Web bengali.cri.cn   
চীনের প্রাচীনকালের আবিষ্কারক লু বান সম্পর্কে
  2012-11-22 17:08:04  cri
লু বান চীনের বসন্ত ও শরত যুগের লোক। তিনি ছিলেন চীনের প্রাচীনকালের সবচেয়ে বিখ্যাত ছুতার শিল্পী। এর পাশাপাশি তিনি ছিলেন চীনের ইতিহাসের একজন মহান আবিষ্কারক। হাজার হাজার বছর ধরে চীনের ছুতার ও রাজমিস্ত্রিরা তাকে শ্রদ্ধা করে আসছেন।

লু বান ছুতার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্বপুরুষরা সবাই ছুতার ছিলেন। ছোটবেলা থেকে লু বান বড়দের সঙ্গে ঘরবাড়ি নির্মাণ করতে শেখেন। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছেলে ছিলেন। নতুন কিছু দেখলেই শিখতে চাইতেন। তাই অল্প বয়সে তিনি একজন দক্ষ ছুতার হয়ে গেলেন।

তখন চীন বেশ কয়েকটি রাজ্যে বিভক্ত ছিল। রাজ্যে রাজ্যে তখন প্রায়ই লড়াই চলতো। একবার শক্তিশালী ছু রাজ্যের রাজা সুং রাজ্যের ওপর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কেউ কেউ ছু রাজ্যের রাজাকে পরামর্শ দিয়ে বললেন: 'লু রাষ্ট্রে লু বান নামে একজন দক্ষ ছুতার আছে। আমরা তাকে আক্রমণাত্মক অস্ত্র তৈরী করার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে পারি।' রাজা এ-কথা শুনে অত্যন্ত খুশি হলেন। তিনি অচিরেই লু বানকে ডেকে পাঠালেন। ছু রাজ্যের আসার কিছুদিন পর লু বান একটি নতুন অস্ত্রের নকশা করলেন। এই অস্ত্রের নাম ছিল: 'মেঘের সিঁড়ি'। কাজ শেষ হওয়ার পর লু বান ছু রাজ্যের রাজাকে এই নতুন অস্ত্র দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। সেদিন রাজার সামনে এই অস্ত্র পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হল। সৈন্যরা এই সিঁড়ি নিয়ে উচু উচু দেয়ালের নিচে গেল। তারপর এই সিঁড়ি দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে সৈন্যরা দ্রুত উঁচু উঁচু দেয়ালের উপর উঠে পরলো। রাজা এ-দৃশ্য দেশে মহা খুশি হলেন। তিনি বললেন: ' চমত্কার! এ-ধরনের সিঁড়ি থাকলে সুং রাজ্যের দেয়াল যত মজবুত আর উঁচুই হোক না কেন, আমাদের প্রতিরোধ করতে পারবে না।'

যখন ছু রাজ্য সুং রাজ্যের ওপর আক্রমণ চালাতে উদ্যত হল, তখন মু জি নামে একজন ভদ্রলোক যুদ্ধ থামাতে ছু রাজ্যে আসলেন। তিনি ছিলেন বসন্ত ও শরত যুগের মহান চিন্তাবিদ। মু জি লু বানের কাছে এলেন। তিনি লু বানকে জিজ্ঞেস করলেন: 'ছু একটি বড় রাজ্য, আর সুং একটি ছোট রাজ্য। তুমি কেন ছু রাজ্যকে সুং রাজ্যের ওপর আক্রমণ করতে সাহায্য করছ? আক্রমণ করলে কি ছু রাজ্য সুং রাজ্যকে পরাজিত করতে পারবে?' লু বান উত্তর দিলেন: 'আমি একটি অস্ত্র আবিষ্কার করেছি। এর নাম 'মেঘের সিঁড়ি'। এই অস্ত্রের সাহায্যে ছু রাজ্য অবশ্যই সুং রাজ্যকে পরাজিত করতে পারবে। '

এরপর রাজার সামনে মু জি ও লু বানের মধ্যে তীব্র বাকযুদ্ধ চলল। অবশেষে মু জি রাজাকে রাজি করাতে সক্ষম হলেন। রাজা যুদ্ধ বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এরপর মু জি লু বানকে বললেন: 'দু'দেশের মধ্যে যুদ্ধ হলে জনসাধারণের কোন কল্যাণ হয় না। উপরন্তু, বাস্তবিকপক্ষে যুদ্ধে কেউ বিজয়ী হতে পারে না।' লু বান মু জির কথা বুঝতে পারলেন এবং মনে মনে খুবই লজ্জিত হলেন।

মু জি আবার বললেন: 'শুনেছি তুমি একটি কাঠের পাখি তৈরি করেছ। এই কাঠের পাখি আকাশে তিন দিন তিন রাত উড়তে পারে। কিন্তু এ-ধরনের পাখি জনসাধারণের জন্য কিছু করতে পারে না। অথচ দেখ, আমি একধরনের ঠেলাগাড়ি আবিষ্কার করেছি। এই গাড়ি অনেক পাথর বহন করতে পারে। তোমার এই কাঠের পাখির চেয়ে আমার এই গাড়ির মূল্য বেশী। সুতরাং মেধা ঠিক জায়গায় ব্যবহার করা উচিত। এক কথায় জনসাধারণের জন্য যত বেশি করতে পার ততই ভাল।' মু জির কথা শুনে লু বান মুগ্ধ হলেন। তিনি মু জির হাত ধরে আবেগের সঙ্গে বললেন: 'স্যার, আপনি খুব ভাল কথা বলেছেন। আজকে আমি অনেক যুক্তি বুঝে ফেলেছি। আমি যুদ্ধের জন্য কোন অস্ত্র আবিষ্কার করবো না। আমি জনসাধারণের কল্যাণের জন্য চেষ্টা করবো।' তখন থেকে লু বানের চিন্তাধারা বদলে গেল। তিনি তার মেধাকে জনসাধারণের স্বার্থে কাজে লাগানোর সংকল্প করলেন।

একদিন লু বানের কয়েকটি ঘোড়া অসুস্থ হয়ে পড়ল। নিরুপায় হয়ে তিনি ও তার স্ত্রী খাদ্যভর্তি গাড়ি টেনে চলছিলেন। তাদের দু'জনের কাপড় ঘামে ভিজে গেল। তার স্ত্রী নালিশ করে বললেন : 'অন্যরা তোমাকে দক্ষ ছুতার মনে করে। কিন্তু আমার মনে হয়, তুমি কিছুই না!' 'তুমি কেন এভাবে বলছ?' লু বান জিজ্ঞেস করলেন। 'তুমি কেন আমার বাসার জন্য একটি কাঠের ঘোড়া তৈরি করতে পার না?' তার স্ত্রী লু বানকে বললেন।

কাঠের ঘোড়া দিয়ে গাড়ি টানানোর কথা আগে কেউ শোনেনি। কিন্তু লু বান দিন রাত এ-ব্যাপারে মাথা ঘামাতে শুরু করলেন। অবশেষে একদিন তিনি এমন একটি গাড়ি তৈরি করলেন, যা নিজেই চলতে পারে। তিনি কাঠ দিয়ে বেশ কয়েকটি ছোট-বড় গিয়ার তৈরি করলেন। গিয়ারের মাঝখানে একটি ইস্পাতের তৈরি স্প্রিং সাজিয়ে দেওয়া হল। গিয়ার ও স্প্রিং গাড়ির নিচে বসানো হয়। তারপর তিনি কাঠ দিয়ে একটি ঘোড়া ও একজন চালক তৈরী করলেন। গ্রামবাসীরা লু বানের আবিষ্কৃত গাড়ি দেখতে আসল। লু বান গ্রামবাসীদের সামনে চূড়ান্তভাবে গাড়ির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন। অবশেষে তিনি গাড়িতে কিছু খাদ্য রেখে দিলেন। তারপর তিনি গ্রামবাসীদেরকে বললেন: 'এখন আমি এই গাড়ি চালাতে শুরু করছি। আপনারা আমার সামনের রাস্তা থেকে একটু সরে দাঁড়ান।' লু বান গাড়ির স্প্রিং খোলার সাথে সাথে গাড়ি সামনের দিকে চলতে আরম্ভ করল। কাঠের মানুষ দেখতে প্রকৃত মানুষের মতো। কাঠের ঘোড়াও দেখতে অত্যন্ত জীবন্ত। সবাই এ দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে গেল। লু বানের এই আবিষ্কারের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। পরবর্তীকালের মানুষ লু বানের এই আবিষ্কার থেকে কাজ থেকে অনেক শিক্ষা গ্রহণ করে।

একবছর লু বান একটি প্রাসাদ নির্মাণের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। প্রাসাদটি অনেক বড় আকারের। সুতরাং তা নির্মাণ করতে অনেক কাঠ দরকার। অন্যদিকে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে হবে। লু বান একসঙ্গে বহু লোককে পাহাড়ে গাছ কাটতে পাঠালেন। কিন্তু তখন করাত আবিস্কৃত হয়নি। সবাই কুঠার নিয়ে পাহাড়ে গাছ কাটতে গেল। একদিনে মাত্র দশ-বারোটি গাছ কাটা গেল। চাহিদার চেয়ে কাঠের সরবরাহ অনেক কম ছিল। ফলে প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে গেল। লু বান খুব চিন্তিত হয়ে নিজেই পাহাড়ের অবস্থা দেখতে গেলেন। পাহাড়ে ওঠার সময় তিনি একটি পাথরে হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। সৌভাগ্যক্রমে তিনি একমুষ্টি ঘাস আঁকরে ধরে কোনরকমে দাঁড়াতে পাড়লেন। মাটি থেকে দাঁড়িয়ে দেখলেন, হাত থেকে রক্ত পড়ছে। তিনি ঐ ঘাস মাটি থেকে তুলে ভালভাবে খেয়াল করে দেখলেন যে, ঘাসের পাতা করাতের মতো। তিনি ঘাসের পাতা দিয়ে তার হাতের উপরিভাগে আঁচড় কাটলেন। সাথে সাথে তার হাতের চামড়া কেটে গেল। এ দেখে লু বান মনে মনে ভাবলেন, যদি একটি লৌহখণ্ডকে এ-পাতার আকৃতি দেয়া যায়, তবে তা দিয়ে কাঠ কাটা যাবে। এরপর তিনি একজন কামারকে একটি লোহার পাতকে ঐ পাতার মতো করে দেয়ার জন্য বললেন। কামার তাই করল এবং এ-ভাবেই লু বানের বুদ্ধিতে তৈরি হলো করাত। করাত তৈরী হওয়ার পর গাছ কাটার কাজ খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল এবং প্রাসাদের নির্মাণ কাজও নির্ধারিত সময়ে শেষ হল। পরে লু বান ছুতারের সবধরনের হাতিয়ার আবিষ্কার করলেন। হাজার বছর ধরে লু বান শ্রমজীবীদের কাছে গুরুর মর্যাদা পেয়ে আসছেন; তিনি চীনা জনগণের শ্রদ্ধার পাত্র।

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক