Web bengali.cri.cn   
 চীনের ইতিহাসের প্রথম কৃষক বিদ্রোহী
  2012-12-04 17:07:23  cri
চীনের ইতিহাসে বেশ কয়েক বার কৃষক বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে। কিন্তু ছেন সেন ও উ কুয়াংয়ের নেতৃত্বে কৃষক বিদ্রোহের আকার সবচেয়ে বড়। পরে তারা দু'জন যুদ্ধে মারা গেছে। কিন্তু কৃষক বিদ্রোহের আগুন ক্রমেই দাউ দাউ হয়ে উঠল। অবশেষে ছিং রাজবংশ উতখাত করা হল।

চীনের ইতিহাসের প্রথম রাজা ছিল ছিংসিহুওয়াং। তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল চীনকে একীকরণ করা । তার শাসনে তখনকার সমাজে অনেক অগ্রগতি অর্জিত হয়। কিন্তু তখন রাজদরবার ও স্থানীয় কর্মকর্তারা অত্যন্ত দুর্নীতিপরয়ন হয়ে উঠেছে। এ সব কর্মকর্তাদের পৌষণে জনসাধারণের জীবন অত্যন্ত কস্ট ছিল। এক দিন ছেন সেন ও তার কয়েকজন সঙ্গীরা ফসল ক্ষেত্রে কাজ করছিলেন। কাঠ ফাঁটা রোদে সবাই ঘামে নেয়ে যায়। তাদের মধ্যে দু'জন অবসন্ন হয়ে মাটির ওপর পড়ে গেল। ছেন সেন বিশ্রাম নেয়ার জন্য মাটিতে বসলেন। ঠিক সেই সময় একটি ছোট পাখি তাদের উপর পার হয়ে গেল। পাখিকে অবাধভাবে মাথার উপর উড়ছে দেখে ছেন সেন মনে মনে ভাবলেন: ' পাখির সঙ্গে আমার তুলনা করা যায় না। তার চেয়ে আমার জীবন অনেক কঠিন। কবে আমি পাখির মতো স্বাধীন হতে পারবো?' সেই সময় অন্যরাও অভিযোগ করতে শুরু করেন। সবই বলল, তাদের জীবন অত্যন্ত শোচনীয় । সবাই রাজদরবার ও স্থানীয় কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কথা অভিযোগ করতে শুরু করল। কিছু ক্ষণ পর ছেন সেন দাঁড়িয়ে সবাইকে বললেন: ' আমরা দিন রাত গরু ও ঘোড়ার মতো পরিশ্রম করছি। কিন্তু কর্মকতার্রা আমাদের ওপর নিষ্ঠুরভাবে পোষণ করছে। তারা এত দুর্নীতিপরায়ন হয়ে উঠেছে তাতে আমরা সহ্য করতে পারি না।একটু আগে তোমরা হয়তো একটি পাখি দেখেছ। এই পাখি কত অবাধ। আমরা তার মতো হতে চাইলে দুর্নীতিপরায়ন রাজদরবারের সঙ্গে লড়াই করতে হবে।' তার এ সব কথা শুনে উপস্থিত সবাই হাততালি দিল। তারা বুঝতে পার যে, ছেন সেনের মনে উচ্চাভিলাষ আছে। তিনি জনসাধারণের জন্য কল্যাণকর কাজ করতে চান।

ছিংসিহুয়াং মারা যাওয়ার পর তার ছোট ছেলে হুহেই রাজা হলেন। এই রাজা যেমন একজন অক্ষম তেমনি একজন লোভি মানুষ। কৃষকদের ওপর তার পোষণ আরও নিষ্ঠুর হয়ে গেল। এক বছর রাজার নির্দেশে দেশের বিভিন্ন জায়গায় শ্রমজীর্বিকে সংগ্রহ করা হয়। বিভিন্ন জায়গায় পরিশ্রম কাজে যোগ দেওয়ার জন্য এ সব শ্রমজীবিকে সংগ্রহ করা হয়। ছেন সেনের জন্মস্থান থেকেও অনেক লোককে সংগ্রহ করা হয়েছিল। ছেন সেন ও উ কুয়াং তাদের মধ্যে দু'জন ছিলেন। তারা দু'জন অন্যদের চাইতে সক্ষম বলে এ সব কুলির নেতা নির্বাচিত হন। তারা দু'জনের দায়িত্ব ছিল কুলিদের প্রতিদিনের কুঁটানাটি ব্যাপার ব্যবস্থাপনা করা।

সংগ্রহিত এ সব কুলি ইউয়ুইয়াং নামে একটি জায়গায় যেতে হত। পথে কয়েক শো কিলোমিটারের দূরত্ব। তখন জুলাই মাসে। অত্যন্ত গরম দিন । কিন্তু মাঝে মাঝে বড় বড় বৃষ্টি পড়ে। এক বার একটানা কয়েক দিন ধরে বৃষ্টি পড়ার ফলে বড় বন্যা হয়ে গেল। সব রাস্তা বন্যায় তলিয়ে গেল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ইউয়ুইয়াং জায়গায় পৌছতে হয়। কারণ ছিং রাজবংশের আইন অনুযায়ী , যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্ধারিত দিনে পৌছতে না পারা যায় তাহলে সকল কুলিকে মেরে ফেলা হবে। সবাই মহা চিন্তিত হয়ে পড়ল। অনেকেই বলল, ডানা গায়ে লাগানো হলে ইউয়ুইয়াংতে পৌছতে পারতো না। তাদের মধ্যে একজন বলল: ' আমরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্ধারিত জায়গায় পৌছতে পারবো না। এখন আমাদের কোন উপায় নেই। আমরা মৃত্যু অপেক্ষা করতে বাধ্য হয়। ' এই লোকের কথা অনেকের মনে দু:খ সৃষ্টি করেছে। কেউ কেউ নিজেদের বাবার কথা মনে পড়ল। কারণ তাদের বাবারা ছিং রাজবংশের প্রথম রাজা ছিংসিহুয়াংয়ের সমাধি নির্মানে মারা গেছে। কেউ কেউ তাদের বড় ভাইদের কথা মনে পড়ল। কারণ তাদের বড় ভাইরা রাজার প্রসাদ নির্মানে নির্যাতনে মারা গেছে। আবার কেউ কেউ তাদের নিজেদের ছেলের কথা মনে পড়ল। কারা তারা মহা প্রাচীর নির্মানে অতি শ্রমে মারা গেছে। সবাই এ সব দু:খের ঘটনা ভাবতে ভাবতে কেদে উঠল। এমন সময় হঠাত একজন যুবক উঠে দাঁড়িয়ে চিত্কার করল: ' তোমরা কেবল কেদছ কেন? কাদার কোন মনে আছে বল তো! আমার মনে হয়, আমরা মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা না করে অবিলম্বে পালিয়ে যাবো।' কিন্তু একজন বুরো লোক বলল: ' হবে না। কথাও পালিয়ে যেতে পারি? গ্রেফতার করার পর মেরে ফেলা হবে'। সকলের মন আবার ভারী হয়ে গেল। ছেন সেন তাদের কথা শুনে মনেও শান্তি ছিল না। তিনি পাশের উ কুয়াংর দিকে চোখের ইঙ্গিত দিলেন। তারা দু'জন নিকটবর্তী একটি ছোট নদীর পাশে গেলেন । ছেন সেন উ কুয়াংকে বললেন, ' সবাইয়ের জন্য একটি ভাল প্রস্তাব ভেবে চিন্তা করতে হবে।' উ কুয়াং বললেন, ' বতর্মান পরিস্থিতি অনুযায়ী আমাদের কোন পিছিয়ে যাওয়ার পথ নেই। আমি তোমার মতামত শুনতে চাই।' ছেন সেন বললেন, ' আমার মনে হয়, চল আমরা বিদ্রোহ করি। আমরা নিজেদের জীবনের জন্য সংগ্রাম করবো। যদি যুদ্ধে মারা যাই তাহলে মারার মূল্য আছে। তোমার আপত্তি আছে?' ' চমত্কার! আমরা দু'জনের মতামত একই। ' উ কুয়াং উত্তেজনার সঙ্গে উত্তর দিলেন। ছেন সেন আবার বললেন: ' গোটা দেশের জনসাধারণ ছিং রাজবংশের নিষ্ঠুর শাসন ঘৃণা করে আসছে। এখানে এক সময় ছু রাষ্ট্র ছিল। যদি আমরা ছিং রাজবংশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চাই তাহলে এখানকার জনসাধারণ অবশ্যই আমাদেরকে সমর্থন করবে।'

সেন দিন সরার রাতে তারা দু'জন জেগে ছিল। পরের দিন ছেন ও উ কুয়াং সবাইকে ডেকে পাঠালেন। তার পর উ কুয়াং উচু স্বরে বললেন: ' ভাই সব ইউয়ুইয়াং এখান থেকে আরও অনেক দূর। আমরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ওখানে পৌছতে পারবো না। বেঁচে থাকার জন্য তাড়াতাড়ি পালিযে যাও'। তখন তাদের মধ্যে মাত্র দু'জন রাজদরবারের সৈন্য ছিল। উ কুয়াংর কথা শুনে এ দু'জন সৈন্য চিত্কার করল: ' তোমাদের মধ্যে পালার সাহস কার আছে? সবাই হতভম্ব হয়ে উঠল। ঠিক সেই সময় ছেন সেন একজন সৈন্যের পিছন দিক থেকে তার হাতের তলোয়ার ছিনিয়ে লিলেন। তারপর তিনি সঙ্গে সঙ্গে এই সৈন্যকে তলোয়ার দিয়ে মেরে ফেললেন। আরেক জন সৈন্য সামনের ঘটনা বুঝে নেয়ার আগে ছেন সেন বিদ্যুত গতিতে তাকে মেরে ফেললেন। এ দৃশ্য দেখে লোকেরা কিছু সেকেন্টে অবাক হওয়ার পর উল্লাস করতে শুরু করল। তারপর ছেন সেন সবাইকে বললেন: ' ভাই সব, এখন আমাদের এক মাত্র পথ হল ছিং রাজবংশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। তোমাদের মধ্যে যারা আমার সঙ্গে এই অভিযানে অংশ নিতে চাও তারা থাকতে পার। যারা দেশে যেতে চায় তারা এখনই ফিরে যেতে পার'। তার কথা শুনে সবাই প্রায় এক সঙ্গে উচ্চ স্বরে বলল: ' আমরা তোমার সঙ্গে থাকবো। তুমি যা বলেন আমরা তা করবো।' তখন থেকে ছেন সেন ও উ কুয়াংয়ের নেতৃতাধীণ কৃষক বিদ্রোহ বাহিনী গড়ে তোলা হল। এটা চীনের ইতিহাসের প্রথমটি কৃষক বিদ্রোহ বাহিনী।

আস্তে আস্তে এই বিদ্রোহ দলের সংখ্যা বেড়েছে। ছিং রাজবংশের সৈন্যদের সঙ্গে লড়াইতে তারা বারবার জিতেছে। কিন্তু দু:খের ব্যাপার হল, প্রশংসা পাওয়ার পাশাপাশি ছেন সেন ও উ কুয়াং আস্তে আস্তে অহংকার হয়ে উঠল। তাদের মেজাজও আস্তে আস্তে খারাপ হয়ে গেছে। তারা মাঝে মাঝে একটি ছোট ব্যাপার নিয়ে বিদ্রোহিদের মারবি করতেন বা নিযার্তন করতেন। সুতরাং তারা দু'জনের ওপর বিদ্রোহিদের অভিযোগও দিন দিন বাড়ছিল। অন্য দিকে তাদেরকে মেরে ফেলার মতলতও আড়ালে চলছিল। এক দিন রাতে যখন ছেন সেন ও উ কুয়াং গভীরে ঘুমিয়ে গেলেন তখন কয়েক জন বিদ্রোহি তাদেরকে মেরে ফেলল। পরে তারা দু'জনের নেতৃত্বে বিদ্রোহ দল ভেঙ্গে গেল।

কিন্তু তারা দু'জনের প্রভাবে তখন ছিং রাজবংশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সবর্ত্র ছড়িয়ে পড়ল। লিও বাং ও শায়েনইউয়ুর নেতৃতাধীন বিদ্রোহী দল পরে ছিং রাজবংশ উত্খাত করল। তারপর লিও বাংর বিদ্রোহ বাহিনী শায়েনইউয়ুর নেতৃতাধীন বিদ্রোহ বাহিনীকে পরাজিত করে হ্যাং রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করল।

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক