

হ্যাং ইউয়ুর বয়স যখন দশ, তখন তার বড় ভাই অন্য একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার অপরাধের সাথে জড়িত থাকার কারণে, রাজদরবার ত্যাগ করে স্থানীয় কর্মকর্তার ছোট একটি পদ গ্রহণে বাধ্য হন। তিনি গোটা পরিবার নিয়ে চাওযৌ রওয়ানা হন। চাওযৌ বতর্মানে কুয়াংযো প্রদেশে অবস্থিত। চাওযৌ যাওয়ার পথে তার মন ছিল বিষন্ন। কিন্তু তারপরও তিনি রাস্তার দু'পাশের দৃশ্য ছোট ভাই হ্যাং ইউয়ুকে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। হ্যাং ইউয়ুর স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত ভাল। তিনি তার বড় ভাইয়ের সমস্ত কথা মনে গেথে রাখলেন।
চাওযৌ পৌঁছানোর কিছুদিন পর হ্যাং ইউয়ুর বড় ভাই অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং ঠিক এক মাস পর মারা গেলেন। বন্ধুদের সাহায্যে হ্যাং ইউয়ুর বউদি হ্যাং ইউয়ু ও তার ছেলেকে নিয়ে জন্মস্থান হোইয়াং ফিরে এলেন। একদিন তার বউদি হ্যাং ইউয়ু ও তার ছোট ভাইকে বললেন, 'মানুষের জীবন অত্যন্ত ছোট। তোমাদের একাগ্রচিত্তে পড়াশুনা করা উচিত। খ্যাতির জন্য নয়, বরং বৈচিত্র্যময় জীবন পাবার জন্য।' হ্যাং ইউয়ু মেধাবী ছেলে। তিনি তার বউদির কথা ভালভাবে বুঝতে পারলেন। তখন থেকেই তিনি প্রতিদিন ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠতে শুরু করেন। ঘুম থেকে উঠে প্রথমে কিছুক্ষণের জন্য ব্যয়াম করতেন, তারতার পড়ার রুমে ঢুকে বই পড়তে শুরু করতেন।
বিভিন্ন রাজবংশে হ্যাং ইউয়ুর পরিবারের সদস্যদের অনেকেই রাজদরবারের কর্মকর্তা ছিলেন। সুতরাং তাদের গ্রন্থশালায় অনেক বই সংরক্ষিত ছিল। তিনি কনফুসিয়াসের বই পড়তেন, লাওজির বই পড়তেন। বই পড়ার সময় যখন কোন কিছু বুঝতেন না, তখন বউদিকে জিজ্ঞেস করতেন। এমনভাবে ছোটবেলায় হ্যাং ইউয়ু প্রাচীনকালের অনেক বিখ্যাত লেখকের বই পড়ে শেষ করেন।
এক বসন্তে বউদি হ্যাং ইউয়ুকে তার কাছে ডেকে পাঠালেন। তিনি হ্যাং ইউয়ুকে বললেন: 'ভাই, তুমি এখন অনেক বড় হয়েছ। তুমি লংইয়াংয়ে পড়াশুনা করতে যাও। সেখানে অনেক পন্ডিত আছেন। তুমি তাদের কাছ থেকে আরও অনেক কিছু শিখতে পারবে।' পরের দিনই হ্যাং ইউয়ু একটি কাজের ছেলের সঙ্গে লংইয়াংয়ের উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে গেলেন।
বড় ভাইয়ের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাহায্যে লংইয়াংয়ে অনেক নাম-করা পন্ডিতের সঙ্গে হ্যাং ইউয়ুর পরিচয় ঘটে। একদিন হ্যাং ইউয়ু ও তার কয়েক বন্ধু লেখা নিয়ে মত বিনিময় করছিলেন। তিনি সরাসরি বন্ধুদের বললেন: "যখন একটি ভাল বই পড়ি, তখন মন আপনা-আপনি খুশি হয়ে উঠে; কিন্তু যখন একটি খারাপ বই পড়ি, তখন মন আপনা-আপনি খারাপ হয়ে যায়।" তখন তার বন্ধুরা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, "তুমি কাদের বই বেশি পছন্দ কর।" হ্যাং জানালেন, তিনি পূর্ব ও পশ্চিম হ্যাং রাজবংশের লেখকদের বই পড়তে পছন্দ করেন। সেদিনের পর থেকেই তিনি পূর্ব ও পশ্চিম হ্যাং রাজবংশের সাহিত্যের ওপর গবেষণা করতে শুরু করলেন। অবশেষে তিনি নিজেই একজন বড় পন্ডিত হয়ে গেলেন।
লংইয়াংয়ে কয়েক বছর অবস্থান করার পর হ্যাং ইউয়ু তত্কালীন রাজধানী ছাংআনে তার বন্ধুদেরকে দেখতে গেলেন। রাজধানীতে তিনি বেশ কয়েকজন বিখ্যাত পন্ডিতের সঙ্গে দেখা করলেন। তাদের পরামর্শে তিনি একটি পরীক্ষায় অংশ নিলেন। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কর্মকর্তার পদে নিয়োগও পেলেন। কিন্তু কর্মকর্তার পদটি তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তবু তিনি এটিকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার একটি সুযোগ হিসেবে নিলেন। কর্মকর্তা হওয়ার পর হ্যাং ইউয়ু জনসাধারণের ব্যাপারে মাথা ঘামাতে শুরু করেন।
এক সময় কুয়েংজং অঞ্চলে মারাত্মক খরা দেখা দিল। দুর্গত এলাকার অনেক মানুষ নিজেদের জন্মস্থান ত্যাগ করে রাজধানী ছাংআনে চলে গেল। তারা রাজধানীতে ভিক্ষা করতে শুরু করল। তাদের মধ্যে অনেকেই না-খেয়ে রাস্তায় মারা গেল। দুর্গত এলাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে ভালোভাবে ধারণা নেয়ার জন্য হ্যাং ইউয়ু সাধারণ মানুষ সেজে দুর্গতদের মাঝে গেলেন। খরাকবলিত এলাকায় তিনি দেখলেন, ফসল খরাতে নষ্ট হয়ে গেছে। অধিকাংশ গ্রামবাসী খরা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য অন্য জায়গায় চলে গেছে। যারা যায়নি তারা গাছের বাকল ও শিকড় খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। হ্যাং ইউয়ু দুর্গতদের কাছ থেকে জানলেন যে, কর দেয়ার জন্য অনেক পরিবার বাড়ি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। কোন কোন লোক নিজের সন্তানকে পর্যন্ত বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। হ্যাং ইউয়ু মনে মনে ভাবছিলেন, খরার পরিস্থিতি এতো মারাত্মক; জনসাধারণের জীবন এতো শোচনীয়। অথচ স্থানীয় কর্মকর্তারা রাজার সামনে অবলীলায় মিথ্যা বলছেন। তারা রাজাকে জানালেন, খরা সত্ত্বেও ফলন ভালো হয়েছে। হ্যাং ইউয়ু তখন সিদ্ধান্ত নিলেন, দুর্গত এলাকায় যা দেখেছেন, সেসব সরাসরি রাজাকে বলে দেবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। তিনি খরা সম্পর্কে রাজার কাছে একটি বিস্তারিত রিপোর্ট দিলেন। তার রিপোর্টে খরাকবলিত এলাকার পরিস্থিতি বিস্তারিতভাবে বর্ননা করা হল। তিনি রাজাকে জনসাধারণের ওপর আরোপিত কর হ্রাস করার অনুরোধ করলেন। কিন্তু হ্যাং ইউয়ুর এই আচরণ সে-সব দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তার স্বার্থের বিরুদ্ধে গেল। তারা হ্যাং ইউয়ুকে অপছন্দ করতে শুরু করলেন। রাজদরবারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নাম ছিল লি জেন। তার ওপর রাজার আস্থা খুব বেশি ছিল। এই কর্মকর্তা রাজার সামনে বললেন, "হ্যাং ইউয়ু খরা নিয়ে অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করেছেন। যদি হ্যাং ইউয়ুর প্রস্তাব অনুযায়ী জনসাধারণের কর হ্রাস করা হয়, তাহলে রাজদরবার কোথা থেকে টাকাপয়সা সংগ্রহ করবে?" রাজা ওই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার কথা বিশ্বাস করলেন এবং কালবিলম্ব না করে হ্যাং ইউয়ুকে লিয়েনযো জেলার গর্ভনর নিয়োগ করলেন। এবার হ্যাং ইউয়ু অনেক দূরের কুয়াংডং প্রদেশে যেতে বাধ্য হলেন। তবে, লিয়েনযো জেলার গর্ভনরের পদে থাকার সময় হ্যাং ইউয়ু স্থানীয় জনসাধারণের জন্য অনেক কল্যাণকর কাজ করেছিলেন। স্থানীয় জনসাধারণ তার খুব প্রশংসা করতেন।
কয়েক বছর পর হ্যাং ইউয়ু আবার লিয়েনযো জেলা থেকে রাজধানী ছাংআন গেলেন। তখন নতুন রাজা সিংহাসনে বসেছেন। নতুন রাজা হ্যাং ইউয়ুর যোগ্যতার প্রশংসা করতেন। তিনি আবার কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পেলেন, পেলেন রাজার পাশে থাকার সুযোগ। এক বসন্তে জেনযোতে বিদ্রোহ ঘটল। বিদ্রোহ দমন করার উপায় খোঁজার জন্য একদিন রাজা সমস্ত কর্মকর্তাকে ডেকে পাঠালেন। রাজা সকল কর্মকর্তার সামনে জিজ্ঞেস করলেন: কে রাজদরবারের বিশেষ দূত হিসেবে বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনা করতে যাবেন। রাজার কথা শুনে কেউ কথা বলল না। সবাই জানতেন এ-সব বিদ্রোহীর সঙ্গে যোগাযোগ করা সহজ কাজ নয়। 'কেউ আমার উদ্বেগ ভাগাভাগি করতে চান না?'--রাজা উচ্চস্বরে বললেন। তখনই হ্যাং ইউয়ু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন: 'আমি সেখানে যেতে রাজি আছি।'
পরের দিন হ্যাং ইউয়ু বিদ্রোহীদের ঘাঁটিতে পৌছলেন। হ্যাং ইউয়ু বিদ্রোহীদের সর্দারের সঙ্গে দেখা করলেন। সর্দার বললেন: 'হ্যাং ইউয়ু সাহেব, বিদ্রোহের জন্য আমার দোষ নেই; দোষ হচ্ছে সামরিক কর্মকর্তা ও সৈন্যদের।' হ্যাং ইউয়ু বললেন, 'তুমি রাজদরবারের জন্য অনেক অবদান রেখেছ। রাজা ও রাজদরবারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তোমাকে খুব পছন্দ করেন। অথচ তুমিই কি না বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিচ্ছ! আমি এখন রাজদরবারের বিশেষ দূত হিসেবে তোমার সঙ্গে কথা বলছি। তোমাকে এ-কথা মনে রাখতে হবে যে, রাজদারবারের প্রতি অনুগত থাকা এবং রাজদরবারের বিরোধীতা করা দুটো পরস্পরবিরোধী ব্যাপার। দুটোর পরিণামও ভিন্ন হতে পারে। তোমাকে এ-ব্যাপার নিয়ে ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে।'
কিছুক্ষণ পর সর্দার হ্যাং ইউয়ুকে জিজ্ঞেস করল, 'এখন আমার কী করা উচিত?'
হ্যাং ইউয়ু সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন: 'অবিলম্বে এ-বিদ্রোহের অবসান ঘটান এবং অপরাধের ক্ষতিপূরণস্বরূপ রাজদরবারের জন্য আরও বেশি অবদান রাখুন।'
সর্দার তার কথা মেনে নিলেন এবং হ্যাং ইউয়ু তার মিশনে সফল হলেন।




