চীনের ঐতিহ্যবাহী নববর্ষের তৃতীয় দিনে সিছুয়ান প্রদেশের লিংশুই জেলার থিয়েটারে ছুয়ান অপেরার হৃদয় দোলানো অর্কেস্ট্রা বাদন আর ঢোলের মনমাতানো তাল বিপুল সংখ্যক দর্শকদের বিমোহিত করে তোলে। হরেক রকম বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গঠিত দলের চমত্কার সুরেলা পরিবেশনা দিয়ে লিংশুই ছুয়ার অপেরা ক্লাবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উদ্বোধন হয়।
আপনি জেনে বিস্মিত হবেন যে, এই অপেরা দলের ৩১ জন সদস্যদের মধ্যে ১৪ জনের পেশাগত ভাবে অপেরা'র শিল্পী নয় অর্থাত্ তাঁরা অপেশাদার বা সখের শিল্পী।
আমাদের প্রতিবেদক সম্প্রতি সিছুয়ান ও চিয়াং সু প্রদেশে ভ্রমনের অভিজ্ঞতায় লক্ষ্য করেছেন, বর্তমানে গ্রামবাসীরা টিভি আর ফিল্ম দেখেই কেবল সময় উপভোগ করেন তা নয়। বরং এ সব অঞ্চলের প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী অথচ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা সকল চাইনিজ অপেরা যেমন,- ছুয়ান অপেরা, হুয়াইহাই অপেরা ও সি অপেরাসহ বিভিন্ন দল সংগঠিত হয়ে পূনরায় অপেরা পরিবেশন করেছে। আর পরিবারের সবাই মিলে চীনের ঐতিহ্যবাহী এসকল অপেরার সুর-ছন্দ-শৈলী উপভোগ করাও বর্তমান সময়ের নববর্ষ উদযাপনের একটি রীতিতে পরিণত হয়েছে।
চীনের চিয়ান সু প্রদেশের জেং চিয়াং জেলায় কৃষকদের পরিচালনা ও পরিবেশনায় একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। নববর্ষের দ্বিতীয় দিনের দুপুর একটায়, জেং চিয়াং জেলার উত্তরে লিউ সিয়াং গ্রামের শিশু থেকে বৃদ্ধ সকল বয়সের মানুষ গ্রামের প্রবেশ পথের খোলা চত্ত্বরে জমায়েত হয়ে বিখ্যাত সি অপেরার 'ছিয়াও মাই চি' অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।
"ছিয়াও মাই চি অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন একটি অপেরা কিন্তু এর বিষয়বস্তু সমাজ-মানসে গভীর রেখাপাত করে। ৬৮ বছর বয়সী লিউ জেং অ একজন অপেরা অনুরাগী দর্শক। তিনি আমাদের প্রতিবেদককে এ অপেরার গল্প ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানান ব্যাখা করেন- এক দম্পতি ছিল যারা তাঁদের দাম্পত্য জীবনের ৬০ বছর উদযাপন উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠান আয়োজন করেন আর সেখানে তাদের তিন কন্যাকে নিমন্ত্রণ করা হয়। নিমন্ত্রণ পেয়ে তাঁদের বড় ও মেঝো মেয়ে বাবা-মায়ের জন্য বেশ দামি ও ভারী ভারী বেশ কিছু উপহার নিয়ে আসে। কিন্তু ছোট মেয়ের অর্থকষ্ট ছিল বেশ। তাই তারা দামি কোনো উপহার দিতে পারলো না বরং উপহার হিসেবে তাঁরা তাদের ঘরে থাকা এক প্যাকেট ছিয়াও মাই পাউডার নিয়ে আসে। তাই বৃদ্ধ দম্পতি ছোট মেয়ে ও তাঁর জামাইকে বিশেষ একটা গুরুত্ব না দিয়ে দামি উপহারের কারনে বড় ও মেঝো মেয়েকেই বেশি আদর-যত্ন করতে থাকলেন। এরপর ঘটনাক্রমে ছোট মেয়ের জামাই ভালো একটি প্রতিষ্ঠানের উচ্চ কমকর্তা হিসেব নির্বাচিত হন। আর অন্যদিকে আকস্মিক দুর্ঘটনার কারণে কারনে বৃদ্ধ দম্পতি গৃহহারা হয়ে পড়েন। তখন তাঁরা বড় ও মেঝো মেয়ের আশ্রয় চাইলে তাঁরা এই দম্পতিকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। তাদের এই দূর্দশায় কিন্তু ছোট মেয়ে চুপ করে থাকতে পারলো না বরং কোনো কথা না বলেই পিতা-মাতা বাসায় আশ্রয় দেয়।
বৃদ্ধ লিউ বলেন, এ অপেরা থেকে এটাই প্রতিফলিত হয় যে, ধনীর প্রতি ভালোবাসা থাকলেও গরিবকে কখনোই অবহেলা করা ঠিক নয়।
এ বেসরকারী অপেরা দলটি ৫ বছরের আগে সংগঠিত হয়েছে। ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে স্থানীয় বেশ কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মকর্তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অপেরা অনুরাগী বেশ কয়েকজন কৃষক নিয়ে গড়ে তোলা হয় এ দল সি অপেরা। স্থানীয় সরকার ও প্রতিষ্ঠান এ দলটিকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবে যথেষ্ট সমর্থন প্রদান করে আসছে। তাদের ভ্রাম্যমান মঞ্চ, পোশাক, সাজসরঞ্জাম এবং প্রয়োজনীয় বাদ্যযন্ত্র সরবরাহ করেছে। এ পর্যন্ত কৃষকদের নিয়ে গঠিত অপেশাদার এই অপেরা দলটি ৩০০ এর বেশি পরিবেশনা করেছে। আর প্রায় ২ লাখের বেশি দর্শক এই অপেরা উপভোগ করেছে। তার মানে হচ্ছে স্থানীয় সরকার এবং অপেরা দলের যৌথ প্রচেষ্টায় ঐতিহ্যবাহী এই চীনা অপেরা স্থানীয় জনগন আর কৃষকদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছে।
আমাদের প্রতিবেদকের উপলব্ধি এমন যে, পেশাদার দলের তুলনায় অপেশাদার এই অপেরা দলের পরিবেশনায় যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে, যেমন- তাঁরা প্রায়শই গল্পের লাইন বা অপেরার শব্দ ভুলে যায়, ইত্যাদি। কিন্তু সে সব ত্রুঁটি থাকা সত্ত্বেও দর্শকরা খোলা মঞ্চে বাতাসের তীব্র শীত উপেক্ষা করেও যে গভীর আগ্রহ, উদ্দীপনা আর মনোযোগ দিয়ে অপেরা উপভোগের রীতি প্রচলন করেছেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। প্রতিবেদকের মতে, চীনের ঐতিহ্যবাহী রীতিনীতি এবং দৈনন্দিন জীবন-যাপনই মূলত সে সব অপেরার প্রাণ আর উদ্দমতা সৃষ্টি করে।
নববর্ষের তৃতীয় দিনে "অবাধ্য ছেলে ও সুবোধ নাতি" শিরোনামে হুই হাই অপেরা চিয়াং সু প্রদেশের মু ইয়াং জেলার টুয়ান জুয়াং গ্রামে পরিবেশিত হয়। গ্রামটির শতাধিক বাসিন্দারা তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে এ অপেরা উপভোগ করেন। গ্রামের একজন অপেরা ভক্ত সু ওয়েন চি-এর মতে, হুয়াই হাই হচ্ছে এমন একটি অপেরা যা তাদের জেলার সকল বাসিন্দাদের কাছে বেইচিং অপেরার সমতুল্য। হুয়াই হাই অপেরা মূলত তাদেরই বাস্তব জীবনের প্রতিফলন তুলে ধরে থাকে।
সু ওয়েন চি আরও বলেন, তিনি এবার ৫ হাজার ইউয়ান খরচ করে এই অপেরা দলটিকে বায়না করেছেন।
বর্তমানে প্রায় সকল গ্রামবাসীর রয়েছ টেলিভিশন, কম্পিউটারসহ আধুনিক যন্ত্র যা দিয়ে তারা হরেক রকম বিনোদন উপভোগ করতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই নববর্ষে ঐতিহ্যিবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উদযাপন আর উপভোগ করাটা যেন একটি রীতিতে পরিণত হয়েছে। মু ইয়াং জেয়ার হুয়াই হাই অপেরা দলের নেত্রী ওয়াং মেই চুয়ান এ কথা বলেছেন। বাজারের প্রচুর চাহিদা মেটাতে তারা দলের বায়না বাবদ ৩৫০০ থেকে ৫০০০ ইউয়ান ধার্য করেছেন। কিন্তু তারপরও বাজারের চাহিদা মেটাতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এভাবেই চীনা নববর্ষের উত্সব উদযাপনে ঐতিহ্যবাহী চাইনিজ অপেরা উপভোগ করাটা একটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।