গানের একটি কথা এমন: "আমি ট্রেভি ঝরনার কাছে একটি কামনা করেছি। জিজ্ঞেস করো না, আমি কিছুই বলবো না।" গানের কথার মতো ইউরোপের একটি স্বপ্ন আছে, সেটি হলো যুক্ত হওয়া। তবে এই স্বপ্ন কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, সে উত্তর কেউ দিতে পারে না। জর্জ সোরোস আগে বলেছিলেন, পুরো ইউরোপকে এক সুতোয় গাঁথার মৌলিক যুক্তি ইতোমধ্যেই ধ্বংস হয়েছে। ইউরোপের উচিত আর্থিক সংকট মোকাবিলার প্রক্রিয়ায় যুক্তকরণ প্রতিক্রিয়া জোরদার করা। ঠিক যেন দার্শনিক নীজের কথার মতো: 'যে জিনিস আমাকে হত্যা করতে পারে না, তা আমাকে আরো শক্তিশালী করবে।' খুব দুঃখের বিষয় হলো, ২০০৮ সালে ইউরোপের ঋণ সংকট শুরুর পর অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের শুধু যার যার অবস্থা নিয়ে চিন্তা করার প্রবণতা দেখা যায়। যখন জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল ঘোষণা করেন, ইউরো অঞ্চলের দেশগুলোর উচিত নিজ দেশের ব্যাংককে উদ্ধার করা, তখন থেকে অভিন্ন মুদ্রার ভবিষ্যত খুব বিপদজনক হয়ে ওঠে।
যদি ইউরোপীয় দেশগুলো আর্থিক সংকটে ঐকবদ্ধ হয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে, তাহলে এই সমস্যার আর অবনতি হবে না। তবে এখন ইউরো অঞ্চল খুব পরস্পরবিরোধী অবস্থায় রয়েছে। জার্মানি দক্ষিণ ইউরোপকে সাহায্য করতে রাজি হলেই কেবল ইউরো অঞ্চলে আশা দেখা দেবে। তবে জার্মানির একটি পূর্বশর্ত আছে। সেটি হলো ঋণগ্রস্ত দেশের বাজেটে তাদের হস্তক্ষেপের অধিকার। নইলে জার্মানি কোনো সাহায্য দেবে না। অন্যদিকে দক্ষিণ ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য ঋণের বোঝা খুব ভারি; তারা আর চলতে পারছে না। তবে বাজেট ইস্যুতে এসব দেশ কোনো ছাড় দিতে চায় না। এ কারণে ইউরোপের ঋণ সংকট দীর্ঘকাল ধরে বজায় থাকা তো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।
ই গানের কথার আরেকটি অংশ এমন: "আমার স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমার আত্মা দিতে পারি, একটি চুমু পাওয়ার জন্য আমি সব টাকা ছেড়ে দিতে পারি"। দক্ষিণ ইউরোপীয় দেশগুলো শ্রমশক্তি বাজারের সংস্কার ও বাজেট হ্রাসকে বাইরের সাহায্য পাওয়ার শর্ত হিসেবে দেখে, এসব সাহায্যের মধ্যে কিছু জার্মানির আর কিছু ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া। তবে এখন ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হচ্ছে। এই ব্যাংক বিভিন্ন সদস্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ে গঠিত, যাতে বড় দেশগুলোর রাজনীতির প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ এড়ানো যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কর্তব্য হলো বেকারত্বের হার এবং মুদ্রার স্থিতিশীলতার জন্য ভারসাম্যমূলক আর্থিক নীতি প্রণয়ন করা। কেউ কেউ মনে করে, ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি প্রণয়নের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ নয়, এর কোনো পর্যবেক্ষণ নেই এবং জার্মানিসহ বড় বড় দেশের নিয়ন্ত্রণ এড়াতে পারে না। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক লিখিত মতামতও পেয়েছে। এসব মতামতে ঋণ সমস্যার সমাধানে যথাসাধ্য ভূমিকা পালন না করার জন্য এ ব্যাংকের সমালোচনা করা হয়েছে।
গানের কথার আরেকটি অংশ এরকম: "আমি ইচ্ছাকৃতভাবে প্রেম পেতে চাই না। তবে তোমার প্রথম দর্শনে আমি প্রেমে পড়েছি"। গানের মেয়েটি ছেলেটিকে খুব ভালোবাসে, তবে তাদের প্রেমের পরিণতি ভাল হয় নি। ইতিহাসে জার্মানি অনেক বার ইউরোপের রাজা হতে চেয়েছে, তবে বিজয় তাদের আসে নি। তবে এবার ঋণ সংকটে জার্মানি নেতৃত্বের স্থানে রয়েছে। এই নতুন ভূমিকা পালন করা ততটা সহজ ব্যাপার নয়। অনেক নীতি প্রণয়নে জার্মানি অনেক দ্বিধা করে এবং তত বড় ভূমিকা পালন করতে পারে না।
"বেবি, তুমি এতো সুদর্শন, তোমাকে দেখার সাহস নেই"। সুদর্শন ছেলে ছাড়া স্পেনের রিয়্যাল এস্টেটের অবস্থা বিবেচনা করতেও সাহস লাগে। বিগত দশ বছরে স্পেনের জমির দাম ৫ গুণ বেড়েছে। ওই সময়ে স্পেনের জি ডি পি-তে স্থাপত্য শিল্পের অবদান ১০ শতাংশে দাঁড়ায়। অবশ্য বহু চাকরির সুযোগও সৃষ্ট হয়েছে এজন্য। তবে যেন এক রাতের পর বাজার এবং সুযোগ সবই অদৃশ্য হয়ে গেছে; বাড়িঘরের ক্রতার সংখ্যা অনেক কমে গেছে। বেকারত্বের হারও দ্রুত গতিতে বেড়েছে। তবে স্পেন সময়োচিতভাবে রিয়্যাল এস্টেট খাতের নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয় নি, যার কারণে এ খাতের সমস্যার আরো অবনতি হয়েছে। স্পেনে বহু অনুমোদিত ভূমিতে এখনো কোনো বাড়িঘর নির্মিত হয় নি। এসব জমিতে কত বাড়িঘর নির্মাণ করা যায়? সাত লাখ ৫৮ হাজারেরও বেশি। তবে এখন কেউ রিয়্যাল এস্টেটে বিনিয়োগ করতে চায় না।
যখন রিয়্যাল এস্টেট খাতের অবস্থা খুব ভাল থাকে, তখন জমি থাকলেই ব্যাংকঋণ পাওয়া যায়। কিন্তু অবস্থা খারাপ হওয়ায় এখন ব্যাংক আর ঋণ দিতে চায় না। এর ফলে অনেক প্রকল্প অসমাপ্ত থেকে এক 'ভুতুড়ে নগরীতে' পরিণত হয়েছে।
গানের কথার আরেকটি অংশ হলো: তোমার ফোন আমি পাচ্ছি না, তোমার দৃষ্টি আমি পাচ্ছি না। তবে আমি ইতোমধ্যেই তোমাকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলেছি"। এই কথা গ্রিস ও আয়ারল্যান্ডসহ ইউরোপের কিছু দেশের জন্য খুব উপযোগী। যখন অর্থনীতি খুব সমৃদ্ধ হয়, তখন গ্রিসের মতো ছোট দেশে অনেক বিনিয়োগ আসে। এর ফলে এমন দেশের অর্থনীতিরও অনেক উন্নয়ন হয়। তবে ঋণ সংকটের অবনতির সঙ্গে সঙ্গে বাজারে আতঙ্ক সৃষ্টি হয় এবং অর্থের সরবরাহ কমে যায়। সাহায্য দেওয়ার ব্যাপারে জার্মানিসহ বড় দেশগুলো ততটা ইতিবাচক নয়।
গানের কথায় আরো বলা হয়েছে: "আমি ভিক্ষা করি, আমি চুরি করি, আমি তোমার জন্য সব ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতে পারি"। এই বাক্যটি নিঃসন্দেহে গ্রিসের অবস্থা বর্ণনা করতে পারে। বহু বছর ধরে গ্রিস সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ কম করে জানিয়েছে এবং দেশটির আর্থিক অবস্থাকে সুন্দর করে দেখিয়েছে। ইউরোপ অঞ্চলে যোগ দেওয়ার জন্য গ্রিস 'গোল্ডম্যান স্যাচ' কোম্পানিকে অনেক অর্থ দিয়েছে, যাতে দেশের আর্থিক অবস্থাকে সুন্দর দেখানো হয় এবং দেশের একটি ১ বিলিয়ন ইউরো মূল্যের ঋণ ধামাচাপা পড়ে যায়।
হ্যাঁ, পরের গল্প হয়তো অনেকেই জানেন, অর্থ সংগ্রহের খরচ বেড়ে যাওয়ার ফলে গ্রিসে ঋণ সংকট ঘটে। ২০০৯ সালে গ্রিস হঠাত্ ঘোষণা করে যে, তার আর্থিক ঘাটতি ও সরকারি ঋণ যথাক্রমে দেশের জি ডি পি'র ১২.৭ ও ১১৩ শতাংশ। এ হার ইইউ'র 'স্থিতিশীল ও প্রবৃদ্ধি ইশতেহারে' নির্ধারিত হার ৩ শতাংশ ও ৬০ শতাংশের অনেক ওপরে। যেহেতু সংকটের পর গ্রিস সরকার বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করছে, তবুও ইউরো অঞ্চলের ভবিষ্যত অনেক বিপদজনক হয়ে উঠেছে।