মক্ত থাকবে। হয়তো এভাবেই কর্মকর্তাদের সীমাহীন দূর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।

এ ছাড়া তথ্য মাধ্যমের ব্যাপক অংশগ্রহণও এক্ষেত্রে ব্যাপক ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। কেননা একবার যদি তথ্য মাধ্যমে কোনো কর্মকর্তাদের দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়, তা অন্যদের জন্যও বিশেষ সতর্ক সংকেত হিসেবে দেখা যায়।

বিভিন্ন দেশের সরকার দুর্নীতি দমনের জন্য নিশ্চয়ই কার্যকর আইন প্রণয়ন করেছে। তবে আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আইন প্রণয়নের চেয়ে, কার্যকর এবং কঠোরভাবে এসব আইন বাস্তবায়ন এবং মেনে চলা।

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক