Web bengali.cri.cn   
বিনহাই নয়া অঞ্চল আর চীনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের কৌশলগত বিন্যাস
  2012-09-07 22:54:24  cri

বিনহাই নয়া অঞ্চল চীনের থিয়েনচিন শহরের পূর্বাংশের উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত। ২২৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিনহাই অঞ্চলে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে থাংকু, হানকু ও দাকাং – এ তিনটি প্রশাসনিক অঞ্চল এবং অর্থনীতি ও প্রযুক্তি উন্নয়ন অঞ্চল, শুল্কমুক্ত অঞ্চল আর বন্দর ইত্যাদি। এ অঞ্চলে চীনের বৃহত্তম কৃত্রিম বন্দর, সর্বাধিক সম্ভাব্য ভোক্তা বাজার আর সবচেয়ে উন্নত শহুরে আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা আছে।

বিনহাই নয়া অঞ্চলের উন্নয়ন ও সংস্কার কমিটির সমন্বিত পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান থাং চোং ফু বলেন, '২০০৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকার বিশেষ করে বিনহাই নয়া অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য একটি দলিল প্রকাশ করে। দলিলে স্পষ্টভাবে বিনহাই নয়া অঞ্চলের প্রায়োগিক স্থিতি বিন্যাস করা হয়। এটা হচ্ছে পেইচিং, থিয়েনচিন ও হোপেই এর ওপর নির্ভর করে বোহাই উপকূলীয় অঞ্চলগুলোকে পরিসেবা দেওয়া, উত্তর-পূর্ব এশিয়ামুখী উত্তর চীনের এক বৈদেশিক উন্মুক্তকরণের দ্বার, উন্নত আধুনিক যন্ত্রনির্মাণ শিল্প ও গবেষণা কেন্দ্র, উত্তর চীনের আন্তর্জাতিক জাহাজ পরিবহণ কেন্দ্র এবং লজিস্টিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা।

২০০৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত ছয় বছর পার হয়েছে। বিনহাই নয়া অঞ্চল কেমন উন্নতি হয়েছে? চীন কেন বিনহাই নয়া অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করেছে? বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় বিনহাই নয়া অঞ্চলের কী কী উপায় আছে? বন্ধুরা, আজকের লাভ ক্ষতি অনুষ্ঠানে আমরা এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো।১৯৭৮ সালের সূচনার পর চীনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ এ পর্যন্ত ৩৪ বছরে পড়েছে। কিছু সংখ্যক মানুষ ও কিছু অঞ্চল সর্বার আগে ধনী হওয়ার কৌশল অনুসারে চীনের পূর্বাঞ্চলের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর অর্থনীতি দ্রুত বিকশিত হয়েছে এবং মোট তিন বার মহা উন্নয়ন অতিক্রম করেছে।

প্রথম সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের জোয়ার ঘটেছে গত শতাব্দীর আশির দশকে। শেনচেন বিশেষ অঞ্চলের নেতৃত্বে চুচিয়াং বদ্বীপের দ্রুত অর্থনৈতিক উত্থান হয়। শেনচেন হংকংয়ের শিল্পের স্থানান্তর আকর্ষণ করে দশ বছরের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র মাছধরা গ্রাম থেকে বিশ্ব নগরে পরিণত হয়। গত নব্বইয়ের দশকে দ্বিতীয় সংস্কার ও উন্মুকরণের জোয়ার ঘটে। শাংহাই পুতোং নয়া অঞ্চলের নেতৃত্বে ছাংচিয়াং বদ্বীপ বিশ্বায়ন আর আন্তর্জাতিক পুঁজির স্থানান্তরের সুযোগ কাজে লাগায়। এ অঞ্চল চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি পরিণত হয়েছে। তৃতীয় জোয়ার ঘটে এ শতাব্দীর প্রথম দিকে। থিয়েনচিনের বিনহাই নয়া অঞ্চলের নেতৃত্বে সমগ্র বোহাই অঞ্চল জোরালোভাবে ব্যাপক সংস্কার করেছে।

২০০৬ সালের মে মাসে 'থিয়েনচিন বিনহাই নয়া অঞ্চলের উন্নয়ন ও উন্মুক্তকরণ সমস্যা নিষ্পত্তির প্রস্তাব' গৃহীত হয়। চীন সরকারের এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে চীনের অর্থনৈতিক বিন্যাসে বিনহাই নয়া অঞ্চলের কৌশলগত মর্যাদা নির্ধারিত হয়।

বিনহাই নয়া অঞ্চলের নির্মাণকাজের সঙ্গে সঙ্গে চীন সরকার পেইচিং, থিয়েনচিন আর হোপেই নগর চক্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। এ নগর চক্রের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে পেইচিং, থিয়েনচিন আর হোপেই প্রদেশের আটটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। তাদের ভূমির আয়তন প্রায় ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার এবং মোট জনসংখ্যা প্রায় ৬ কোটি। এটা হচ্ছে উত্তর চীনের গুরুত্বপুর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল।

আঞ্চলিক অর্থনীতিকে একীভূত করার পাশাপাশি বিনহাই নয়া অঞ্চল আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের নতুন চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। চলতি বছরের প্রথমার্ধে প্রধান অর্থনৈতিক সূচক সুষ্ঠু ও দ্রুত ঊর্ধ্বগতি বজায় রেখেছে। এ অঞ্চলের মোট উত্পাদনের পরিমাণ ৩২০ বিলিয়ন ইউয়ান, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি। থাং চোং ফু বলেন, "২০১২ সালের প্রথম তিন মাসের প্রবৃদ্ধি-হার ২১.২ শতাংশ। প্রথম ছয় মাসের প্রবৃদ্ধির হার ২০.২ শতাংশ। বর্তমান প্রবৃদ্ধির হার আমাদের পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্যের চেয়ে বেশি।"

বিনহাই নয়া অঞ্চল সরকার প্রকাশিত শিল্প উন্নয়ন পরিকল্পনা অনুযায়ী, দ্বাদশ পাঁচশালা পরিকল্পনা চলাকালে অর্থাত্ ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিনহাই প্রধানত তৈলরাসায়নিক শিল্প, বিমানচালনা ও মহাকাশ এবং নতুন জ্বালানি - এ তিনটি বিশ্ব শ্রেণীর শিল্প ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করবে। অনুমান অনুযায়ী, শিল্প বিনিয়োগের পরিমাণ ৮০০ বিলিয়ন ইউয়ানে পৌঁছাবে, বার্ষিক শিল্প উত্পাদনের পরিমাণ ২ ট্রিলিয়ন ইউয়ান ছাড়িয়ে যাবে এবং শিল্পের মূল্য সংযোজন ৬০০ বিলিয়ন ইউয়ান অতিক্রম করবে। এ ছাড়া এ নয়া অঞ্চল আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা-শক্তি অধিকারী আধুনিক শিল্প ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালাবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিনহাই নয়া অঞ্চল বহু বড় প্রকল্প আকর্ষণ করেছে। যেমন এয়ারবাস এই-৩২০ উত্পাদন লাইন, নতুন-প্রজন্ম পরিবাহক রকেটের শিল্পায়ন ঘাঁটি, 'থিয়েনহো এক নম্বর' সুপার কম্পিউটার আর সানআন আলোকবিদ্যুত্ এলইডি ইত্যাদি। এসব বড় প্রকল্প প্রবেশের দরুণ বিনহাই নয়া অঞ্চল বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এয়ারবাস এই-৩২০ প্রকল্প বিনহাই নয়া অঞ্চলে প্রবেশের পর এশিয়ায় তার প্রথম পণ্য স্থানান্তর কেন্দ্র -- এয়ারবাস (থিয়েনচিন) পণ্য স্থানান্তর কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর সাথে বিশটিরও বেশি বিমানচালনা সম্পর্কিত আনুষঙ্গিক প্রতিষ্ঠান চলে এসেছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর উত্পাদন মূল্য কয়েক শ বিলিয়ন ইউয়ান।

চীনের পশ্চিমাঞ্চলকে একটি সামুদ্রিক বন্দর সরবরাহের জন্য বিনহাই নয়া অঞ্চল পশ্চিম চীনের প্রদেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা করে 'শুকনো বন্দর' প্রকল্প নির্মাণ করছে। নয়া অঞ্চল উন্নয়নের কৌশল অনুযায়ী, শুকনো বন্দর মধ্য এশিয়ায় প্রসারিত হবে। এটা মধ্য এশীয় দেশগুলোর রপ্তানি বাড়াবে। এ প্রসঙ্গে বিনহাই নয়া অঞ্চলের বাণিজ্য কমিটির উপপ্রধান চাং চি কাং বলেন, "এখন থিয়েনচিন বন্দর জোরালোভাবে শুকনো বন্দর উন্নয়ন করছে। এ শুকনো বন্দর মধ্য এশীয় দেশগুলো পর্যন্ত নির্মিত হবে। এ বন্দর মধ্য এশীয় দেশগুলোর সবুজ পথ হিসেবে চালু হওয়ার পর ওই দেশগুলো থিয়েনচিন বন্দরকে তাদের জাহাজঘাটা হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। তাদের পণ্য পরিষ্করণের পর সরাসরি রপ্তানির প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবে। এভাবে সময় সাশ্রয় হবে এবং কাজের দক্ষতা উন্নত হবে।"

এ বছরে নয়া অঞ্চলের অর্থনীতিতে প্রবল প্রবৃদ্ধির প্রবণতা বজায় থাকলেও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিবেশের প্রভাবে রপ্তানি সম্প্রসারণ চাপের সম্মুখীন হয়। বিনহাই নয়া অঞ্চলের বাণিজ্য কমিটির উপপ্রধান চাং চি চেন বলেন, "সবাই জানেন, আন্তর্জাতিক আর্থিক সংকটের কুপ্রভাব সম্পর্কে। এখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অর্থনীতির মন্দাবস্থা দেখা যাচ্ছে। এটা আমাদের চাহিদার ওপরও প্রভাব ফেলেছে। শুধু থিয়েনচিন নয়, সারা চীনে রপ্তানিতে মন্দাভাব আবির্ভূত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো আমাদের প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদারদের ম্রিয়মাণ অর্থনীতি আমাদের রপ্তানির ওপর প্রভাব ফেলেছে। উত্পাদনের ব্যয় বেড়ে গেছে। পণ্যের দাম বেড়েছে। অন্যদিকে বিক্রির পরিমাণ কমেছে। বাণিজ্যিক সংঘাত তীব্রতর হয়েছে। এখন আমরা এক অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতি সম্মুখীন হচ্ছি।"

বিদেশি চাহিদা হ্রাস হওয়ার কারণে কিছু রপ্তানি বাজারের ওপর নির্ভরশীল শিল্পপ্রতিষ্ঠান কঠিন সমস্যা সম্মুখীন হচ্ছে। তাদের আরো ভালোভাবে পরিসেবা দেওয়ার জন্য বিনহাই নয়া অঞ্চল রপ্তানি বাড়ানোর জন্য ধারাবাহিক সুবিধাজনক ব্যবস্থা নিয়েছে।

এ অঞ্চলের বাণিজ্য কমিটির উপপ্রধান চাং চি চেন বলেন, "আমরা প্রথমে কাজের দক্ষতা উন্নত করি, যাতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো উত্পাদনের ওপর মনোযোগ দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, আমরা অর্থ সংগ্রহের প্লাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করেছি, যাতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো অল্প-সুদের ঋণ পেতে পারে। তা ছাড়া প্রতি বছর আমরা তিন থেকে চারটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিনিময় সভার আয়োজন করি। আমাদের আমন্ত্রণে বিদেশি ব্যবসায়ীরা এসে সরাসরি চীনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করেন। তৃতীয়ত, আমাদের ইলেক্ট্রনিক বাণিজ্য প্লাটফর্ম আছে। এর মাধ্যমে দ্রুত তথ্য বিনিময় করা যায়। আমরা চীনের ইলেক্ট্রনিক বাণিজ্য প্লাটফর্মের সঙ্গে সহযোগিতা করে এ অঞ্চলের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে তথ্য সরবরাহ করি। চতুর্থত, যদি শিল্পপ্রতিষ্ঠান শুল্কবিভাগে পরিষ্করণ বা কোয়ারেনটাইনের সময় কোনো সমস্যা সম্মুখীন হয়, আমরা সমন্বয় করি, যাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমস্যা সমাধান করা যায়।"

বর্তমান চীনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে ৩০ বছরের আগের তুলনায়। প্রথম দিকে চীনের প্রধান কর্তব্য ছিল উত্পাদনশক্তি মুক্ত করা এবং দ্রুত সমৃদ্ধ হওয়া। এখন চীন গভীর স্তরের সংস্কার আর শিল্প সুবিন্যাস ও উন্নত করার ওপর আরো বেশি মনোযোগ দিচ্ছে।

গভীর স্তরের সংস্কার অন্বেষণের পথে থিয়েনচিনের বিনহাই নয়া অঞ্চলে অনেক নতুন প্রচেষ্টা চালিয়েছে। আধুনিক শিল্প ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, বন্দর বাণিজ্য এগিয়ে নেওয়া এবং উচ্চ-প্রযুক্তিগত শিল্পপ্রতিষ্ঠান আকর্ষণ করার পাশাপাশি এ নয়া অঞ্চল সিঙ্গাপুরের সঙ্গে সহযোগিতা করে এক প্রাকৃতিক নগর নির্মাণের চেষ্টা করছে। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে ভবিষ্যতে মানুষ ও মানুষ, মানুষ ও অর্থনীতি, মানুষ ও সমাজ সবার সামঞ্জস্য বৃদ্ধি করা। এটা চীনেরও লক্ষ্য। (ইয়ু/এসআর)

মন্তব্য
মন্তব্য
লিঙ্ক