Web bengali.cri.cn   
নেপালি ব্যবসায়ী ও তার ক্যাশবাক্স
  2013-01-18 16:31:41  cri
এটা একটা সাধারণ কাঠের বাক্স। আকার আমাদের বাসার আগেকার পোশাক রাখা বাক্সের মতো। বাক্সের ওপর তেমন নকশা বা রং নেই। তবে বিশেষ ব্যাপার হচ্ছে বাক্সের ঢাকনার ডান ও বাম দু'দিকে দুটি আয়তাকার ছিদ্র আছে। তাহলে বাক্সটি কিভাবে ব্যবহার করা হয়? এ বাক্সটি ও তার মালিকের পরিবার চীন ও নেপালের মধ্যে অর্ধ শতাব্দীর বন্ধুত্বপূর্ণ আদান-প্রদান প্রত্যক্ষ করেছে।

দিপু হচ্ছেন বাক্সটির মালিক। তিনি চীনের তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের আলি এলাকার পুলান জেলার নেপালি ব্যবসায়ী। আমাদের সংবাদদাতা যখন দিপুর দোকানে আসেন, তখন তিনি বাক্সের পিছনে বসে অনর্গল তিব্বতী ভাষায় স্থানীয় মানুষের সঙ্গে দর-কষাকষি করছিলেন।

সংবাদদাতার প্রশ্নের পর দিপু তার সামনে সে 'রহস্যময়' বাক্সটি খোলেন।

(রি-১)

বাক্সের ওপরের স্তরে এলোমেলো জাফরি। সেখানে রয়েছে কিছু খুচরো পয়সা। দিপু সংবাদদাতাকে বাক্সটির গল্প বলতে শুরু করেন। আসলে কাঠের এই বাক্সটি হচ্ছে দিপুর ক্যাশবাক্স। এই 'টাকার বাক্স' এবং দিপু ও তার বাবা চীনের তিব্বতকে দেখেছে অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে। তিনি বলেন,

(রি-২)

"বাক্সের ওপর ছিদ্র দু'টি আমার বাবার তৈরি করা। বাক্সটি না খুলেই এ ছিদ্র দিয়ে মুদ্রা ফেলা যায় তাতে। বাক্সটি খুবই পুরনো। আমার কাছে এটা খুবই মূল্যবান। আমি সবসময় এটা ব্যবহার করি। আমার আগে আমার বাবা এটা সবসময় ব্যবহার করতেন। আমার বাবা অনেক আগে বাক্সটি নেপাল থেকে নিয়ে এসেছিলেন। চীনে ব্যবসা করার সময় তিনি এটা ব্যবহার করতেন। তখন থেকে তিনি বাক্সটি চীনে রেখে দেন।"

পুলান জেলা তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের আলি অঞ্চলে দক্ষিণে অবস্থিত। এটি নেপাল ও ভারতের সঙ্গে সংলগ্ন। তিনটি দেশের ব্যবসায়ীদের পুলানে সীমান্ত বাণিজ্য করার ইতিহাস ৫শ' বছরেরও বেশি সময়ের। বর্তমানে পুলান সীমান্ত বাণিজ্য-বাজার এসব ব্যবসায়ীদের জন্য দোকানের ব্যবস্থা করে, যাতে তাঁরা এখানে নেপাল ও ভারতের বৈশিষ্ট্যময় পণ্য বিক্রি করতে পারেন। প্রতি বছরের গ্রীষ্ম ও শরত্কালে নেপালি ব্যবসায়ীরা পুলান 'আন্তর্জাতিক বাজারে' ব্যবসা করতে আসেন। গ্রীষ্মকালে তাঁরা ফরাসি সুগন্ধি ও ভারতীয় ধূপ নিয়ে আসেন এবং এখান দিয়ে চীনে প্রবেশ করেন। শীতকালের আগে আবার এখান থেকে কেনা জিনিসপত্রগুলি নেপালে নিয়ে যান।

দিপু জানান, চলতি বছর তার বয়স হয়েছে ৫০ বছর। ছোটবেলা থেকে তার বাবা চীন ও নেপালের সীমান্ত বাণিজ্য শুরু করেন। পরিবারের প্রভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পাস করার পর তিনি পুলানে এসে সীমান্তে যোগ দেন। তিনি বলেন,

(রি-৩)

"আমার বাবা অনেক আগে থেকে পুলানে ব্যবসা করতেন। ৩০ বছর আগে তিনি পুলানে মারা যান। তারপর আমার বড় ভাই বাবার ব্যবসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এখন আমি। ১৯৮৫ সালে আমি প্রথমবারের মতো পুলানে আসি। আমার স্ত্রী এখন নেপালে আছে। তার দায়িত্ব হচ্ছে সেখান থেকে এখানে মালামাল পাঠানো। আমার সন্তানরা এখনও ছোট। পরিবারে মানুষ দরকার।"

দিপুর জন্মস্থান নেপালের দারচুলা জেলার উত্তরে লিপুপাস নামের একটি ছোট গ্রাম। জায়গাটি নেপালের সবচেয়ে উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত এবং চীন ও ভারতের সঙ্গে সংলগ্ন। সেটা হচ্ছে নেপালের উচ্চপর্বত অঞ্চলে অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এ অঞ্চলের গড় উচ্চতা ৫ হাজার মিটারেরও বেশি। তাপমাত্রা সারা বছরই কম থাকে। দারছুলা জেলার উত্তরাঞ্চলের লিপুপাস গ্রাম থেকে পুলান পর্যন্ত পথ খুবই দুর্গম। হিমালয় পর্বত ডিঙ্গিয়ে সেখানে যেতে হয়। কোনো কোনো জায়গার তুষার সারা বছরেও গলে যায় না। সেখানে মনুষ্য বসতি খুব কম। পরিবেশ ভীষণ ভয়ানক। দিপুর বাবা যখন চীন ও নেপালের মধ্যে ব্যবসা করতেন, তখন লিপুপাস থেকে পুলানে যেতে প্রায় ৫ দিন সময় লাগত। যদিও পরিবহন সমস্যা এখনও দিপুর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, তবে চীনের তিব্বতের পিচঢালা রাস্তা চালু হওয়ায় সমস্যাটির অনেকখানি সমাধান হয়েছে। দিপু বলেন, এখন তার জন্মস্থান লিপুপাস থেকে পুলান জেলায় যেতে মাত্র দু'দিন লাগে। তিনি বলেন,

(রি-৪)

"আগে খুবই কষ্টকর ছিল। এখন আগের চেয়ে অনেক ভাল, অনেক সুবিধা। আমরা ঘোড়া ও খচ্চর দিয়ে ধাপে ধাপে নেপাল থেকে মালামাল সীমান্ত এলাকায় আনি। প্রক্রিয়াটি যদিও কষ্টকর, তবুও ব্যবসাটা আমার ত্যাগ করার ইচ্ছা ছিল না। কারণ এটা হচ্ছে আমার পরিবারের ঐতিহ্য।"

দিপু সর্বশেষ ২০১২ সালের জুন মাসে পুলানে আসেন। তিনি নভেম্বর মাসে ভারত ও নেপালে ফিরে মালামাল কেনার পরিকল্পনা করেছেন। তিনি বলেন, তিনি পুলানকে খুব পছন্দ করেন। এখানকার আবহাওয়া ভাল, ব্যবসাও ভাল। এছাড়া চীন সরকার বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধার নীতি প্রণয়ন করেছে। যেমন, তার দোকানের মাসিক ভাড়া মাত্র ১শ' ইউয়ান। তাকে কর দিতে হয় না। পাশাপাশি খাওয়া ও থাকার বন্দোবস্তও করা হয়। শীতকাল এলে তিনি সব মালামাল দোকানে রেখে ভারত ও নেপালে নতুন মালামাল কিনতে যান। তিনি বলেন,

(রি-৫)

"আমাদের বাসস্থানের অবস্থা ভাল। আমার বাসস্থানে শয়নকক্ষ, রান্নাঘর ও টয়লেট আছে। মোট ৫ বা ৬টি ঘর। আমি মাঝেমাঝে এখানে নেপালি খাবার খাই, মাঝেমাঝে চীনা খাবার খাই। আমার এখানে রান্নাঘর আছে। এছাড়া রান্না করার লোকও আছে। নেপালি খাবার রান্নার জন্য দরকার সব মশলা এখানে পাওয়া যায়। যেমন চাল, লবণ, তেল, শাক-সবজি ইত্যাদি। আগে যেগুলো পাওয়া যেত না, এখন সেগুলোও পাওয়া যায়।

দিপু বলেন, পুলান জেলার সব মানুষ তাকে চেনে। সেখানে তিনি অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছেন। গুরু হচ্ছেন তাদের মধ্যে একজন। দিপুর পরিবারের সঙ্গে ৫৭ বছর বয়সী তিব্বতি জাতির এ ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য বন্ধন রয়েছে। দিপুর বাবা যখন চীনে ব্যবসা করতেন, তখন গুরুর বাবা তার মালামাল বহন করতেন। পরে দিপু যখন বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে পুলানে আসেন, তখন গুরু তিব্বতি ভাষার অনুবাদক হিসেবে তাকে সাহায্য করেন। সে সময় গুরুর পরিবার খুব দরিদ্র ছিল। দিপু সবসময় তার কাছে বাকিতে জিনিসপত্র বিক্রি করেন। এ যোগাযোগের প্রক্রিয়ায় দিপু ও গুরুর মধ্যে ক্রমে ক্রমে তাদের বাবাদের মতো গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। গুরু বলেন,

(রি-৬)

"দিপু একজন সুখ্যাতিওয়ালা মানুষ। কেউ কেউ আজ হয়তো এক দামে জিনিস বিক্রি করবে আবার কালকে দাম বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু দিপু কখনও এরকম করেন না। আমি যখন জিনিস কিনি, আগেই তাকে ফোন করি। তিনি জিনিসপত্র প্রস্তুত করে রাখেন এবং কখনও ভুল করেন না।"

দিপু জানান, চীনে বসবাস করতে তার খুব ভাল লাগে। যখন ব্যবসার মওসুম থাকে না, তখন তিনি পুলান জেলার পূর্বাঞ্চলের পবিত্র কাংরিনবোছে পাহাড়ে বেড়াতে যান। স্থানীয় অধিবাসীরা দিপুকে সবসময় বিয়ের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানান। তিনি বলেন,

(রি-৭)

"আমি সত্যি চীনকে ভালোবাসি। আমি মনে করি, তিব্বতি জাতিসহ সকল চীনা মানুষ ভাল। তাঁদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভাল। যদিও আমি সীমান্ত এলাকায় থাকি, তবুও আমার জীবনযাত্রার মান ভাল। কোন কষ্ট নেই।"

কথা বলতে বলতে দিপু সংবাদদাতাকে মোবাইল ফোনে একটি ছবি দেখান। ছবিতে দেখা যায় দিপু, তার স্ত্রী, দু' মেয়ে ও এক ছেলেকে। পরিবারটি খুবই সুখী। তার প্রত্যাশা ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে দিপু বলেন,

(রি-৮)

"এখন চীন ও নেপালের সম্পর্ক খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ। আশা করি, আমার ব্যবসাও দিন দিন বৃদ্ধি পাবে। ছেলে পড়াশোনা শেষ করার পর আমি তাকে চীনা ভাষা শিখাবো। কারণ চীনাদের সঙ্গে ব্যবসা করা খুবই ভাল। আমি তাকে শাংহাইয়ে লেখাপড়া করতে পাঠাবো। সে ভবিষ্যতে আমার ব্যবসা উত্তরাধিকার করবে বলে আশা করি।"

আমাদের সাংবাদিক যখন কথা বলছিলেন, তখন দিপুর দোকানে অনেক ক্রেতা আসেন।

(রি-৯)

একবার পণ্য বিক্রি করেন তিনি।

(রি-১০)

দিপু হাসিমুখে গভীর আবেগের সঙ্গে তার 'টাকার বাক্সে' হাত বুলিয়ে বলেন,

(রি-১১)

"এখন আমি এটা ব্যবহার করছি। ভবিষ্যতও এটা বিক্রি করবো না। আমি আমার ছেলেকে এটা দিয়ে যাবো। ভবিষ্যতে আমার ছেলেও এটা ব্যবহার করবে। অন্য জিনিস পরিবর্তিত হবে, কিন্তু এটা অপরিবর্তিত থাকবে।"

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক